ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাল্টে যাওয়া সাংবাদিকতা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পাল্টে যাওয়া সাংবাদিকতা

আমার দেখা এইটুকু ছোট জীবন দিয়েই আমি বুঝতে পারি, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পাল্টে গেছে। আমার স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও দেশের জন্য সাংবাদিকদের যে ভূমিকা পালন করতে দেখেছি, তা এখন অস্তিত্বহীন। ’৯০-এর গণআন্দোলনের সময়ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের যে ভূমিকা পালন করতে দেখেছিলাম, কিংবা তারা যা করতে পারতেন, তা এখন আর নেই। তারা সেই রকম ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। কেন পারছেন না, তা নিয়ে আমার সবসময়ই এক ধরনের কৌতূহল ছিল। জ্যেষ্ঠ কাউকে পেলেই তাকে জিজ্ঞেস করি, এমনটা হলো কেন! সাংবাদিকরা তাদের মর্যাদা হারাল কেন! একটা সময় ছিল, সাংবাদিকরা জাতীয় সঙ্কটের সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বসার মতো যোগ্যতা রাখতেন। নীতি-নির্ধারণীতে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন, দেশের মানুষ তাদের দিকে ভরসার চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত। সেই সময় এখন আর নেই। সেই গৌরব আমরা হারিয়েছি। কিন্তু কেন? কিভাবে? সবসময় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের হাতের কাছে পাওয়া যায় না। তাদের ব্যস্ততা থাকে। গেল সপ্তাহে খুব জ্যেষ্ঠ এবং শ্রদ্ধেয় একজন সাংবাদিক ভাইকে দুপুরের খাবারের টেবিলে পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে করেই আমি তার নামটি বলছি না; তবে পাঠককে এটুকু বলতে পারিÑ তিনি বর্তমান সময়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে একজন হবেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের বাংলাদেশ দেখেছেন, পরের বাংলাদেশের চড়াই-উতরাই দেখছেন। তার নামটি বললে সবাই চিনবেন। তবে তিনি যেহেতু খাবার টেবিলে আমাকে খোলাখুলি অনেক কিছু বলেছেন, আমার চিন্তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন, তার অভিজ্ঞতা এবং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমাকে আরেকটু জ্ঞানসমৃদ্ধ করেছেন এবং সর্বোপরি আমাকে ভালবাসা দিয়ে সিক্ত করেছেনÑ তাই আমি চাই না আমার লেখার কারণে তিনি কোন বিতর্কের মধ্যে পড়ুন। তবে তার চিন্তাগুলো আমি পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। তারাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, পুরনো দিনেরই সেই সাংবাদিকতা কিংবা সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ববোধের জায়গাগুলো ঠিক তেমনটা আর নেই। দেখা যাক, একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তিনি নিজে কী মনে করছেন। লেখার সুবিধার্থে নাম দিয়ে রাখলাম ‘সত্য দা’। দুই. বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইয়াহিয়া খানের সময় তার প্রেস সেক্রেটারি বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে বসতেন। উদ্দেশ্য ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করতে চান। সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা কখন সময় দিতে পারবেন, সেটা জেনে নিয়ে তারপর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারণ করতেন। বিষয়টি এমন ছিল না যে, ইয়াহিয়া খান অমুক দিন সময় দিয়েছেন এবং সেদিন সম্পাদক/সাংবাদিকদের যেতে হবে। বিষয়টি ছিল এমন যে, যখন সাংবাদিকরা সময় দিতে পারবেন, সেভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মিটিং ফেলবেন। এটুকু তথ্য দিলেন সত্য দা। যদি মোটাদাগে বিভিন্ন পটপরিবর্তনকে মাইলস্টোন হিসেবে ধরি, তাহলে দেখা যাবে বিগত শতকেও সাংবাদিকদের যে ভূমিকা ছিল, তা এই শতকে এসে লক্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছে। গত শতকে ১৯৮০-১৯৯০ সালের মূল সময়টা দখল করে ছিলেন এরশাদ সাহেব। সামরিক শাসন এবং জাতীয় পার্টি মিলে দেশে হরেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তখনও আমরা সাংবাদিকদের বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখি। তারা এরশাদ সরকারের যেভাবে সমালোচনা করতেন কিংবা করতে পারতেন, তা উদাহরণ হতে পারে। এরশাদ সরকার নামকরা সাংবাদিকদের নির্যাতন করেছেন, দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং সেই নির্যাতনের ভয়ে কলম থেমে গেছেÑ এমনটা দেখা যায়নি। বরং এরশাদ শাসনের পতনের একটি বড় উপকরণ ছিল মিডিয়া, বিশেষ করে খবরের কাগজ এবং সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলো। সেই সময়ে একেকটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যে শক্তিশালী কভার স্টোরি করত, কিংবা করতে পারতÑ সেটা এখন আর হয় না। সেই চিন্তাও নেই, করার ক্ষমতাও নেই। সেই ক্রেডিবিলিটি যদি এখন না থাকে, তাহলে ভূমিকা রাখবেন কিভাবে? নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো বলে আমরা মনে করি। সংবাদমাধ্যমগুলো মনে করল, তাদেরও বুঝি স্বাধীনতা এলো। এখন হয়ত কলম খুলেই লেখালেখি করা যাবে। কিছুদিন করা গেল বটে! কিন্তু পোলারাইজেশন হতে শুরু করল। ১৯৯০-২০০০ সাল (অর্থাৎ বিগত শতকের শেষ) পর্যন্ত যদি দেখা যায়, তাহলে প্রথম টার্ম বিএনপি এবং শেষ টার্ম আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। ১৯৯৬ সালে হাবিবুর রহমান সাহেব যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানÑ তখনকার নির্বাচনে, নির্বাচন প্রচারণায়, সত্য প্রকাশে কিংবা সমালোচনায় এবং পরামর্শ প্রদানে সাংবাদিকরা যতটা ক্রেডিবল ছিলেন, পরের সময়টাতে সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। তখনও সাংবাদিকদের সমাজে মানুষ নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ভাবত। তাদের কোন পদক্ষেপকে মানুষ বিশ্বাসের চোখে দেখত। তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তখন কোন সাংবাদিককে আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী, জাতীয় পার্টি কিংবা জামায়াতপন্থী বলা হতো না। কিংবা ভেতরে ভেতরে কেউ কোন মতবাদকে সমর্থন করলেও, প্রকাশ্যে তাদের কাজে সেটা প্রকাশিত হতো না এবং তারা সত্যি সত্যিই দেশের ভাল হবে এমনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। আর এখন? অন্যান্য পেশার মতো আমাদের পেশাতেও দলাদলি চলে এসেছে। আমাদের গায়ে সিল লেগে গেছে। একজনকে বলা হচ্ছে সরকারপন্থী, আরেকজনকে বিএনপিপন্থী, নয়ত জামায়াতপন্থী। ফলে একজন সাংবাদিক যখন কোন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে যান, কিংবা কোন ভূমিকা পালন করতে যানÑ তখন সেটার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। রাজনীতি যেভাবে বিভক্ত, আমাদের বিভিন্ন পেশাগুলো যেভাবে বিভক্ত, আমরা সাংবাদিকরাও একইভাবে বিভক্ত। সত্য দা’র চিন্তার সঙ্গে যদি আমি আমার ব্যক্তিগত চিন্তাকে যোগ করি তাহলে বলা যেতে পারেÑ এই শতকে এসেই বাংলাদেশে সাংবাদিকতা তার ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। ফলে এখন আমরা দেখতে পাইÑ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত পাওয়ার জন্য সাংবাদিকরা মরিয়া হয়ে থাকেন, তার সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য লবিং করেন, বিভিন্ন সরকারী পোস্টে দায়িত্ব নেয়ার জন্য বাড়তি চামচামি করে থাকেন এবং কেউ কেউ প্রকাশ্যেই এমন চামচামি করতে থাকেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই লজ্জা পেয়ে যান। তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে হয়, আসল প্রশ্নটি করুন। আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা সরকারী দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, বিএনপিপন্থীরা বিএনপি নামক দলটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের জামায়তের কর্মী বললে ভুল হবে না। আর যারা এগুলোর ভেতরে নেই, তাদের ভয়েস খুবই নিম্ন; কেউ তাদের কথা শুনতে পায় না। তিন. রাজনীতি নষ্ট হলে যে পুরো সমাজ নষ্ট হয়ে যায় তার বড় প্রমাণ এই শতকের বাংলাদেশ। ২০০০ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করে। ক্ষমতার লোভে দুঃশাসনকে প্রমোট করা, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নানান ফন্দি-ফিকির করা, আইনকে পরিবর্তন করা এবং প্রয়োজনে অন্য মতবাদকে মেরে ফেলার মতো চর্চা যখন এ দেশে চালু হয়ে গেল, তখন সাংবাদিকরাও তাদের অস্তিত্ব এবং সুবিধার জন্য বিভিন্ন শিবিরের নিচে জায়গা নিতে শুরু করেন। ২০০১ সালে লতিফুর রহমান সাহেবের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে যে নির্বাচন হলো সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল, কিংবা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। এটার উত্তরও দুই ভাগÑ যদি আপনি বিজয়ী দলে থাকেন তখন আপনি বলবেন নির্বাচন ঠিকই হয়েছে; আর পরাজিত দল বলল নির্বাচন ঠিক হয়নি। রাজনীতিতে দূরত্ব বাড়তে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদেরও। পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে এখানে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মকা-কে আনছি না, শুধু ট্রান্সজিশন পয়েন্টগুলোকে উল্লেখ করছি। তাহলে বিবর্তনটির কিছু চেকপয়েন্ট পাওয়া যাবে। লতিফুর রহমান সাহেবের পর আবারও ক্ষমতা পরিবর্তনের খেলায় ২০০৬ সালে ক্রীড়ানক হলেন অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা করতে থাকেন এবং তখন হরেক রকমের জিনিসপত্র জাতি দেখতে পায়। রাজনৈতিক দূরত্ব স্মরণকালের খারাপ জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাত্র ১ দিনের জন্য একজন সরকার প্রধান ক্ষমতায় বসেন। জনাব বিচারপতি ফজলুল হক সাহেব ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শপথ নেন এবং ঠিক পরের দিনই (১২ জানুয়ারি) পদত্যাগে বাধ্য হন। সেই সঙ্গে ১২ তারিখ থেকে শুরু হয় ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদেরও দলে টেনে নেয়। সিনিয়র সাংবাদিক তো বটেই, জুনিয়ররাও বিভিন্ন দলে ভিড়ে যায়। এখন আর নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। এখন শিক্ষকদের যেমন দল আছে, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সরকারী আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী, মসজিদের ইমাম কিংবা ক্লাব তাদের যেমন রাজনৈতিক দলের পরিচয় আছে, তেমনিভাবে সাংবাদিকদেরও রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, আপনি একটা লেখা ছাপলেও প্রথমেই প্রশ্ন তোলা হয়, উনি কোন পন্থী? লেখার মেরিট বিচার করার আগে তাকে একটা ঘরানায় ফেলা হবে, তারপর সেই লেখার বিশ্লেষণ হবে। আপনি যদি বলেন, দেশ উন্নতির পথে এগোচ্ছেÑ প্রথমেই দেখা হবে আপনি কোন দলের সাংবাদিক। সরকারী দলের হলে বলা হবে, আপনি তো সরকারের লোক, এ কথা তো বলবেনই। আর বিরোধীরা বলবেÑ দালাল দালাল দালাল। