ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র ॥ সময় এসেছে পুব দিকে দৃষ্টি দেয়ার

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

 উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র ॥ সময় এসেছে পুব দিকে দৃষ্টি দেয়ার

এটা ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। স্থান : হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুম। ওয়াশিংটন থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশ নামক এক ভূখণ্ডে তখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী বীর বিক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে। উদ্বিগ্ন আসন্ন পরাজিত পাকিস্তানের প্রধান মদদদাতা নিক্সন। উদ্বিগ্ন কিসিঞ্জার। জাতীয় নিরাপত্তা কউন্সিলের সভা। সভাপতিত্ব করছেন হেনরি কিসিঞ্জার। সেনাপতিরা দুঃসংবাদ দিলেন, ‘বাংলাদশের জন্ম এখন অবধারিত’। এ পর্যায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি রাষ্ট্রদূত ইউএ জনসনের মন্তব্য : ‘যুদ্ধ যখন শেষ হবে তখন বাংলাদেশ হবে এক আন্তর্জাতিক ঝুড়ি’। কিসিঞ্জার অবশ্য বললেন, ‘আমাদের ঝুড়ি না হলেই ভালো কথা।’ ১৯৭৫ সালে এমআইটি থেকে ১০ জন অধ্যাপকের (যার মধ্যে ৪ জন নোবেল বিজয়ী) লেখা নিয়ে প্রকাশিত হলো একটি বই। তাদের অভিমত বাংলাদেশ হলো হাসপাতালে এমন এক রোগী যাকে কোন চিকিৎসা দিয়ে আরোগ্য করা যাবে না। তারা বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানালেন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করে এমন সব রোগীর দিকে হাত বাড়াতে যাদেরকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যাবে। এ বই প্রকাশের প্রায় চার দশক পরে গত বছরের ১৭ জুন, ‘খাদ্য ঝুড়ি থেকে খাদ্য ভাণ্ডার : বাংলাদেশ কিভাবে ক্ষুধা কমানোর জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠে’- শিরোনামে একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হলো খ্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর দৈনিক সংবাদপত্রে। ‘চার দশক আগে, নবগঠিত এবং নিদারুণভাবে চরম দারিদ্র্য ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধায় আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ প্লাবিত হলো এক ভয়াবহ বন্যায় এবং যার পরিণতিতে নেমে আসল ১৯৭৪ সালে এক দুর্ভিক্ষ। ‘আজ, এক সময়ের খাদ্য বাস্কেট রূপান্তরিত হয়েছে একটি খাদ্য ভাণ্ডারে এবং বাকি বিশ্বের জন্য ক্ষুধা কমানোর জন্য একটি মডেল’ -লিখেছে পত্রিকাটি। ‘বাংলাদেশ গত ১০ থেকে ১৫ বছরে তিন সাফল্যের গল্পের এক ইথিওপিয়া ও নেপাল হলো অন্য দুইÑ যারা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা নির্মূলে আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনের ওপর কিছু আশা’, বললেন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক এ্যাফেয়ার্স স্কুলের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন এবং পুষ্টি বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ গ্লেনডেনিং। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য ধান লাগত বার্ষিক দেড় কোটি টন অথচ ধান উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে দেশে মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন খাদ্য রফতানির সক্ষমতা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ। তারা মনে করেন, তাদের নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সাম্প্রতিক এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থার ওয়েবসাইটে সোমবার ‘আইআরআই’স সেন্টার ফর ইনসাইট পোল: অপটিমিজম গ্রোয়িং ফর বাংলাদেশ’স ইকোনমিক ফিউচার’ শিরোনামে এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ১৯ নবেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের সাতটি বিভাগের ৬৪টি জেলায় ২ হাজার ৫৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জরিপটি চালানো হয়। এই জরিপ তত্ত্বাবধানে আরও ছিল গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারস। জরিপে উঠে এসেছে, ৬৪ শতাংশ বাংলাদেশী মনে করেন, শিক্ষা, যোগাযোগ এবং অর্থনীতির উন্নয়নের কারণে দেশ সঠিক পথেই রয়েছে। আর ৩২ শতাংশের মতে, বাংলাদেশ ভুল পথে হাঁটছে, কারণ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। ২০১৩ সালে ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করত, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। তবে এজন্য রাজনীতিকে দায়ী করেছেন তাদের মাত্র অর্ধেক। এছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশ মানুষ। একই বছরের জুন মাসে করা সংস্থার আরেকটি জরিপের ফলের চেয়ে এই হার ১২ শতাংশ বেশি। ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভাল অথবা ভাল পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে চলতি বছরে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী ৭২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। আর প্রতি ১০ জনের ৯ জনই জানিয়েছেন, নিজেদের আয়েই পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন তারা। এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭২ শতাংশ বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন; যা গত জুনে করা সংস্থার আরেকটি জরিপের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। তারা মনে করেন, সরকার তার দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করছে। এছাড়া উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্র বেশি জরুরী বলে মনে করেন বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। যদিও গত জুন মাসে এই হার ছিল ৬৮ শতাংশ, কিন্তু তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫১ শতাংশে। অন্যদিকে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন বেশি জরুরী বলে যারা মনে করেন, তাদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ২৭ শতাংশ থেকে এই হার বেড়ছে ৪৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে আইআরআইয়ের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ড্রেক লুইটেন বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের কাছে অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে এই জরিপে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যদিও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে সবক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যত এই ক্রমবর্ধমান আশাবাদের মধ্যে এ জরিপে যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিফট হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির অগ্রাধিকারের ব্যাপারে মানুষ প্রায় সমানভাবে বিভক্ত। যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেটা হলো গত জুন মাসে যখন ৬৮% মানুষ গণতন্ত্রকে উন্নয়নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছে বর্তমান জরিপে সেটা ৫১%-এ নেমে এসেছে, যে উদার ওয়েস্টমিনিস্টার টাইপ গণতন্ত্র বাংলাদেশ গত প্রায় ২৫ বছর ধরে অনুশীলনের চেষ্টা করে আসছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিরিখে, বাংলাদেশ খুব ভালভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আমি বাংলাদেশে আমার সহকর্মী শিক্ষাবিদগণ, বিশেষ করে টিভি টকশোগুলোতে যে বল্গাহীন স্বাধীনতা ভোগ করেছেন সেটা দেখে ঈর্ষান্বিত হই। সে ধরনের স্বাধীনতা কানাডায় আমরা চিন্তা করতেও পারি না। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় বিফলতা একটি বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সিস্টেম তৈরি করতে ব্যর্থতা। এর বিপরীতে হয়েছে একটি মেরুকরণের রাজনৈতিক বিভক্তি, যেখানে বিভাজন এসেছে, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের রক্তমাখা ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা আমাদের মতো এক সাগর রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, তাদের ক্ষেত্রে ঐ রক্তমাখা ইতিহাসকে যারা অস্বীকার করে বা যারা ঐ ইতিহাসের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান বা পুনর্বাসন ঘটেনি। যার ফলে এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছে, চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে যার চিন্তা ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও ক্ষমতার মসৃণ পরিবর্তন। দুর্ভাগ্যবশত মেরুকরণের রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে সে ব্যবস্থাও ম্যানিপুলেশনের শিকার হয়। ফলে সৃষ্টি হয় তথাকথিত ‘এক এগারো’ এবং পরিণামে দেশে নেমে আসে দুই বছরের সংবিধান বহির্ভূত শাসন। আজকে যারা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ নিয়ে চিৎকার করছেন তাদের ক্ষমতা লিপ্সাই এ ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী। আইআরআই প্রতিবেদনে উন্নয়ের জন্য জনগণের পছন্দের ওপরে বর্ণিত ফলাফল স্থানান্তরের দিকে তাকিয়ে এখন সম্ভবত সময় এসেছে যে বাংলাদেশ তার দৃষ্টি প্রাচ্য অভিমুখে ধাবিত করার যেখানে উন্নয়ন ওয়েস্টমিনিস্টারের উদার গণতন্ত্রের চর্চার ওপরে অগ্রাধিকার পেয়েছে। এ ধারায় মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর এক বিপ্লব সাধিত করেছে এবং উভয় দেশই গত ৫০ বছর ধরে মডেল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা নেতা লি কুয়ান ইউ, যিনি গত বছর ২৩ মার্চ তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রতি মৃত্যু পরবর্তী শ্রদ্ধা জানাতে ফাইনান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, “ওয়াশিংটন, ডিসি, দ্রুত এক ‘অকার্যকর রাজধানীর প্রতিবিম্ব’ হয়ে উঠছে এবং তার বিপরীতে সিঙ্গাপুর হয়েছে ‘সুশাসনের ধারণার পোস্টার সন্তান।’ লি কুয়ান ইউয়ের মতে ‘উদার গণতন্ত্রের উচ্ছ্বাস অসংযম এবং অগোছালো অবস্থার সৃষ্টি করে যেটা উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মানের চূড়ান্ত পরীক্ষা হলো ঐ ব্যবস্থা ঐ সমাজে তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে কতটুকু অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে তার ওপর। গণতন্ত্র এটা করার একটা উপায়, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া যদি ঐ মূল্যবান শেষ প্রাপ্তি অর্জনে বেশি সহায়ক হয় তাহলে আমি উদার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এ দুটোর কোন একটা পদ্ধতি পছন্দে নৈতিকতা বিসর্জনের কোন প্রশ্নই উঠে না।” লিয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোন অন্তর্নিহিত মূল্য নেই। মোদ্দা কথা হলো সুশাসন।’ সিঙ্গাপুর লৌহমানবের মতে সরকারেরে প্রাথমিক দায়িত্ব হলো ‘স্থিতিশীল ও সুশৃঙ্খল সমাজ’ যেখানে ‘নাগরিকদের তাদের খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেয়া হয়’। সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব এ অবস্থা তৈরি করা। মালয়েশিয়ার মাহাথিরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে লি এর যুক্তি হলো ‘পূর্ব’ এবং ‘পশ্চিমা’ সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেখানে পূর্ব সংস্কৃতিতে পশ্চিমের তুলনায় ব্যক্তির চাইতে সমষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়, যার ফলে সামষ্টিক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরাপত্তার প্রয়োজনে মানবাধিকার অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। লেখক : অধ্যাপক, কানাডা প্রবাসী
×