ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

মাঘের তৃতীয় সপ্তাহও চলে যেতে বসেছে, তবু সেভাবে শীতই পড়ল না এবার ঢাকায়। শীত বরং গোল্লাছুট খেলেছে মহানগরবাসীর সঙ্গে। একদিন শুধু গভীর রাতে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল দশ ডিগ্রিতে। সপ্তাহের বাকি কয়টা দিন চৌদ্দর ওপরে। এটাকে অস্বাভাবিক ওঠানামা বলা অসংগত নয়। এর যে ধকল রয়েছে সেটা সহ্য করতে পারে না শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। ফলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তবে ফাল্গুন আসার আগে একটু-আধটু তার মিঠে পরশ পেলে বেরসিকের মনেও গুনগুনিয়ে ওঠে গান। দেখা যাক শেষ ক’টা দিন মাঘ আমাদের কী উপহার দেয়। ভাষার মাসে ভালবাসা ভাষার মাসের সূচনাই হয় ভাষার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। প্রথমত আয়োজিত হয় মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তাতে বাংলা ভাষায় রচিত হাজারে হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়ত ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা কবিদের সৃষ্টিসুখের উৎসব হয়, অর্থাৎ আয়োজিত হয় কবিতা উৎসবের। ভাষার প্রতি ভালবাসা জানানোর এ এক অনন্য প্রক্রিয়া। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাসই নয়, মাসটি মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসে। বাঙালীর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেজন্য বিশেষ গৌরব করার কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নোতে মাতৃভূমির অকুতোভয় সন্তানরা আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন, সে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় ব্যর্থ হলে পরম গৌরবময় সেই আত্মদান বৃথা যাবে। তাই ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য, মান এবং সৌন্দর্য যাতে অক্ষুণœ থাকে সে লক্ষ্যে সক্রিয় থাকা। মাতৃভাষা সহজাতভাবেই মানুষ আয়ত্ত করে থাকে বটে, যদিও তার চর্চা বা প্রয়োগে সচেতন না হলে সে ভাষার সুস্থতা ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। ভাষা ব্যবহারে হেলাফেলা ও অসতর্কতার কারণে রুদ্ধ ও দূষিত হয়ে উঠতে পারে প্রাণের ভাষাÑ এটা মনে রাখা কর্তব্য। ভাষার মাস তাই ভাষার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতার মাসও। ভাষার মাসে বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা জাগিয়ে তোলা এবং ভাষা-সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে শুরু করা এবং বছরভর তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নবীন-তরুণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, আকাক্সক্ষা আর স্বপ্নের আদানপ্রদান মাতৃভাষার মাধ্যমেই সবচেয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারে। আর এটাও অনস্বীকার্য যে ভাষার প্রতি ভালবাসা লালনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভাষাভাষী মানুষের প্রতি প্রেম ও মমতা তৈরি হয়, যা সুখে-দুখে দুর্যোগে-সুযোগে একে অন্যকে পাশে রাখে। আশঙ্কার বিষয় হলো বাংলা ভাষায় ইংরেজীর প্রবল অনুপ্রবেশ ঘটছে। এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরী; লক্ষ্য রাখতে হবে পরিচর্যার অভাবে যেন বাংলা ভাষা রুগ্ন না হয়ে যায়। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক ঘটনা। ভাষার মাসজুড়ে জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে একাডেমি প্রাঙ্গণ ও অধুনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত হয়ে থাকে প্রাণের বইমেলা। লেখক-পাঠকদের প্রকৃত মিলনমেলায় পরিণত হয় মেলাটি। উদ্যাপিত হয় নতুন বইয়ের মহোৎসব হিসেবে। বছরের আর কোন সময়ে বাংলা ভাষায় এত বিপুলসংখ্যক বই প্রকাশিত হয় না। সেদিক দিয়ে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে হাজারো বইয়ের জন্ম মাস হিসেবেও অভিহিত করা চলে। এবারের বইমেলা চলাকালীন আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর আয়োজিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, যেটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিন, ভারতসহ বেশ ক’টি দেশ ও ভাষার প্রায় পঞ্চাশজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। এবার যোগ দিচ্ছেন সেøাভাকিয়া, মরক্কো, সুইডেন, ইংল্যান্ড, ভারতসহ কয়েকটি দেশের কবিরা। গত বছরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গতবার ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকেই টানা তিন দিনের হরতাল আহ্বান করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। জনমনে প্রশ্ন জেগেছিল ভাষার মাসের সূচনাতেই যারা দেশবাসীর ওপর এমন অপরিণামদর্শী কর্মসূচী চাপিয়ে দেয় তাদের ভেতর কি ভাষাপ্রেম-দেশপ্রেম অনুপস্থিত? বছরের এই একটি মাসের জন্য লেখক-পাঠক-পুস্তক ব্যবসায়ীরা আগ্রহভরে প্রতীক্ষায় থাকেন। ভাষার প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ এবং ভাষাকেন্দ্রিক সৃষ্টিশীল কর্মকা-ের প্রাণোচ্ছলতা ঝুঁকি, শঙ্কা বা কোন ধরনের নাশকতায় যেন স্তিমিত না হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে সারা দেশ থেকেই মানুষ আসে বইমেলায়। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন বইমেলায় না গিয়ে পারেন না বহু বইপ্রেমী মানুষ। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে- বইমেলার শুরুর দিনেই বহু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাধিক নতুন বই নিয়ে এবারও উপস্থিত হয়েছে। নবপর্যায়ে নবসাজে বইমেলা আর নতুন বইয়ের গন্ধ- দুয়ে মিলে দারুণ এক খুশি। এবার বইমেলার পরিসর প্রায় তিনগুণ বাড়ায় পাঠকের পক্ষে সুবিধে হবে বইয়ের দুয়েক পৃষ্ঠা পড়ে দেখেশুনে যাচাই করে পছন্দের বইটি কেনার। বিগত তিন বছর ধরে একাডেমি প্রাঙ্গণের বাইরে বইমেলা সম্প্রসারিত হওয়ায়, কিংবা স্পষ্ট করে বললে মূল বইমেলাটি সোহরাওয়ার্দীর সুপরিসর এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সুবাদেই বড় বড় প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ মিলেছে। অনেকটা স্পেস পাওয়ায় ঠেলাঠেলি গাদাগাদি হাঁসফাঁস অবস্থা থাকছে না। ভাষার মাসের পয়লা দিন বইমেলায় গেলে তার একেবারে কাছেই জমজমাট জাতীয় কবিতা উৎসবে কে না যাবেন! দেখতে দেখতে তিন দশক হয়ে গেল। আহা আমাদেরও বয়স বাড়ল তিন দশক। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছিল জাতীয় কবিতা পরিষদ। সে উৎসবের পরিচালনা কমিটির সর্বকনিষ্ঠ তরুণটি আজ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। কবি তারিক সুজাতের কথা বলছি। দ্বিতীয় বছর (১৯৮৮) উৎসবের দ্বিতীয় দিনে পটুয়া কামরুল হাসান উৎসব প্রাঙ্গণেই ঢলে পড়েছিলেন। তার ওই প্রস্থান ছিল বীরোচিত। মৃত্যুর আগে আঁকা শিল্পগুরু কামরুলের ব্যঙ্গচিত্র- ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ রাতারাতি পোস্টার হয়ে গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে সেদিনের সেই নবীন কবি তারিক সুজাতের উদ্যোগে। মনের ভেতর জিজ্ঞাসার উঁকিঝুঁকি দেখি। আজও কি এই উৎসব তার দায়টুকু ঠিকঠিক অনুধাবন করতে পারছে? গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে বইমেলা প্রাঙ্গণের কাছে নিহত হন তরুণ মুক্তচিন্তাবিদ অভিজিত রায়। তারপর সারা বছরই একের পর এক আক্রমণ শাণানো হয়েছে ব্লগার তথা লেখক ও প্রকাশকদের ওপর। তাই কবিতা উৎসবে ওই দিকটি উচ্চকিত হয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা স্বাভাবিক। উৎসবের মূল সেøাগান জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে এবং মুক্তমতের লেখকদের স্বপক্ষে হতে পারত। এবারের সেøাগান- কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির। ডিজিটালে বাংলা বই ভাষার মাস আসার আগে জানুয়ারির শেষ পক্ষে বইয়ের ডিজিটাল রূপের প্রয়াসের দুটি আয়োজন ঢাকার পুস্তকপ্রেমীদের কৌতূহল জাগিয়েছে। বইমেলায় গিয়ে ছাপানো বই মিলবে। আর