ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ইতিহাসের ঘটনা ও জীবনের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ইতিহাসের ঘটনা ও জীবনের কাহিনী

একটি জাতির জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা, জয়-পরাজয়ের ঘটনা থাকতেই পারে। কিন্তু সে সব ঘটনার ধারাবাহিকতায় তার বেড়ে ওঠার কাহিনীতে ঘনঘটার কমতি নেই। যুগে যুগে মানুষ নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সেই ইতিহাসের নেপথ্যে থাকে বহু মানুষের কর্ম, আত্মত্যাগ, আত্মদান আর লড়াইয়ের ঘটনা। সে সব ঘটনার সুতোগুলো গ্রন্থিত ও গ্রথিত হয়ে একটি সামগ্রিক চেহারা তৈরি করে। ইতিহাসের ঘটনা সৃষ্টিকারী এবং তাতে অংশগ্রহণকারীরা একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু মূল্যায়ন করেন, তা নয়। যার যার অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সৃজনকে যদি নিজেরাই বিশ্লেষণ করে থাকেন, তবে তাতে ইতিহাসের উপাদানগুলো ওঠে আসে। ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ক্লিও স্বভাবতই কৌতুকপ্রবণা। মানবজাতির জীবননাট্য পরিবেশনের ভার তাঁর হাতে। খানিকটা নাটকীয়তা তাঁর স্বভাবে থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। চমকপ্রদ ঘটনার প্রতি তার স্বাভাবিক ঝোঁক এবং ভালবাসেন হাঁকডাক জাঁক। যেখানে শোরগোল সেখানেই তাঁর কৌতূহল। যা নীরবে নিঃশব্দে ঘটে তাঁর দিকে তিনি ফিরেও তাকান না। এ জন্য এক ইংরেজ মনীষী ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, প্রচ- ঝড় এসে যখন বাড়ির ছাদ উড়িয়ে নেয়, গাছ উপড়ায়, ডালপালা ভাঙে, প্রাণনাশ ঘটায়, তখন সেটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যে মৃদুমন্দ দক্ষিণ সমীরণ ফুলের রেণু নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিয়ে যায় এবং নতুন সৃষ্টির বীজ বপণ করে তার খোঁজ কেউ রাখে না। ইতিহাসে তার উল্লেখ থাকে না। যে ব্যাপার ঘটা করে ঘটে তার নামই ঘটনা। যে জিনিসটা ঘটা করে না, হৈচৈ করে না, সে ইতিহাসের ছাঁকনির ফাঁকে গলে যায়, ধর্তব্য বলেই গণ্য হয় না। অর্থাৎ যথেষ্ট শোরগোল করে না ঘটলে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ জিনিসও হিসেবের খাতায় বাদ পড়ে যায়। ইতিহাসের স্বভাবে এমন আরও অনেক বৈপরীত্য রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যে দেশ যত বেশি উন্নত; সে দেশে চমকপ্রদ এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনা খুব একটা ঘটে না। এর কারণ শক্তিতে, সামর্থ্য,ে শিক্ষায় ও সম্পদে যে দেশ অগ্রসর, সে দেশে একটা স্থিতিস্থাপকতা এসে যায়। সেখানে জীবনযাত্রা স্বাচ্ছন্দ্য এবং নির্বিঘœ। তারা পারতপক্ষে কোন পরিবর্তন চায় না। যেমনটা এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডে বাণিজ্য বিস্তার এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপে যে জীবন চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল, গত চার শ’ বছরের মধ্যে সে চাঞ্চল্য ওদেশে আর ফিরে আসেনি। এলিজাবেথের যুগে যার শুরু তার চরম পরিণতি ঘটে ভিক্টোরিয়ার যুগে। ইংল্যান্ড তখন ঐশ্বর্যের উচ্চতর শিখরে গিয়ে পৌঁছেছে। ভিক্টোরিয়ান যুগের ‘সেল অব সিক্যুরিটি’ অর্থাৎ ‘বা: বেশ তোফা আছি’Ñ এই মনোভাব আজ পরিহাসের বস্তু বৈকি। সুখ সমৃদ্ধি যে পরিমাণে বেড়েছে, জাতির জীবনীশক্তি সেই পরিমাণে ক্ষীণ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘মহাজনের নৌকা চলে গজেন্দ্র গমনে। কারণ তার নিজের গরজ নাই। হাটুরিয়ার নৌকা হটর হটর যায়, কারণ গরজটা তার নিজের। অভাবের দেশে হাটুরিয়া নৌকার দেশ, সে নিজের গরজেই দ্রুত চলে।’ অবশ্য উন্নত দেশ যে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে এমন নয় তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে, তার উন্নতি খুব দ্রুত তালে চলে না। যে দেশ হীনবল, সহায়-সম্পদহীন, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ, দ্রুত উন্নতির অবকাশ সেখানেই, বিপ্লবাত্মক ঘটনা সে সব দেশেই ঘটে থাকে। যাদের সব আছে তাদেরই সর্বনাশের ভয়। তারা সর্বস্ব আঁকড়ে ধরে থাকে, সেখানে বিপ্লব ঘটে না। যাদের কিছুই নেই, তাদের সর্বনাশের ভয়ও নেই; বিপ্লব সেখানেই ঘটে। অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটেছে, বিশ শতকের গোড়ায় রুশ দেশে, মাঝামাঝিতে চীন দেশে। যখন বিপ্লব ঘটেছে, তখন ওসব দেশে জনগণের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছিল। অর্থাৎ উন্নতির প্রশস্ত অবকাশ রচিত হয়েছিল। মানুষ অভাবের তাড়নায় মরিয়া হলে তবে চেনা পথ ছেড়ে অচেনা পথে চলতে শেখে। অবশ্য কৃতিত্বটা সমস্তই জনতার এমন নয়, জননেতাদের কৃতিত্বও স্বীকার করতে হবে। তারাই নতুন পথ চিনিয়ে দেন। কিন্তু ইতিহাসের গতি কুটিলা গতি। সর্বজনের সর্বাঙ্গীণ সুখ-সমৃদ্ধির অভিযানকেই বলে বিপ্লব। প্রাণ রাখতে যেমন প্রাণান্ত, বিপ্লব রাখতে তেমনি বিপ্লবান্ত ঘটে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের মানচিত্র বদলে গিয়েছিল। যুদ্ধের সময় একটা বুলি অহরহ শোনা যেতÑ এক বিশ্ব। দেশে দেশে ভেদ থাকবে না। সব দেশ মিলিয়ে এক দেশ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সে দেশের নাম বসুন্ধরা’। তবে ইতিহাসের কী পরিহাস! যুদ্ধ থামলÑকোথায় সব মিলিয়ে এক দেশ হবে তা না এক দেশ ভেঙ্গে দু’তিন দেশ হলো। ভারতবর্ষ তিন টুকরো হলো। একদিকে ভারত, অপরদিকে পূর্ববঙ্গ, পশ্চিম পাকিস্তান। অবশ্য দেশ যখন এক ছিল তখন দেশবাসীর দিগি¦দিক জ্ঞান ছিল না। এখন পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞান হয়েছে এবং খুব ভাল রকম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীকে প্রাচ্য-প্রতীচ্য এই দুই ভাগে বিভক্ত দেখেছিলেন এবং এই দুইকে মেলাতে চেয়েছিলেন। অথচ তা মেলেনি। দূরত্ব দূর সৃষ্টি করে গেছে। বিশ শতকের শেষার্ধে সবচেয়ে বড় বিপ্লবী ঘটনা ঘটেছে এই বাংলাদেশে। বাঙালী জাতির জন্য, প্রজন্মের জন্য বড় অর্জন হচ্ছে তার বিজয়, জাতীয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে, লাখো লাখো মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জন করেছিল নতুন এক দেশ বাংলাদেশ। বিজয় অর্জনের পূর্ব থেকেই আজও এই ভূ-খ-ের মানুষ নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করে জাতিটি নিজস্ব ভূ-ম-লে নতুন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাত্রা করেছিল। সেই সব ইতিহাস আজ নানাভাবে বিকৃত। বাঙালীর ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার পথে পথে প্রতিবন্ধকতা বহুকাল হতেই। উনিশ শতকেই বঙ্কিমচন্দ্র হতাশার আলোকরেখায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, বাঙালীর ইতিহাস নেই। কেন নেই সে প্রসঙ্গও টেনেছেন তিনি। বাঙালী অন্ত্যজ, নিম্নবর্গ বলেই তার ইতিহাস উপেক্ষিত হয়েছে, এমনটা নয়। ইতিহাসের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে যারা সৃষ্টি করেন নয়া ইতিহাস, তাদের সেই সুকর্ম লিপিবদ্ধ না হলে ইতিহাসকে খুঁজে পেতে হয় ভিন্ন পথে। সৃজনশীলতা আর সৃষ্টিশীলতার সমগ্রতাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে আর যাই হোক সত্যিকারের ইতিহাসের সন্ধান মেলে না। বঙ্কিমচন্দ্র কোনদিন ইতিহাস লেখেননি। ইতিহাস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ চিন্তা তার কিছু প্রবন্ধে আছে; বেশি না। ইতিহাসের তথ্য বলে যা জানতেন, কিছু ঠিক জানতেন, কিছু ভুল। তবু, বঙ্কিম চিন্তায় ইতিহাসের বিশেষ স্থান ছিল। বঙ্কিম এক ধরনের ইতিহাস চেতনা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসের জ্ঞান এবং এই রকম ইতিহাস চেতনা পৃথক। জাতি তৈরি করতে গেলে জাতির ইতিহাস প্রয়োজন পড়ে। সেই ‘ইতিহাস’ ইতিহাসের বিচারে ইতিহাস না-ও হতে পারে। কিন্তু জাতি মাত্রেই নিজের এবং নিজস্ব ইতিহাসে বিশ্বাস করে। বাঙালী হয়েও যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা চায়নি, তাহলে সে নিঃসন্দেহে কুলাঙ্গার। বঙ্কিমচন্দ্র এমনই এক ইতিহাস চেতনার প্রবক্তা। ইতিহাস কাকে এবং কেন মনে রাখে, সে ইতিহাসই জানান দেয়। অবশ্য ইতিহাসের স্মরণশক্তি দুর্বল। মাঝে মধ্যে স্মৃতি বিভ্রমও ঘটে থাকে। অজন্তা ইলোরার শিল্পী বা তাজমহলের স্থপতির নাম ইতিহাস মনে রাখেনি। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান পুরুষের বেলায় এমন স্মৃতিভ্রংশ অবশ্য ঘটবে না। ইতিহাস যদি বঙ্গবন্ধুর কৃতকর্ম ভুলে যায়, তবে গোয়েবলসের তৎপরতায় তা হতে পারে সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেই ইচ্ছা হওয়ার নয়, যদি ইতিহাসের বিচারে প্রতিপন্ন হয় যে, বঙ্গবন্ধু প্রকৃত প্রস্তাবে সহস্র বছরের আরাধ্য যুগপুরুষ ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে পরাধীন, হতশ্রী, ভাগ্যবিড়ম্বিত একটি জাতির উত্থান ঘটেছিল। তাঁর কাজে যুগের প্রগতি ও পরিবর্তন ঘটেছিল। শুধু এই এক ধরনের চরিত্রকেই ইতিহাস বড় রকমের মনে রাখে। অবশ্য ইতিহাসের ভাল-মন্দ জ্ঞান নেই। মানুষের বিশেষ দুর্গতি ঘটাতে পারলেও ইতিহাস তা মনে রাখে। অর্থাৎ কি না সামাজিক মানুষের জীবনে যিনি বড় আকারের ছাপ ফেলেন, ইতিহাসে সেই মানুষ অমর। মূলত জনতার ইতিহাসটাই ইতিহাস। নায়কচরিত্রের পশ্চাদ্বাবন ইতিহাসবিদের অকর্তব্য। এই বক্তব্যে জনতা ও নায়কের মধ্যে অকারণ বিরোধ কল্পনা করা হয়। যুগপুরুষ সেই মানব, যার মধ্যে সমসাময়িক সমাজের প্রতিফলন থাকে। সমাজের বহু মানুষের অস্ফুট বক্তব্য পরিষ্কার করে তুলে ধরার দায়িত্ব এই যুগ মানবের ওপর বর্তায়। আবার তাদের কাজে সমাজের বিশেষ পরিবর্তনের ধারা জোর পায়। অবশ্য এটা ঠিক, সমাজবিরোধী শক্তিশালী দুর্বৃত্তকেও ইতিহাস মনে রাখে। আইখম্যান, হিটলার, ইয়াহিয়া, গোলাম