ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশের প্রথম কবিতা ॥ এক পুলিশ কর্মকর্তার বৃত্তান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একুশের প্রথম কবিতা ॥ এক পুলিশ কর্মকর্তার বৃত্তান্ত

জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্বের ছুরি হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান নামের দুটি পৃথক রাষ্ট্্র জন্ম দিলেও বাঙালী জাতির মুক্তির পথ তখনও অবরুদ্ধই ছিল। সে সূত্র ধরেই বায়ান্নোর রক্তোজ্জ্বল ভাষা সংগ্রাম আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাঙালী জাতির পরিচয় ঘটে। মূলত জাতির প্রথম আনুষ্ঠানিক রক্ত-প্রতিক্রিয়া ’৫২-এর ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই প্রথম সূচনা হয়। ফলে বায়ান্নে ভাষার লড়াইয়ে বিসর্জিত রক্তের বিক্ষুব্ধ স্রোতে গা ভাসিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে একাত্তরের শাশ্বত বিজয়ের পতাকা। আজও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ১৬ ডিসেম্বর এ দুটি গুরুত্ববহ সময় বাঙালী জাতির অস্তিত্বে চিরহরিৎ দিবসপর্বে খচিত আছে। এ দুটি জাতীয় গর্বের দিনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অজস্র জ্বালাময়ী কবিতা, গান, নাটক, গল্প, উপন্যাস, দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম ও চিন্তাবাহী শিল্পসম্ভার। এতো বছর পরেও ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে আমাদের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা সমান তালে বিকশিত হয়ে চলেছে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এতো জ্বালাময়ী শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। তারপরেও পূর্ব-বাংলার অসীম সাহসী সন্তানেরা নরঘাতক পাকবাহিনীর অস্ত্রের মুখে পড়েও নিজেদের প্রতিবাদ বন্ধ রাখেননি, স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিভারও। রক্তশোভিত মহান ভাষা সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর কথা আজ আর কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। মায়ের ভাষার জন্য পৃথিবীর রক্তঢালা একমাত্র জাতিই হচ্ছে বাঙালী জাতি। মাতৃভাষার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মতো বিরল দৃষ্টান্তই তার একমাত্র প্রমাণ বহন করে। ভাষা আন্দোলনের সেই ভয়াল মুহূর্তে যে ক’জন শিল্পসাহিত্যের অগ্রসৈনিক এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনের একনিষ্ঠকর্মী কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী অন্যতম ও অগ্রগণ্য। তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটিই ভাষাসংগ্রামের উপর লেখা ইতিহাসের প্রথম এবং স্বার্থক কাব্য-প্রতিবাদ হিসেবে আজও নন্দিত। তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে পাকিস্তান সরকারের উপর যে নিন্দাগ্নি বিচ্ছুরিত হয়েছে তা আজও বাঙালী জাতির অনুপ্রেরণার উৎসরূপে প্রোথিত আছে। আলোচ্য কবিতাটি ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া উর্দু ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাকে মাতৃভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে নজিরবিহীন পুলিশি তা বের নিন্দা জানিয়ে কবি চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন ওইদিন সন্ধ্যার মধ্যেই এই ঐতিহাসিক রচনাটি লিখে শেষ করেছিলেন। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায় কবি, মাতৃভাষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া মেধাবী ছাত্রদের উপর নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং দেশের অমিত সম্ভাবনাময় ছাত্রদের হত্যা করে দেশ-জাতি-ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টাকে অত্যন্ত সুতীক্ষèচিত্তে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ভাষাযুদ্ধে নিহত ছাত্রদের জড়িয়ে ধরে তিনি কান্নাকাটি বাদ দিয়ে ঘাতক অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার কাব্যপ্রত্যয় নিয়ে ছুটে এসেছেন জনতার আদালতে, মানবতার দুয়ারে। কবি বিশ্বাস করতেন, ভাষার দাবিতে রাজপথে প্রাণ বির্সজন দেয়া চল্লিশ কিংবা তারও অধিক ছাত্রের লাশগুলো সাধারণ কোন মানুষের লাশ নয়। এরা