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এগুলোর উর্ধে গিয়ে এখন আর কিছুই বলতে পারেন না। হয়ত সেই ক্ষমতাও আমাদের নেই। চার. রাজনীতি এবং সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সেটা অর্থনৈতিক। ব্রিটেনকে ধরা হয় মিডিয়া জগতে সবচেয়ে ম্যাচিউরড মিডিয়া। ওখানকার পাঠকরাও তাই। সেই ব্রিটেন তার দেশের মানুষের কথা প্রকাশ করার জন্য তৈরি করেছিল বিবিসি। এটা জনগণের টাকায় চলে এবং সরকারের সমালোচনা করে। তারা মিডিয়াটাকে জনগণের একটি ভয়েস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং গণতন্ত্রের আরেকটি স্তম্ভ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। এখন যে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নড়বড়ে, সে দেশের মিডিয়া খুব ভাল ভূমিকা রাখবেÑ সেটা হওয়ার কথা নয়। কারণ মিডিয়া তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্য স্তম্ভগুলো যেমন ভেঙ্গে পড়েছে, গণমাধ্যমও তাই হয়েছে। বাংলাদেশে আগে ধনী ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে টাকা দিতেন এক ধরনের দায়িত্ববোধ থেকে। তারা মনে করতেন, সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ পাওয়ার একটা মাধ্যম থাকা প্রয়োজন। এটা দিয়ে কেউ ব্যবসা করবেনÑ সেটা ভাবতেন না। সাংবাদিকরাও ছিলেন তেমনি। পুরনো দিনের সেই পত্রিকাগুলোতে যারা কাজ করতেন, তাদের কোন মাসে বেতন হতো, কখনও হতো না। খুবই দরিদ্র জীবনযাপন করতেন তারা। ফলে তাদের একধরনের সাহস ছিল। চাকরি হারানোর ভয় ছিল না। যেহেতু আয় কম, তাই সেটা চলে গেলে তেমনটা মাথা ব্যথা থাকত না। কিছু না কিছু একটা হয়ে যাবে। জীবন চলে যেত। কিন্তু এখন মিডিয়াগুলো কর্পোরেট আকার নিয়েছে। সারা পৃথিবীতেই তাই। তাতে দোষের কিছু হওয়ার কথা ছিল না। একটি ভাল বিনিয়োগ না হলে অনেক কিছুই করা যায় না। এখন ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য (কিংবা ভিন্ন উদ্দেশ্যে) বিনিয়োগ করেছেন। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা, সুবিধা অনেক বেড়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে অসংখ্য সাংবাদিক আছেন যাদের বেতন লক্ষাধিক টাকার উপরে। অনেক সাংবাদিক আছেন যারা ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট-প্লট এবং গাড়ির মালিক। তাদের এখন চাকরির ভয় আছে, যা আগে ছিল না। এ চাকরি যদি চলে যায়, তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান হঠাৎ করেই ছন্দপতন হবে। ফলে তারাও বিভিন্ন উপায়ে সেই জীবনকে ধরে রাখতে চান এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসৎ উপায়ে হলেও অর্থের মালিক হতে চান; মিডিয়াও সে সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন মিডিয়াও আছে যেখানে সাংবাদিকদের উল্টো টাকা দিয়ে চাকরি নিতে হয়েছে এবং প্রতিমাসে তারা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন পান না, বরং উল্টো টাকা প্রদান করেন। তারা কিভাবে এ টাকাটা যোগাড় করেন, সেটা হয়ত মানুষের কাছে অজানা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে আগে হয়ত এটা চিন্তাই করা যেত না। আমি সত্য দা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ভারতে তো মিডিয়া কর্পোরেটদের হাতে গিয়েছে; যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য সব জায়গাতেই তো মিডিয়া এখন কর্পোরেটদের কাছে। সেখানে প্রফেশনালিজম তৈরি হয়েছে। আমরা কি সেটা পেরেছি? সত্য দা খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। তিনি পরিষ্কার শব্দে বললেন, না আমরা সেটা পারিনি। আমাদের কর্পোরেটগুলোর নিজেদের ভেতরই অনেক ঝামেলা রয়েছে। তারা মিডিয়া তৈরি করছে তাদের হাতিয়ার তৈরির জন্য, নিজেদের ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য নয়, গণতন্ত্রের স্তম্ভ হবেÑ সে চিন্তা থেকে তো অবশ্যই নয়। ভারতে একটি ফাংশনাল ডেমোক্রেসি আছে। আর যে