ঘরে বসে পড়া যাবে ইবুক। ই-বইয়ের পাঠক হওয়ার প্রাথমিক ধারণাটি আসে বব ব্রাউন নামে একজন আমেরিকানের মনে। ১৯৩০-এর দশকে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র অর্থাৎ ‘ঃধষশরব’ দেখার পরই বিষয়টি মাথায় আসে তাঁর। চলচ্চিত্রে একটি বইয়ের কাহিনী যেভাবে তুলে ধরা হয়, তাতে সেটি বইয়ের পাতার সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যায়। সেভাবে একটি বইও পর্দায় তুলে ধরা যেতে পারে বলে তিনি বলেন। এ নিয়ে ঞযব জবধফরবং নামে একটি বইও লেখেন বব ব্রাউন। যদিও বর্তমান ই-বইয়ের সঙ্গে বব ব্রাউনের ধারণার তেমন কোন মিল নেই। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ই-বইয়ের প্রচার শুরু করল সম্প্রতি। ই-বই বিষয়ে লেখক সুব্রত বড়ুয়া অল্পকথায় আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমানে অনেকেই ই-বই ব্যবহার করছেন। ই-বই বলতে বোঝায় ইলেক্ট্রনিক বুক বা ডিজিটাল বই; অথবা সাধারণ যে কোন বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ। ই-বই পড়ার জন্য দরকার ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির- (যেমন, কম্পিউটার, ট্যাব কিংবা স্মার্টফোন) যেখানে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে পাওয়া বিষয়বস্তু পর্দায় পড়া যাবে। সাধারণ কাগুজে বইয়ের মতো ই-বইয়েও বিষয়বস্তু ও যে কোন ঘটনার ছবি (রসধমব) থাকে। যে বই কাগজে প্রকাশিত হয়নি সে বইও ই-বই হতে পারে। যে কোন ডিভাইসে পড়ার উপযোগী ই-বইয়ের একটি বড় সুবিধা হলো, ই-বই রাখার জন্য খুব বেশি জায়গা দরকার হয় না। হাজার হাজার ই-বই হার্ডড্রাইভের খুব অল্প জায়গাই ব্যবহার করে। ফলে বই বহনের সীমবদ্ধতা থেকে ই-বই একেবারেই মুক্ত। স্মার্টফোন বা ট্যাবে যে কোন স্থানে, যে কোন অবস্থায় ই-বই পড়া সম্ভব। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে ই-বই ডাউনলোড করতে পারেন বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। তাছাড়া পর্দায় উপস্থাপিত সবকিছু পাঠক নিজের সুবিধা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এটি কম আলো এমনকি পুরোপুরি অন্ধকারের মধ্যেও পড়া যায়। বইয়ের অক্ষরের আকার ছোট-বড় করা, পড়ে আসা অংশে আবার ফিরে যাওয়া এবং পাতা উল্টিয়ে সামনের অংশে চলে যাওয়ার মতো সুবিধাগুলো ই-বইকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সারা বিশ্বেই ই-বই পড়ার অভ্যাস এখন দ্রুত বেড়ে চলেছে।’ বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় রচিত বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ও গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোকে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে নিয়ে আসার প্রয়াসে প্রকাশিত হলো ‘একুশ ই-বুক’। এটি মূলত ওকে মোবাইলের একুশে ট্যাবের একটি এ্যাপ। প্রাথমিকভাবে এই এ্যাপে ৩০টি বই সংযুক্ত হয়েছে। বইগুলো পড়তে হলে পাঠককে একুশে ট্যাব কিনেই পড়তে হবে। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর দারুণ একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন শিক্ষার্থীর থেকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।’ নারীর কবিতা বাংলা কবিতায় নারী জাগরণ নিয়ে আলোচনা এবং নারী-কবিদের কবিতাপাঠের আয়োজনটি ছিল এ সমাজে সংবেদনশীল নারীর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি জানার এক নান্দনিক সুযোগ। অনেকেই সে সুযোগ হাতছাড়া করেননি। অবশ্য সৃষ্টিশীল মানুষের জেন্ডার বিচার হয় না। তাই কবি হলেন কবিই, তিনি নারী না পুরুষ সে বিচার নিরর্থক। যাহোক, ঘাসফুলের আয়োজনটি ছিল ডেইলি স্টার সেন্টারে। এতে কবি শেলী নাজের পঠিত প্রবন্ধটি সমাজে নারী-কবির অবস্থান সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। কবিতা পড়ে শোনান কবি রুবী রহমান, কাজী রোজী, নভেরা হোসেন, শাহনাজ নাসরীন, সুলতানা শাহরিয়া পিউ প্রমুখ। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ [email protected]
×