প্রত্যেকেই পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম ভাষাপ্রেমী বীর-শহীদ। কখনও ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিবেদী উপড়ে ফেলে দিলেও তাঁদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য কিছুতেই ম্লান হবে না। এ ঐতিহাসিক মৃত্যুর আর্তধ্বনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ঘণ্টাধ্বনির মতো অনন্তকাল বেজে উঠবে বাঙালী জাতির হৃদয়-গহিনে। এখানেই মৃতদের কাতারে লুকিয়ে ছিল বিশ্ব কাঁপানো আব্রাহাম লিংকন, এখানেই সুপ্ত ছিল রকফেলার, আরাগঁ কিংবা আইনস্টাইনের চেয়েও বিস্ময়কর প্রতিভাকুসুম। কবির আত্মবিশ্বাস ছিল যে রাজপথে নিহত ছাত্রদের মধ্যে এমনও মেধাবীমুখ লুকিয়ে ছিল সে হয়ত কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতার চেয়েও আরও চমৎকার কিছু কবিতা আমাদের উপহার দিতে পারত। আর এখানকার কেউই কোন আলালের ঘরের দুলাল ছিল না। ছিল গ্রামের নিভৃতচারী কোন হতদরিদ্র কৃষকের সন্তান কিংবা সাদামাটা একজন কেরানির পুত্র-সম্পদ অথবা সাধারণ কোন সরকারী চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী পিতার আদরের মূলধন। হয়তোবা নিহত তরুণদের মধ্য থেকে কারও বিয়ের দিনও ধার্য হয়েছিল অল্পদিন পরে। হয়তোবা কেউ মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা পড়ে শেষ করার আগেই টেবিলে রেখে ছুটে এসেছে মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার জন্যে। এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে জালিমের গুলিতে যাঁরা প্রাণ বলি দিয়েছেন সেই সব শহীদের পক্ষ নিয়ে কবি জনতার আদালতে খুনীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে ছুটে এসেছেন। নেমে এসেছেন হাজার বছরের প্রবহমান সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় ছুটে আসা মানুষের কাতারে। আলাওলের ঐতিহ্যের জন্য, কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতার জন্য অথবা রমেশ শীলের গাথার জন্য কিংবা জসীমউদ্দীনের সুজন বাদিয়ার ঘাটের জন্য এবং অসংখ্য ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, জারি-সারি-পালা গানের মুক্তির জন্য যাঁরা রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতলে প্রাণোৎসর্গ করল তাঁদের হন্তারকদের ফাঁসির দাবি নিয়ে কবি ছুটে এসেছেনে দেশ-জাতি ও সভ্যসমাজের আদালতে। তিনি কাঁদার জন্য কিংবা পাল্টা আক্রমণ অথবা নতুন করে ভাষার দাবি নিয়ে হাজির হননি। তিনি এসেছেন খুনীদের ফাঁসি নিশ্চিত করে শহীদের আত্মার প্রশান্তি কামনা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে ঘরে ফেরার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে। কবির ভাষায়Ñ ‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি/যারা প্রাণ দিয়েছেন ওখানে-রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্যÑবাংলার জন্য।/ যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন ওখানে/একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য/আলাওলের ঐতিহ্য/ কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের/সাহিত্য ও কবিতার জন্যÑ/যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন ওখানে পলাশপুরের মকবুল আহমেদের পুঁথির জন্যÑ/রমেশ শীলের গাথার জন্য, জসীমউদ্দীনের ‘সুজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।/যারা প্রাণ দিয়েছেন ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল নজরুলের ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ এই দুই লাইনের জন্য/দেশের মাটির জন্য,/ রমনার মাঠের সেই মাটিতে/কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো/চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর/ অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে/আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত। রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত/বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোন ছেলের বুকের রক্ত/আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা/রমনার সবুজ ঘাসের ওপর/ আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।... /যাঁরা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে/আমরা তাদের কাছে/ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ/আমরা এসেছি খুনী জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।’ (কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, ক্লান্ত বাঁশির সুর) চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর যুগান্তকারী সৃষ্টিকর্ম ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আজও বাংলা ভাষাভাষীদের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে। কিন্তু একুশের এই অনবদ্য কবিতাটি এতো বছর পরেও আমরা হাতে পাওয়ার যে সৌভাগ্য অর্জন করেছি এর নেপথ্যে লুক্কায়িত নিগূঢ়-রহস্যটি অত্যন্ত নাটকীয় এবং অবিশ্বাস্য, অনেকটা মিথের মতো। বিস্ময়কর হলেও সত্য, কবিতাটি সংরক্ষণে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা রাখার আদতে রয়েছে তদানিন্তন সরকারের আশরাফুল হক নামের এক দেশপ্রমিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং তাঁর স্ত্রী ও ছোট বোন মনজুরা খানমের বিরল মহানুভবতার দৃষ্টান্ত। আর সেই মহান পুলিশ অফিসারটি হচ্ছেন একালের বাংলা-সাহিত্যের অন্যতম চিন্তানিমগ্ন প্রাবন্ধিক কথাকার মফিদুল হকের পিতা। পূর্ববাংলার প্রথম মর্যাদাবান ‘সীমান্ত’ নামের মাসিকপত্রের সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি উস্কে দিয়েছিল ভাষাপিয়াসী বাঙালী জাতিকে। শুধু তাই নয় পূর্ব-বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিনির্ভর আর প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ ভিনদেশী ভাষা বিবর্জিত একেবারেই নিজস্ব ভাষাশৈলিতে সাজানো ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আমাদের মূলধারার সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল। তাই কবিতাটি আলোতে আসার পরপরই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তানের স্বৈর-সরকার। কবিতাটি শুধু বাজেয়াপ্ত করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি তারা। কবির বিরুদ্ধে হুলিয়া পর্যন্ত জারি করেছিল তৎকালীন জালিম সরকার। তারই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় হলে অভিযান চালিয়ে কবিতাটি উদ্ধার করার জন্য সরকারী বাহিনী এসে হাজির হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে কবিতাটি এমন এক মহান ব্যক্তির মাধ্যমে উদ্ধার হলো, দেশ ও ভাষার প্রতি যাঁর ছিল অগাধ টান, সীমাহীন শ্রদ্ধাবোধ। আশরাফুল হক নামের সাধারণ সেই পুলিশ কর্মকর্তাটি জীবন আর চাকরির ভয় উপেক্ষা করে উদ্ধারকৃত কবিতাটি নিয়মমাফিক সরকারী দফতরে জমা দেয়ার আগেই একটি অনুকপি গোপনে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন ঐতিহাসিক এই কবিতা বাংলা-ভাষার বিরাট এক কাব্য-সম্পদ, তাকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। তাই সবার অগোচরে তিনি কবিতাটির অনুকপি সরিয়ে এনে স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন কাকপক্ষিও যেন টের না পায়। স্বামীর কথামতো স্ত্রী সেটা সংরক্ষণের জন্য তুলে দিয়েছিলেন প্রিয় ননদীনির হাতে। ননদীনি মনজুরা খানম কবিতাখানা তার ব্যক্তিগত ডায়রিতে টুকে রেখে নষ্ট করে ফেলেন আসল কপি। এভাবেই, তারপর কেটে গেল চার দশকের অধিক, চলে গেল বর্বরোচিত পাকিস্তান সরকারে লৌহ-সময়। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আলোচ্য কবিতাটি বেঁচে থাকার পেছনে গা শিউরে ওঠা কাহিনীটি সম্পর্কে প্রাবন্ধিক মফিদুল হক ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী : এক অবিস্মরণীয় কবিতার জনক’ প্রবন্ধে আলোকপাত করতে গিয়ে এই দুর্লভ তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছিলেন। বক্ষ্যমাণ রচনায় প্রাবন্ধিক মফিদুল হকের বক্তব্যের কীয়দংশ হুবহু তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছি। লেখক তাঁর গদ্যে উল্লেখ করেছেনÑ ‘‘ ...