ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির- স্লোগানে সূচনা হলো উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির- স্লোগানে সূচনা হলো উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ কবিতা কখনও কাউকে ফেরায় না। কাব্যবীজের স্ফুরণ প্রেরণা যোগায় সামনের পথে এগিয়ে চলার। সত্য ও সত্তাকে একই সঙ্গে প্রকাশ করে কবিতা। শব্দের পিঠে শব্দের সংযোজনে উচ্চারিত হয় নানা বিষয়। সে শব্দমালায় থাকে দ্রোহ, প্রেম, মানবতার কথা ও সময়ের দিনলিপি। তাই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে হাতিয়ার হয়েছে কবিতা। আবার কখনও সময়ের প্রযোজনে কবিতা হয়ে ছড়ায় শান্তির বারতা। তাই ভাল লাগার সঙ্গে সময়ের দাবিও ধ্বনিত হয় কবিতায়। আর চলমান সময়ের সেই সোচ্চার দাবি নিয়ে শুরু হলো জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৬। কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির সেøাগানে সোমবার উৎসবের সূচনা হলো। দিনভর কবির বলা কথায় কিংবা কবিতার আশ্রয়ে উচ্চারিত হলো মানবতার জয়গান। আর মানবতার সেই সহমর্মিতা থেকে উদ্বোধনী আয়োজনে বরেণ্য কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা চাওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে শীতের রোদেলা সকালে বসে মানবতার জয়গানে উদ্দীপ্ত দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে প্রথম এ উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। এবারের ৩০তম উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি ও ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেনকে। দুই দিনের উৎসবে বাংলাদেশের খ্যাতিমান এবং নবীন-প্রবীণ কবিদের সঙ্গে অংশ নিচ্ছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের সাত দেশের কবি ও লেখকবৃন্দ। রয়েছে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বরচিত কবিতা পড়ার অবারিত সুযোগ। উদ্বোধনী দিনে অনুষ্ঠিত হলো ছয়টি অধিবেশন। দিনব্যাপী বিভিন্ন পর্বে কবিরা পাঠ করেছেন কবিতা। অংশ নিয়েছেন কবিতার সঙ্গে শান্তি ও মৈত্রীর সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায়। নবীন কবিরা নিবন্ধনের মাধ্যমে কবিতা পাঠ করে নজর কেড়েছেন কবিতাপ্রেমীদের। এছাড়া আয়োজনে ছিল কবিতার গান, অন্য ভাষায় কবিতার উপস্থাপনায় অংশ নিয়েছেন আদিবাসী কবিগণ, খ্যাতিমান বাকশিল্পীরা অংশ কবিতা আবৃত্তি পর্বে, হয়েছে সেমিনার ও প্রদর্শনী। সব মিলিয়ে কবিতা নিয়ে এ যেন এক বহুমাত্রিক আয়োজন। সকাল থেকে রাত অবধি খ্যাতিমান কবিসহ নানা বয়সী কবিতাপ্রেমীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল দারুণ সরব। সকাল সাড়ে নয়টায় শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। গ্রন্থাগার চত্বর থেকে বের হয় শোভাযাত্রা। পদব্রজে শোভাযাত্রাটি গিয়ে থামে চারুকলা সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিসৌধে। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানের সমাধিতে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় ভাষা শহীদদের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক। সকাল সোয়া ১০টার পর শুরু হয় উৎসব উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। শুরুতেই বিভিন্ন সংগঠনে শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেই সুরের তালে তালে উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা ও কবিতা পরিষদের পতাকা। উত্তোলন করেন উৎসব উদ্বোধক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। এরপর সারি বেঁধে শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং মুহাম্মদ সামাদ রচিত ও ফকির আলমীরের সুরারোপিত উৎসব সঙ্গীত ‘কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির...কবিতায় জেগে ওঠে মানুষের উন্নত শির’। গান শেষে বিগত বছরের শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্প-সাহিত্যসহ নানা অঙ্গনের প্রয়াত কৃতীদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান। শোকগাথায় উচ্চারিত হয় ভাস্কর নভেরা আহমেদ, সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, গীতিকবি গোবিন্দ হালদার ও নয়ীম গওহর, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলনসহ অনেক কীর্তিমানের নাম। ত্রিশতম উৎসব উদ্বোধন করেন বাংলার ভাষার অন্যতম কবি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আহ্বায়কের বক্তব্য রাখেন রবিউল হুসাইন। যুগ্ম আহ্বায়কের ভাষণ দেন কাজী রোজী। এছাড়া উদ্বোধনী আলোচনায় বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ। উদ্বোধকের ভাষণে সৈয়দ হক বলেন, ‘কবিতা স্বপ্ন চেতনা ও প্রত্যয়ের কথা বলে। যখন সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন কবিরাই হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। অনেক বলতে পারেন কবিতার সঙ্গে সংগ্রামের কী সম্পর্ক? আমি বলব, কবিতার সঙ্গে সংগ্রামের সম্পর্ক আছে, কারণ কবিতা মানবতার কথা বলে। মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হলে কবিদের ভূমিকা রাখতে হয়।’ উদ্বোধকের বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, কবিতা স্বপ্ন, চেতনা ও প্রত্যয়ের কথা বলে। তবে যখন সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন কবিরাই হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। অনেকে বলতে পারেন কবিতার সঙ্গে সংগ্রামের কী সম্পর্ক? আমি বলব, কবিতার সঙ্গে সংগ্রামের সম্পর্ক আছে, কারণ কবিতা মানবতার কথা বলে। মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হলে কবিদের ভূমিকা রাখতে হয়। এ কারণেই কবিতার ডাকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কবিরা উপস্থিত হয়েছেন এ উৎসবে। কবিতার টানে বাংলাদেশসহ আট দেশের কবিবৃন্দ শামিল হয়েছেন কবিতাকেন্দ্রিক এ আয়োজনে। কবিতা ও উৎসব প্রসঙ্গে সৈয়দ হক বলেন, আজ প্রচুর প্রাণশক্তি নিয়ে বহু তরুণ কবিরা রচনায় নিমগ্ন হয়েছে। আজ (সোমবার) গ্রন্থমেলা শুরু হচ্ছে। মাসব্যাপী এই মেলায় কমপক্ষে ২০০ থেকে আড়াই শ’ নতুন কবির কবিতার বই বেরুবে। এই উৎসব যতটা না কবিতার জন্য তার চেয়ে বেশি কবিতার সঙ্গে রাষ্ট্রের, কবিতার সঙ্গে মানুষের, কবিতার সঙ্গে সময়ের একটি আদর্শিক সম্পর্ক নির্ণয় করে। আমরা কবিতার টানে কবিতার ডাকে এখানে এসেছি। এই উৎসব এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন দেশের কবিরা অংশ নিচ্ছেন এ আয়োজনে। এভাবেই গৌরবের অবস্থানে পৌঁছেছে জাতীয় কবিতা উৎসব। আমরা দেখতে পাচ্ছি যেন শান্তির পারাবাত নীলাকাশে উড়ছে। শুধু বাৎসরিক এই উৎসব নয়, কবিতার মান্নোনয়নে কাজ করবে কবিতা পরিষদ। তিনি একটি ষান্মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক কবিতার পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। উদ্বোধনী পর্ব শেষে অনুবাদক ফকরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ‘পোয়েট্রি ফর ফ্রেন্ডশিপ, পোয়েট্রি ফর পিস’ শীর্ষক আলোচনা। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত, সুইডেন, নরওয়ে, সেøাভাকিয়া, মরক্কো, তাইওয়ান ও নেপাল থেকে আমন্ত্রিত কবি- লেখক ও প্রতিনিধিবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রাবন্ধিক শংকরলাল ভট্টাচার্য, সুইডেনের তিন কবি র্ল্সা হেগার, বেনত্্ বার্গ ও লত্তে সেদেরহোলম, নরওয়ের এরলিং কিতেনসেন, সেøাভাকিয়ার মিলান রিচার, মরক্কোর বেনাইসা বোমালা, তাইওয়ানের ড. ফঅং ইয়া-চীন ও নেপালের পক্ষে ঢাকাস্থ নেপালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত সুশীল কুমার লামসাল।
×