ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইতোমধ্যেই বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী;###;গত সাড়ে ৪ দশকে ২২ হাজার কিমি নদীপথ শুকিয়ে গেছে

’৫০ সালের মধ্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা ॥ বিলুপ্ত হবে নদীপথ

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

’৫০ সালের মধ্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা ॥ বিলুপ্ত হবে নদীপথ

শাহীন রহমান ॥ পর্যাপ্ত পানি বা প্রবাহ না থাকায় বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কাগজে-কলমে দেশে ৩১০টি নদীর অস্তিত্ব থাকলেও প্রায় ১শ’ নদীতে বছরের বেশিরভাব সময়ই পানি থাকে না। এর মধ্যে অনেক নদী ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক নদীতে বর্ষা মৌসুমে প্রবাহ কিছু থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী বলে মনে হয় না। নদীতে চলে নানা ধরনের চাষাবাদ। নদী বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী গত ৪৪ বছরে দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশে কোন নদী পথের অস্তিত্বই থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র ফারাক্কার প্রভাবেই পদ্মা নদীর অনেক শাখা নদী বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া তিস্তায় পানি না থকায় উত্তরাঞ্চলের ছোট-বড় ৩৩ নদী ভরাট হয়ে গেছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মা-যমুনার পানি কমে অনেক স্থানেই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। যমুনার বুকে জেগে উঠেছে শত শত চর। এ কারণেই উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মরুভূমিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। নদীতে পানি না থাকায় ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্ত পানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রতিবছর আশঙ্কাজনকহারে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুধু ফারাক্কার প্রভাবই নয়, উজানে বিভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া, প্রতিবছর বর্ষায় বিলিয়ন টন পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণেও ভরাট হয়ে প্রবাহশূন্য হয়ে পড়ছে নদীগুলো। স্বাধীনতার পর গত তিন দশকের বেশি সময়ে নদীগুলো বেশি করুণ অবস্থার শিকার হয়েছে। তবে মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণেই নদীগুলো এত তাড়াতাড়ি মরতে বসেছে। এছাড়া নদীতে প্রতিবছর এত পরিমাণ পলি জমছে যে তা পানির অভাবে বহন করে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটারের তিস্তার অববাহিকায় নদী ভিত্তিক জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। মুখ থুবরে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ এ প্রকল্পের। এর আওতাধীন ৬ হাজার ৫শ’ হেক্টর বোরো চাষের জন্য নেই কোন পানি। তিস্তায় পানি না থাকায় এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, অখিরা, দুধকুমার, বুড়িতিস্তাসহ ছোট-বড় প্রায় ৩৩ নদী ভরাট হয়ে গেছে। এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মায়ও এখন ধুধু বালুচর। খরস্রোতা করতোয়ার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মায় পানি না থাকাতে শুধু পাবনা জেলাতেই শুকিয়ে গেছে ২০ নদী। এসবের মধ্যে কিছু কিছৃু নদী একেবারে বিলীন হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম নিয়েছেন। পদ্মার পাশাপাশি পানি না থাকায় যমুনার বুকে জেগে উঠেছে শত শত ডুবোচর। পদ্মা-যমুনায় পানির প্রবাহ না থাকায় এককালের সিরাজগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শাখা নদী করতোয়া, ইছামতি, বাঙালী নদী, ফুলজোড়, দইভাঙ্গা, হুরাসাগর ও বড়াল শুকিয়ে আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। কুড়িগ্রামের ১৬টির মধ্যে ১০টি নদীই শুকিয়ে গেছে। বাকি নদীগুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদীতে বিশাল চর জেগে সেচ সুবিধা হুমকির মুখে পড়েছে। তিস্তায় পানি না থাকায় বগুড়ার অসংখ্য খাল, বিল পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক নদী। জয়পুরহাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চারটি নদীই এখন ভরাটের সম্মুখীন। নওগাঁর এক সময়ে খরস্রোতা আত্রাই এখন মৃতপ্রায়। ঠাকুরগাঁও জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৪টি নদীর মধ্যে ১১টি নদী এখন মৃত। পানির অভাবে এসব নদী শুকয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। টাঙ্গর, নাগর, কুলিক ও তীরন নদীর মাঝখান দিয়ে নালার মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মায় পানি না থাকায় শুধু পাবনা জেলাতেই শুকিয়ে গেছে ২০টি নদী। এর মধে ছয়টি নদী বিলীন হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া এসব নদীর মধ্যে রয়েছে কমলা, শাসসাডাঙ্গী, ইছামতি করতোয়া, ভাঙ্গুরা, রতœবাড়ি, টেপাবাড়ি নদী। অস্তিত্ব সঙ্কটে ঐতিহাসিক চলনবিল। একই কারণে আজ হুমকির সম্মুখীন কুষ্টিয়ায় অবস্থিত অন্যতম সেচ প্রকল্প জিকে প্রজেক্টের। একের পর এক উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদীই এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি নদী ও খাল বিল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ইরিবোরো চাষ ব্যহত হচ্ছে। এছাড়া মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী, পুরাতন ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, ইছামতি ও কান্তাইপতি নদী আজ মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এসব নদী বছরের অধিকাংশ সময় পানিশূন্য থাকে। উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় শুকিয়ে