আযম, মুশতাকের নাম মুছে যাবার নয়। যদিও সমাজের বহুসংখ্যক মানুষ মেনে না নিলে এই অপনায়ক চরিত্রেরও সৃষ্টি হয় না। মহামানবদের কথা ভাবলে স্পষ্ট হয়, ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা বিভিন্নরকম। বঙ্গবন্ধু, লেনিন, গান্ধী, মাওসেতুং, ফিদেল ক্যাস্ট্রো একইরকম কাজ করেননি। তাঁদের মধ্যে স্তরভেদও রয়েছে। বাঙালীর ভাষায় বাঙালী সমাজকে সংহত নতুন এক জীবন-দর্শন বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার স্বাদ একটি জাতির মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন। বাঙালীর ইতিহাসে যা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিপন্ন। ইতিহাসে বিচার শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, এই কথাগুলো ইতোমধ্যেই প্রমাণিত যে‘ যতদিন বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ নামক ভূ-খ-টি অক্ষয় থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর চূড়ায় অবস্থান নিয়েই থাকবেন। ইতিহাসের শেখ মুজিব থাকবেন তাঁর পার্শ্বসহচরদের নিয়ে। কিন্তু যাঁরা ছিলেন তাঁর অনুসারি কিংবা তাঁর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত এবং যাঁরা এখনও জীবিত, তাদের কাছ থেকে ইতিহাসের উপদানগুলো পাওয়া যায়নি। এই না পাওয়ার কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা বা উপেক্ষা নয়। সময়ের দলিলপত্র নথি, ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ রাখতে না পারা কিংবা জেলজুলুম, অত্যাচার নিপীড়নে পর্যুদস্ত হয়ে হয়তো এর প্রয়োজন বা গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর আলোয় আলোকিত হয়েছেন যাঁরা, তাঁরাও সচেষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধুর মতো কীর্তিমান পুরুষের কথা তুলে ধরতে। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেছেন, কিংবা পরিশীলিতভাবে চর্চা করেছেন, এমনটাও নয়। বঙ্গবন্ধু গোটা দেশ, তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ নিয়ে যে ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন, সহচর বা অনুসারীরা তার সবটুকু উপলব্ধি বা ধারণ করতে পেরেছেন, এমনটা মনে হয় না। যদি পারতেন, তবে স্বাধীনতা পূর্ববর্র্তী সময়ে যা পেরেছেন, পরবর্তী সময়েও তারা পারতেন। বঙ্গবন্ধু বিরোধী অপপ্রচার, মিথ্যাচার তাহলে প্রশ্রয় পেত না। এমনকি হতে পারত না স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে যে হীনভাবে উপস্থাপনের অপতৎপরতা চলেছিল, তার সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল সহচর, অনুসারীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। তারা সমসময়ের সত্যকে তুলে ধরতে পারেননি বা তুলে ধরার চেষ্টা করেননি। অপপ্রচারের মাত্রা ছিল সীমাহীন। সেই মিথ্যার বেসাতির ধারায় আজকেও সমানে চলছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ শহীদদের নিয়ে মিথ্যাচার। সেই এক অন্ধকার যুগ এসেছিল এই বাংলাদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে। জান্তা শাসকরা ইতিহাসই পাল্টে দিতে চেয়েছিল। যুদ্ধজয়ী মানুষকে দমন করে দেশকে যুদ্ধপূর্ব স্থানে ফিরিয়ে নেয়ার যে