ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াইজ করণী

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ব্রাজিল

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ব্রাজিল

ব্রাজিলবাসীর আনন্দে উদ্বেলিত এক ফুরফুরে মেজাজে ২০১৬ সালের যাত্রা শুরু করার কথা। কারণ তাদের সামনে আছে অলিম্পিক গেমস যার আয়োজক হতে যাচ্ছে তারা নিজেরাই। আগামী আগস্টে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিকের এই আসর হবে দক্ষিণ আমেকিার বুকে এই প্রথম। এমন মর্যাদাজনক ব্যাপারটির জন্য ব্রাজিলের জনগণ খোশমেজাজে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা তা নেই। কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বিপাক ও বির্যয়ের দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়া করছে। ব্রাজিলের অর্থনীতি বেশ শোচনীয় অবস্থায়। কিছুতেই একে বাগে আনা যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ডিলমা রুসেফ অর্থনীতিকে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জোয়াকিম লেভীকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই তিনি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ক’দিন আগে তিনি মন্ত্রীপদে ইস্তফাও দিয়েছেন। চলতি বছর অর্থনীতির আড়াই থেকে তিন শতাংশ সঙ্কোচন ঘটবে বলে পূর্বাভাস আছে। বিশ্বের তিনটি বৃহৎ ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ব্রাজিলের বন্ডকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিনিয়োগের অযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে। এমনকি তেলসমৃদ্ধ ও অবরোধে বিপর্যস্ত রাশিয়ার অবস্থাও ব্রাজিলের চেয়ে ভাল। একদিকে অর্থনীতির এই বেহাল দশা অন্যদিকে রাজনীতির চিত্রটাও কোন অংশে ভাল নয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাসকে ঘিরে যে লাগামহীন লুটপাট ও ঘুষের কেলেঙ্কারি চলছে তাতে শাসক কোয়ালিশনের মুখে চুনকালি পড়েছে। জনগণের চোখে অতিমাত্রায় ধিকৃত হয়ে পড়েছে এই সরকার। প্রেসিডেন্ট রুসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বিশাল অংকের বাজেট ঘাটতি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। এই অভিযোগে পার্লামেন্টে তাঁকে ইমপিচ করা হতে পারে। পশ্চিমী অর্থনৈতিক জোটের বিপরীতে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যে পাল্টা অর্থনৈতিক জোট রচিত হয়েছে তার প্রথম দেশটি হলো ব্রাজিল। সে হিসেবে দেশটির এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা। অথচ রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেশটি এক অকার্যকর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত এক লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়তে যাচ্ছে দেশটি। এমন সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে হলে ব্রাজিলের সামনে খোলা আছে শুধু কঠিন পথ। কিন্তু সেই পথে অগ্রসর হওয়া রুসেফের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রাজিল দ্রুত বর্ধিষ্ণু উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হয়েও এখন কঠিন সমস্যায় পড়েছে বিশেষ কতগুলো কারণে। তার মধ্যে প্রধান কারণটি বিশ্ববাজারে পণ্যের দরপতন। তবে সমস্যাটা আরও প্রকট হয়েছে রুসেফ ও তার বামপন্থী দল ওয়ার্কার্স পার্টির ত্রুটিপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে। তার প্রথম কার্যকাল ২০১১-১৪ সালে তিনি অনেক অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করেছেন। যেমন পেনশন অনেক বাড়িয়ে দিয়ে সরকারী তহবিলের শ্রাদ্ধ করেছেন। নিজেদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত শিল্পগুলোকে কর রেয়াত দিয়ে সরকারের রাজস্বের ঘাটতির কারণ ঘটিয়েছেন। সরকারের আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ২০১০ সালে ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছায়। সরকারী ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৭০ শতাংশ। একটা মধ্য আয়ের দেশের জন্য এটা উদ্বেগজনকভাবে বিশাল। মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে সাড়ে ১০ শতাংশ। ব্যাংকের সুদের হার বেশি হওয়ায় সার্ভিসিংয়ের খরচও বেশি। এ অবস্থায় কর বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস করা ছাড়া ব্রাজিলের সামনে পথ তেমন একটা খোলা নেই। অর্থমন্ত্রী হিসেবে লেভী এই ব্যয় হ্রাসের চেষ্টাই করেছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ঐচ্ছিক ব্যয় ১৮শ’ কোটি ডলার হ্রাস করেন ও বেকার বীমার গ্রহণযোগ্যতা কড়াকড়ি করেন। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। মন্দার কারণে কর রাজস্ব পড়ে যায়। ব্রাজিল তার শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষাকবচ যুগিয়েছে। এ হলো অন্যতম কারণ যার জন্য ৪১টি দেশের মধ্যে কারখানা শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে ব্রাজিলের অবস্থান চতুর্থ নিম্নতম। ব্রাজিলের সরকারী খাত আকারের দিক দিয়ে ইউরোপের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ অদক্ষতার দিক দিয়ে এই খাতের কোন জুড়ি নেই। দেশেটির কাঁধে এ মুহূর্তে ২৫ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণের বোঝা। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ ব্রাজিলের অর্থনীতি ২০১৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে যা ছিল তার তুলনায় ৮ শতাংশ ছোট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। ব্রাজিলের এখন প্রয়োজন অর্থ। কিন্তু রুসেফ সরকার কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর পথে যেতে চান না। তার বদলে সরকার এখন পথ মাড়াতে পারেন যা বিনিয়োগকারী ও ভোক্তা উভয়কে আরও সমস্যার মুখে ঠেলে দিতে পারে। সেটা হলো মুদ্রাস্ফীতি। এতে করে দেশটির কাঁধে ঋণের বোঝা আরও অনেক বেড়ে যাবে। ব্রাজিলের এক মস্ত সাফল্য এইখানে যে দেশটি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের নিষচক্র থেকে বের করে এসেছে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা সেই প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। চলতি অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় রুসেফ সরকার শেষ পর্যন্ত সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×