গেছে ফেনী নদী। হুমকির মুখে পড়েছে ফেনীর প্রায় তিনশত কোটি টাকা ব্যয়ে মুহুরী সেচ প্রকল্প। পানির প্রবাহ না থাকায় খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা, যশোরের মুক্তেশ্বরী ও হরিহর নদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণায় ইনস্টিটিউটের জরিপের হিসাব অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১৯টি নদীর পানিই শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুম আসার আগে এ অবস্থা চলতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরের দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নামকাওয়াস্তে টিকে রয়েছে বড় বড় অনেক নদীপথ। আর ছোট-ছোট বহু শাখা নদী এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। তারা বলছেন, নদ-নদীর এই অপমৃত্যুর কারণে বাড়ছে নদীভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস, কমছে আবাদী জমি, বাড়ছে জলাবদ্ধতা। নদীভিত্তিক অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এতে করে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়। বাস্তুহারা ও অভিবাসী হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে আগামী ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে উপকূলীয় ১২টি জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হয়ে যেতে পারে। বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও নদী গবেষক ড. এসআই বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম জরিপে নদীপথ ছিল ৩৭ হাজার কিলোমিটার যা ২০০২ সালে কমে ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে আসে। ২০১০ সালে কমে আসে ৪ হাজার কিলোমিটারে। আর শুষ্ক মৌসুমে দেশের নদীপথ নেমে এসেছে মাত্র দুই হাজার ৬০০ কিলোমিটারে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালে দেশে কোন নদীপথ অবশিষ্ট থাকবে কী না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। জালের মতো বিছিয়ে থাকা এদেশে অতীতে হাজারের বেশি নদী থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বর্তমানে দেশে নদীর সংখ্যা এখন ৩১০টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৩১০টি নদীর মধ্যে এখন প্রায় ১শ’ নদী বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে। এসব নদীতে বছরে ৮ মাস পানি থাকছে না। ফলে সারা বছরই চাষাবাদ চলে। শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমৌ এসব নদীতে প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। অন্য সময় শুষ্ক থাকছে। পলি পড়ার কারণে বর্তমানে অনেক নদী ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এ জন্য ফারাক্কাসহ ভারতের নদী আগ্রাসন অনেকাংশে অবশ্যই দায়ী। তবে দেশের জনগণও কম দায়ী নয়। প্রভাবশালীরাও অনেক নদী ভরাট করে দিচ্ছে। দেশের নদী ব্যবস্থাপনার সমস্যা শুধু টেকনিক্যাল সমস্যা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। ভারত, চীন, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে রাজনৈকি সম্পর্কের উন্নয়ন করে সুষ্ঠু পানি বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে দেশের জনগণকেও নদীবান্ধব মানসিকতা সম্পন্ন হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে বড় বড় যেসব নদীর প্রবাহ এখনও কিছুটা ঠিক রয়েছে। এনব নদীতেও জমছে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে পলি। তাদের মতে যমুনা, পদ্মা এবং গঙ্গা নদীতে পলির পরিমাণ অত্যন্ত বিপুল। মাওয়াতে পদ্মা নদী দিয়ে বছরে সর্বনিম্ন ১ থেকে দেড় মিলিয়ন টন পলি প্রবাহিত হয়। এভাবে পলি বৃদ্ধির কারণে নৌপথ দিন দিন কমে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর কোন নদীই তার ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। রাখা সম্ভবও নয়। শুস্ক মৌসুমে নদীতে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা থাকলে বর্ষায় আবার এক হয়ে এই ভৌগোলিক সীমারেখা। এ কারণেই হিমালয়ের ৭ হাজার মিটার মিটার উচ্চতা থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপূত্র, বারাক উপত্যকার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্র পৌঁছে যাচ্ছে। ভারত থেকে আসা অভিন্ন ৫৪টি নদী প্রবাহের উপর বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য উজানে পানি প্রাপ্তির উপর নির্ভরশীল। বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ বলেন, নদীর পানি প্রবাহের এই পথে বয়ে আনছে টন টন পলি। ত্বরান্বিত হচ্ছে বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া। যা আদিতে ছিল। বর্তমানে আব্যাহত রয়েছে। এ প্রক্রিয়া আগামীতেও চালু থাকবে। কারণ বাংলাদেশের নদী উজান থেকে এর ৯২ ভাগ, অভ্যন্তরীণ থেকে ৮ ভাগ পানি সমুদ্রে নিষ্কাশন করে। এর সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসে ১.৪ বিলিয়ন টন পলি। তাই অনেকে একে পানি ও পলি প্রবাহের করিডর উল্লেখ থাকে। তিনি বলেন, পলি ছাড়া প্রাকৃতিক সৃষ্ট নানা কারণ মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও নদীর দুরবস্থার শিকার হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্র নামে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় নদী নালার পাশাপাশি আজ খাল, বিল, জলা, পুকুর, ডেবাশয় পানিশূন্য হয়ে পড়ে জীবন জীবিকা ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। পৃথিবীর কোন নদীই প্রাকৃতিক অবস্থায় একই অভিন্ন চরিত্র অনুসরণ করে না। চর পড়বে, নদীখাত পরিবর্তন হবে, নদী ভাঙবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে নদী ড্রেজিং করা না হলে নদী ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।
×