আলোচনা ও গবেষণায় ফিরে এসেছে একুশের প্রথম কবিতা যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘কাঁদতে আসিনি ফঁাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এবং তাঁর রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম, আর সেইসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে আমার পিতা আশরাফুল হকের নাম, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সাধারণ এক কর্মকর্তা যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত কবিতার কপি। নিয়মমাফিক তা দফতরে জমা হলেও এই কর্মকর্তা বুঝতে পেরেছিলেন কবিতার মাহাত্ম্য, একটি কপি এনে দিয়েছিলেন আমার মাকে, বলেছিলেন অত্যন্ত সঙ্গোপনে রাখতে, কাকপক্ষি টের পেলেও অসুবিধা হবে। মা এরপর সেই নিষিদ্ধ কবিতা তুলে দিয়েছিলেন তার কলেজে পড়ুয়া ননদিনীর হাতে, যিনি আপন ডায়রিতে কবিতাটি টুকে নষ্ট করে ফেলেছিলেন মূলকপি।’’ গোটা পাকিস্তান আমলের সেই বিপজ্জনক মুহূর্তে কবিতাটির আর হদিস পাওয়া গেল না। ফলে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর এই কবিতার কথা মানুষজন বেমালুম একপ্রকার ভুলেই গেল। স্বয়ং কবি নিজেই দু’একটি চরণের বেশি এই দীর্ঘদেহী কবিতার আর কিছুই স্মরণ করতে পারলেন না। কিন্তু সেই অবিস্মরণীয় কবিতাটি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো দেশ স্বাধীনের পরপরেই। তাও আবার এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বের কল্যাণে। এ সম্পর্কেও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক তাঁর ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী : এক অবিস্মরণীয় কবিতার জনক’ রচনায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাজির করে বলেছেন- ‘‘এই কবিতার খোঁজ পড়লো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। তিনি নিজেও কয়েকটি মাত্র পঙ্ক্তির বেশি স্মরণ করতে পারেননি। অবশেষে এক টেলিভিশন আলোচনা শুনে, আমার ফুপু মনজুরা খানম, স্মরণ করতে পারলেন তাঁর পুরনো ডায়রির কথা, খুঁজে পেয়ে বের করে আমাকে সেই সংবাদ জানালে আমি মাহবুব ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারি নিষিদ্ধ ঘোষিত হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক কবিতা। এর কিছুকাল পর অবশ্য নিষ্ঠাবান গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকের কল্যাণে পাওয়া গেছে লিফলেট আকারে চট্টগ্রামে মুদ্রিত কবিতার কপি। চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে একটি কবিতা আবার ফিরে এলো কবির কাছে, কবিতার পাঠকদের কাছে- এমন উদাহরণ সাহিত্যের ইতিহাসে আর রয়েছে বলে মনে হয় না।’’ প্রাবন্ধিক মফিদুল হকের লেখার বদৌলতে যে দুরন্ত-সত্যের রহস্যময় গল্প আমাদের অবাক করে দিয়েছে তা কোটি বছরের পৃথিবীতে আজ অব্দি কোন সাহিত্যের ইতিহাসে ঘটেছে বলে সন্দিহান প্রকাশ করি। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে একেবারেই সরল ধাঁচের প্রতিবাদী একটি কবিতা সাধারণ মানুষের মনকে কতোটুকু নাড়া দিলে তার ইতিহাস এতো স্বর্ণাচ্ছান্ন হয়! মাহবুব উল আলম চৌধুরী সুদীর্ঘ একাশি বছরের জীবৎকালে অসংখ্য কবিতা, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করে গেলেও কবিকে বাংলা-সাহিত্যে চির অমর করে রাখতে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটিই যথেষ্ট। কবিতাটিতে কবির বিস্ময়কর দূরদর্শিতা এবং চিন্তাচেতনার ব্যাপ্তি ও সৃজনক্ষমতার বহর প্রায় তিনযুগেরও অধিক সময় পরে আমাদের ধমনীতে বার বার রক্তকম্পন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে- মূলত এটাই তাঁর কবিত্বের সবচেয়ে বড় শক্তি! কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সিংহভাগ কবিতার প্লট দেশ, ভাষা, মাটি ও সাধারণ মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে এবং তিনি নিজেও সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, সম-অধিকার আদায়ের পক্ষে। কবি নিরন্তর যুদ্ধ করে গেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, হেঁটেছেন একটি অসম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের পথে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ৭ নবেম্বর চট্টগ্রামের গহিরা গ্রামের আসাদ চৌধুরী পরিবারে জন্ম নেয়া এই মহান কবি আমাদের হাতে একটি শাশ্বত ভাষার ছাড়পত্র তুলে দিয়ে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ ডিসেম্বর নির্মম শহর ঢাকার মাটিতে নিজেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দিয়ে চিরতরে লোকান্তরের দিকে এগিয়ে যান।
×