তৎপরতা শুরু হয়েছিল তা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। ইয়াহিয়া খানের মতো এরাও উচ্চারণ করত বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম মূল্যায়নে স্পষ্ট হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে, বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন, থাকবেন। এসব মিথ্যাচার ইতিহাস গ্রহণ করেনি। করবেও না। কিন্তু মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বিভ্রান্তকে দূর করার কাজটি যাদের, তারা সেই পথে হাঁটেননি। আসলে দেশ যদি প্রস্তুত না থাকে, তাহলে তিনি যত বড় মহান নেতা; তাঁকে তত বেশি অপদস্থ হতে হয়। অথচ ইতিহাসের তাগিদে তাঁদের জন্ম। বড় মাপের মানুষের আবির্ভাবকে ঐতিহাসিক কারণসম্ভূত হিসেবে মনে করা হয়। কোন দেশের মহান নেতা ভূঁইফোড় নন। মাটি থেকে হঠাৎ গজিয়ে ওঠেন না। আকাশ থেকেও ধপাস করে পড়েন না। বঙ্গবন্ধুর মতো মানবের যখন জন্ম হয়, তখন ধরে নিতে হবে যে, জাতির জীবনে এমন কোন চেতনা এসেছিল, তার তাগিদে এমন মানুষের জন্ম সম্ভব হয়েছিল। দেশ ও জাতি তাঁর আগমনের জন্য হয়ত প্রস্তুত হয়েই ছিল। বঙ্গবন্ধু যা করেছেন, তাতে তাঁর নিজের কৃতিত্ব যতখানি, সে তুলনায় দেশের কৃতিত্ব যৎসামান্য। কোন মানুষের একক সাধনায় যে জিনিস সিদ্ধ হয়, দেশ তাকে গ্রহণ করলেও রক্ষা করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু জাতির জীবনে একটা চেতনার সঞ্চার করেছিলেন, বাঙালী জাতি ও তার স্বাধীন রাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠন। বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব জাতীয় চেতনার ফল বলেই নিহত হওয়ার চল্লিশ বছর পরও তাঁর দেশ এবং দল অবিচল রয়েছে হাজারো ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, পরাজিত শক্তির আস্ফালন উপেক্ষা করে, সকল নাশকতা উৎপাটন করে। প্রকৃতির স্বভাবে একটা বেহিসাবী উড়নচ-ী ভাব রয়েছে- এই যে গাছপালা, লতাপাতা, ফুলফল যা দেখছি তার শতগুণ ঝরে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে। শক্তির কি অজস্রতা এবং কি তার অপচয়! ইতিহাসেও তাই ঘটে। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথসদৃশ মানুষের উদ্ভব বেহিসেবী প্রাকৃতিক ফেনোমেননের মতো। আমাদের জাতীয় চেতনার ফলে যদি তাদের উদ্ভব হতো, তা হলে তাদের জীবন বাঙালীর জীবনে এতখানি ব্যর্থ হতো না। বাঙালীর যোগ্যতার তুলনায় পাওনাটা এত বেশি হয়ে গিয়েছে যে, তাকে বাঙালী কোন কাজেই লাগাতে পারেনি। এটা ইতিহাসের অপচয় ছাড়া আর কি? মানুষ অভাবের তাড়নায় মরিয়া হলে তবে চেনা পথ ছেড়ে অচেনা পথে চলতে শেখে। ভাষার মাসের এই দিনে এতসব কথার অবতারণা প্রবীণ রাজনীতিকদের নিজেদের স্মৃতিচারণ ও জীবন সংগ্রাম কাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের প্রসঙ্গকে সামনে রেখে। এটা তো সত্য এবং বাস্তব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্যাগের তুলনায় প্রকাশ কম। তাই তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার বিষয়টি তরুণ প্রজন্ম অবহিত নয়। ইতিহাসের অনেক সত্যই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাপা পড়ে গেছে। কারণ যাঁরা ছিলেন জড়িত, তাঁরা