দেশগুলোর কথা বললে সেখানেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুব সুন্দরভাবে চলছে। ওখানে একজন চোরকে নমিনেশন কেউ দিচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে এক দল না দিলে অন্য দল তাকে নিয়ে নিচ্ছে। ফলে এখন সকল দলই তাকে নিয়ে টানাটানি করছে। তার ব্যাকগ্রাউন্ড কেউ দেখছে না; নির্বাচনে টাকা খরচ করতে পারবে কিনা, সেটাই মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। সেই নির্বাচন যদি সুষ্ঠুও হয়, সেটা তো মানুষের কল্যাণের জন্য প্রার্থী দেয়া হয়নি। প্রার্থী দেয়া হয়েছে তার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য। সেখানেও ব্যবসায়ীরা ঢুকে গেছেন। তাই ভারতের একটি মিডিয়া যত শক্তভাবে কথা বলতে পারে, আমাদের মিডিয়া পারে না। মালিকপক্ষ যেভাবে চায়, সাংবাদিকরা সেটাই করে থাকেন। তাদের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের সাংবাদিকদের নেই। পাঁচ. আমাদের সাংবাদিকরা কি তাহলে কখনই মেরুদ- সোজা করে আর দাঁড়াতে পারবে না? নীতির সঙ্গে না মিললে চাকরি ছেড়ে দেয়ার সাহস দেখাতে পারবে না? প্রধানমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে গিয়ে কঠিন প্রশ্নটি তার টেবিলে ছুড়ে দিতে পারবে না? সত্য দা হাসেন। বলেন, আমাদের সাংবাদিকরা চাকরি পরিবর্তন করেন বটে; তবে নীতির সঙ্গে মেলেনি সে কারণে নয়, তারা ঘন ঘন হাউস পাল্টান তার বেতন বাড়ানোর জন্য। সেখানে নীতি, কিংবা মহৎ পেশার সঙ্গে কোন মিল নেই। বেতন আর সুযোগ-সুবিধাই বড় নীতি। অন্যান্য পেশার মতো এটাও আরেকটি পেশা। এটাকে এখন আর কেউ সেই মহৎ পেশা বলে মনে করেন না। আর আগেই বলেছি, যারা মনে করেন তাদের ভয়েস খুব ক্ষীণ। একটা সময়ে বুদ্ধিজীবী বললে সাংবাদিকদের নাম আগে চলে আসত, কারণ তারা নিত্যদিন হাজারও তথ্য নিয়ে কাজ করেন। রাজনীতিবিদরা তাদের পরামর্শ নিতেন। সমাজে শিক্ষকদেরও বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কত শত বুদ্ধিজীবী হারালাম বলে একটি দিনকে আমরা তাদের জন্য উৎসর্গ করেছি, তাদের স্মরণ করি। আমরা কি সেই গৌরবটুকু ফিরে পাব না? সত্য দা আগের মতোই হাসতে হাসতে বলেন, আপাতত আর সম্ভব নয়। আমাদের গায়ে যতদিন সিল মারা থাকবে, ততদিন আর কিছুই সম্ভব নয়। সিল থেকে যদি মুক্তি দেয়া যায় তাহলে বিশাল একটা মুক্তি দেয়া হলো। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে আমরা একটা জাল দিয়ে আটকে ফেলেছি। সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে না পারলে, কিভাবে আর সম্ভব! গালে হাত দিয়ে সত্য দা বললেন, আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার কাছ থেকে কিছু আশার কথা শুনতে চাইছ। তুমি চাইছ আমি বলি, আমার জীবদ্দশাতেই এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। কিংবা আমরা গুটিকয়েক বুড়ো মানুষ এগুলো ঠিক করে ফেলব। বিষয়টি এত সহজ নয়। একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি না খেলে এই মোহবিষ্ঠ চক্র ভাঙ্গবে না। আর যদি না ভাঙ্গে? তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সমাজে চেক-এ্যান্ড-ব্যালেন্স থাকবে না। সত্য দা তেমন একটা আশা দিলেন না। কিন্তু আমি জানি, আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে এমনিতেও সাংবাদিক প্রয়োজন হবে না। এ পেশাটি বিলুপ্ত হবে। সাংবাদিকদের সাহায্য ছাড়াও মানুষ সঠিক তথ্য পেয়ে যাবে। সংবাদমাধ্যম নামে আলাদা কিছু থাকবে না। মানুষ এবং যন্ত্র মিলে হাজারও তথ্য প্রসেস করবে। সেখানেই লুকানো থাকবে সংবাদ। সেদিকেই এগোচ্ছে পৃথিবী। ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ই-মেইল : ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×