ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

চেতনা শানিত করার বয়ান

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চেতনা শানিত করার বয়ান

বাঙালী জাতিসত্তা বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ভাস্বর হয়ে আছে। এই আন্দোলনের বীজ বপন করে, চারাকে পরিচর্যার মাধ্যমে যরা বটবৃক্ষে পরিণত করেছেন সেই সব মানুষ রাজনৈতিক দিকপালদের পাশাপাশি প্রাতঃস্মরণীয়। বয়সজনিত কারণে তাদের কেউ আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছেন, কেউ অশীতিপর কেউ এখনও সচল আছেন। এসব বাতিঘরদের ঘিরেই রচিত তিনটি গ্রন্থ আমাদের হাতে এসেছে। একটি ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা ॥ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন,’ দ্বিতীয়টি ‘সরদার ফজলুল করিম ॥ স্মারকগ্রন্থ।’ গ্রন্থ দুটি সম্পাদনা করেছেন মাহফুজা খানম ও তপন কুমার দে যৌথভাবে। তৃতীয় গ্রন্থটিও সংশ্লিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক তবে স্মৃতিচারণামূলক। এটি লিখেছেন মাহফুজা খানম, গ্রন্থের নাম ‘তোমরাই ধ্রুবতারা।’ মাহফুজা খানম যাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন করেছেন তারাও আমাদের কাছে নমস্য। ব্যক্তিগত স্মৃতি তর্পণ হলেও তা আর ব্যক্তি পর্যায়ে থাকেনি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের অঙ্গ। মাহফুজা খানম একজন সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন যুক্ত। এমন একটা সময় তিনি ডাকসুর (১৯৬৬-৬৭) ভিপি ছিলেন যখন বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়। সেই মানুষটির মেধা ও মননের স্বাক্ষর আমরা পাই তিনটি গ্রন্থে। সব কিছু ছাপিয়ে তিনটি গ্রন্থেই প্রকাশিত হয়েছে চেতনার শানিত বয়ান। যা পাঠকের হৃদয়কে করবে উদ্বেলিত ও অগ্রগামী। ধর্মনিরপেক্ষতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন বাঙালী জাতির বিকাশের মূলে যে চেতনাটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তাহলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মহান একটি দর্শন ও মৌলনীতি বাহাত্তরের সংবিধানে সংযোজিত। যা বাঙালী জাতিকে এক মিছিলের যাত্রী করেছিল। সেই ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী নয় এমন গোষ্ঠী। বিভ্রান্তি ছড়ায় এসব দর্শন ও মৌলনীতির বিরুদ্ধে। প্রগতিশীল, মুক্ত মনের মানুষ ও আমাদের বোধিবৃক্ষ বলে যারা বিবেচিত তারা চুপ থাকেননি, ধরেছেন কলম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তথ্য-তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন তারা। দেখিয়েছেন এর আলোকে রাষ্ট্র, সমাজ তথা মানুষের মুক্তির দিশা। তেমন প্রবন্ধ-নিবন্ধের সমাহার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ॥ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন’ গ্রন্থটি। ৬০-এর অধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে এ গ্রন্থে। লিখেছেন আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আহমদ রফিক, মাহমুদুল বাসার, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, স্বদেশ রায়, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী, মোহীত উল আলম, মিলু শামসসহ আরও নবীন-প্রবীণ লেখক। গ্রন্থের বিশেষ আকর্ষণ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুক মওদুদী’র সাক্ষাতকার। যিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘ধর্মকে যদি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে সেখানে মানবতার মৃত্যু ঘটে।’ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে কীভাবে ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেয়েছিল।’ সীতারাম ইয়েচুরি, হুসাইন হাক্কানির সাক্ষাতকারও গ্রন্থটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে। অশোক কর্মকারের চমৎকার প্রচ্ছদ সংবলিত গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে মেরিট ফেয়ার প্রকাশন। ৩১৯ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৫০০ টাকা। সরদার ফজলুল করিম স্মারকগ্রন্থ রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক সর্বোপরি দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের প্রয়াণ বাঙালী জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে পরবর্তী সময়েও দেশজাতি সমাজের সংকটে তার অবদান চিরস্মরণীয়। মানব ও মানবতার কল্যাণ এবং মুক্তি ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। তিনি বিশ্বাস করতেন মানব মুক্তির একমাত্র পথ সাম্যবাদ। বস্তুবাদের পথে ছিল তার বিচরণ। সারাজীবন থেকেছেন আপসহীন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার সক্রেটিস। তার স্মরণেও দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন মাহফুজা খানম ও তপন কুমার দে। স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করতে গিয়ে যেসব লেখা বাছাই করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট হয় সম্পাদকদ্বয়ের মেধা ও রুচি। যারা লেখা দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন তারা হলেনÑ আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার, মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, এমএম আকাশসহ আরও অনেকে। সম্পাদকদ্বয়ও লেখা দিয়ে নিবেদন করেছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। ২৬টি লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রন্থটি। সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে ও তাঁকে তর্পণ করে কবিতাও নিবেদিত হয়েছে। তিনটি কবিতার মধ্যে একটি শামসুর রাহমানের। সরদার ফজলুল করিমের রচনা থেকে পুনর্মুদ্রণ। তাঁর প্রবচন, সাক্ষাতকার, সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থটির মর্যাদা ও প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছে বৈকি। এ গ্রন্থটিরও প্রচ্ছদ করেছেন অশোক কর্মকার, প্রকাশক মেরিট ফেয়ার প্রকাশন। তোমরাই ধ্রুবতারা গ্রন্থের নামেই বোঝা যায় নক্ষত্রদের কথা নিহিত আছে। আর একথা বেশিরভাগই স্মৃতি তর্পণ। দেশের আলোকবর্তিকা বা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে যারা মহীয়ান তাদের সংস্পর্শ ও সংস্রবে মাহফুজা খানম গিয়েছেন তাদের উজ্জ্বল ও চুম্বক অংশ নিয়ে নিবন্ধের সমাহার ‘তোমরাই ধ্রুবতারা’। কে নেই তার স্মৃতি তর্পণে? বাবা মুস্তাফিজুর রহমান খান, কবি সুফিয়া কামাল, নারী নেত্রী আজিজা ইদরিস, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, কাজী ইদরিস, সৈয়দ আহমদ হোসেন, কবীর চৌধুরী, গোবিন্দচন্দ্র দেব, বিচারপতি জাকির আহমেদ, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, শিক্ষক নাজমুল করিম, কমরেড নুরুল ইসলাম, ভাষা আন্দোলনের পিয়ারু সরদার, সরদার ফজলুল করিম, বিচারপতি একে বদরুল হক, ওস্তাদ বারীন মজুমদার, বেবী মওদুদ, কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, জননী সালেহা খানম ও জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ প্রমুখ তার শ্রদ্ধাঞ্জলিতে উঠে এসেছে। এ শ্রদ্ধাঞ্জলি আর স্মৃতিচারণ ব্যক্তিগত গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা হয়ে উঠেছে ইতিহাসের উপাদান ও অনুষঙ্গ। অনেক অজানা কথা ও ইতিহাসের উপাদান জানা যাবে ‘তোমরাই ধ্রুবতারা’ পাঠে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। এটারও নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন অশোক কর্মকার। বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।
×