কেউই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য থেকে শুরু করে তাদের সংগ্রামের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরেননি। ফলে মিথ্যার বেসাতি মাথাচাড়া দিয়েছে সর্বত্র। শেখ হাসিনা নিজে লিখেন বলেই বুঝতে পারেন, ইতিহাসের সত্য লুকিয়ে আছে প্রতিটি মানুষের জীবনজুড়েই। সেই সব ঘটনার স্মৃতিচারণার মধ্যে লুক্কায়িত রয়েছে ব্যক্তি মানুষ থেকে সামগ্রিক জনগণের কীর্তি ও সংগ্রাম। বাঙালীর সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর একটা বড় অংশ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যে কারণে মিথ্যাচার স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তেমন কিছু লেখেননি। অনেকেই আজ প্রয়াত। ইতিহাসের দিনগুলো তাদের সঙ্গেই যেন সমাধিস্থ হয়ে গেছে। স্মৃতিচারণ হিসেবে জীবন ও কর্ম লিপিবদ্ধ না করায় অনেক নেতা এবং অনেক মূল্যবান ঘটনা বিস্তৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে। যথার্থই বলেছেন লেখক-রাজনীতিক শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগে অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ রয়েছেন, তারা দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। জীবনে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁদের আন্দোলন সংগ্রাম সব অজানাই রয়ে গেছে। তাঁদের ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা এলেও তা প্রচার পায়নি। জীবিত প্রত্যেকে যদি তাঁদের জীবনের কথা লিখে রাখেন, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের অনেক কিছু আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাতেই হয় এ জন্য। এমনিতেই একালেও আওয়ামী লীগ নেতাদের পাঠাভ্যাস কম। সংবাদপত্র আগেও যা পাঠ করার চর্চা ছিল, তা-ও হ্রাস পেয়েছে স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে। দর্শক থেকে টিভির বক্তায় পরিণত হয়েছেন অনেকই। কিন্তু আলোচনার টেবিলে তারা তথ্য-উপাত্ত তেমন পরিবেশন করতে পারেন না। শেখ হাসিনা গ্রন্থ রচনার পরামর্শ দিলেও তা হয়ে উঠবে কিনা জানি না। তবে হওয়া উচিত। অনুলেখনের যুগে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচনা দুরূহ নয়। জেল জুলুম হুলিয়ার কারণে বা ঘরবাড়ি হানাদারের অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হওয়ার কারণে অনেকের দলিলদস্তাবেজ আর নেই। তথাপি আওয়ামী লীগ নামক দলটি তো নিজেরাই পারে অনুলেখক নিয়োগ করে প্রবীণ নেতাদের স্মৃতিচারণ লিপিবদ্ধ করতে। একই সঙ্গে ভিডিও করা যায়। আর এ কাজটি কঠিন কিছু নয়। অবশ্য যে দল তার আদর্শ অনুসারী জনদের উপেক্ষা করে ভিন্ন দল থেকে আগতকে দিয়ে দলের দলিলপত্র সম্পাদন করায় এবং ’৭২-৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে সিদ্ধহস্তদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর জীবনী রচনায়, তখন স্পষ্ট হয় যে, আসলেই সত্যি সত্যি দলটি তার ইতিহাস রচনা নিজেও করতে পারে না যোগ্যলোকের অভাবে? দলটির উচিত এখনই বিশেষ সেল গঠন করে ইতিহাসের সব পাতায় সন্নিবেশিত হতে পারে এমন তথ্য-উপাত্ত রচনার পথ তৈরি করা। শেখ হাসিনার আহ্বান যেন বৃথা না যায়- সেই প্রত্যাশা।
×