ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যর্পণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রত্যর্পণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন

থ্রিলার পড়েন? আমি নিয়-মিত পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি। পাশ্চাত্য থেকে যেসব থ্রিলার প্রকাশিত হয় সেসবে ‘সিøপারের’ উল্লেখ থাকবেই। কেজিবি শিশু অথবা কিশোরদের যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে উঠত, রাজনীতিতেও অংশ নিত। কিন্তু যখন কেজিবি কোন হুকুম করত তখনই তা পালন করত। এখন আবার ‘স্লিপার’ শব্দটি শোনা যাচ্ছে। সিরিয়ার বাস্তুহারাদের সঙ্গে আইএস নাকি অনেক স্লিপার পাঠিয়েছে। চর বা স্পাই বা অনুপ্রবেশকারীও পাঠিয়েছে। আইএসের হুকুম হলেই তারা মাঠে নামবে। ১৯৭২-৭৩ সালের কথা অনেকের মনে নেই। পাকিস্তানীদের পক্ষে লড়তে থাকা পাকিস্তানী বাঙালীরা যাদের অধিকাংশ ছিল জামায়াত ও মুসলিম লীগের কর্মী তারা পাকিস্তানে পালিয়েছিল। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পালাতে পারেনি। অবাঙালীরা যারা ছিল খান সেনাদের জিগরি দোস্ত তারাও পালাতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা দাবি তুলল তাদের পাকিস্তানে পাঠাতে হবে। এদের বলা হতো আটকেপড়া পাকিস্তানী। কয়েক দফায় পাকিস্তান এসব আটকেপড়াদের নিয়েছিল। অবাঙালীদের সঙ্গে বাঙালী জামায়াতি ও মুসলিম লীগাররাও ছিল। পরে পাকিস্তান আটকেপড়া এসব লোকজন নিতে আপত্তি জানায়। এরপরও এরা পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য এক দশক আন্দোলন করেছিল। তাদের পাকিস্তান যাওয়ার আর দরকার পড়েনি। ১৯৭৫ সালে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন। তখন কাকুলিয়রা ছিল ক্ষমতায়। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জিয়ার সঙ্গে হাত মেলায়। তখন মনে হয়েছিল পাকিস্তান এতো স্লিপারের সৃষ্টি করতে পেরেছিল! জিয়াউর রহমান কাকুলিয়দের সাহায্যে বিএনপি গঠন করেন। তখন আটকেপড়া পাকিস্তানীরা তার সঙ্গে হাত মেলায়। যখন দেখা গেল অস্ত্রের জোরে কাকুলিয়রা আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকবে, তখন লেফটি হিসেবে পরিচিত কাজী জাফর আহমদ, মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ বিএনপিতে যোগ দেয়। উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে পাকিস্তানের ঝা-া তোলা। যেমন, আবদুল হক নামে এক লেফটি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার। তবে, ঐসব সিøপার বা আটকেপড়া পাকিস্তানীরাই যে বিএনপি বড় করে তুলেছিল তা নয়। নতুন অনেক বাঙালীও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। জিয়া আলবদর-রাজাকারদের অবমুক্ত করলে বিএনপির সেকেন্ড ফ্রন্ট হিসেবে তারাও নিজেদের দল জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি গঠন করে। মাঝে মাঝে বিএনপির কিছু সভ্য জামায়াত-বিএনপির মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি করতে চাইত লোক লজ্জায়। এখন আর সে লজ্জাও নেই। জিয়ার পর এরশাদও তাই করেছিলেন। অনেকের মতে, এরশাদ সিøপার নয়, পাকিরা সরাসরি তাদের লোক হিসেবে তাকে প্রেরণ করেছিল। জিয়া ১৯৭৫ সালের পর সেজন্য তাকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদও একই পথ অনুসরণ করেন। খালেদার সঙ্গে তার মাঝে মাঝে মান-অভিমান হয়Ñ সেটি চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। এক সময় দু’জনের বিরোধ এত চরমে ওঠে যে, খালেদা তাকে চোর আখ্যায়িত করে জেলে ঢোকান। শেখ হাসিনা তার প্রতি নমনীয় আচরণ করেন, কিন্তু এরশাদ যাতে তাঁর পার্টি আওয়ামী লীগকে কলুষিত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রেখেছিলেন। বিরোধীরা অবশ্য বলেন, শেখ হাসিনা জামায়াতের সঙ্গেও আঁতাত করেছেন কিন্তু দুষছেন বিএনপিকে। আমার মনে হয়, শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মতো সবার ক্ষেত্রেই নমনীয়। তিনি মানবতাবিরোধীদের বিচার করছেন কিন্তু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছেন না। তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে বলছেন, কিন্তু শত অপরাধ সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার কোন আগ্রহ দেখাননি। খালেদা সেই আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ক্ষমতায় গেলে যারা ট্রাইব্যুনাল করেছে তাদের সবার বিচার করবেন। এরশাদের মতো মহাচোর ও ধূর্ত যার বিরুদ্ধে তিনি নিজে সংগ্রাম করেছেন তার ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। মুুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক দু’তিনজন সচিব যাদের অযুক্তিসুলভ ব্যবহার নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তিনি সদয়। দলের এমপিরা তাঁর কথায় কোন কেয়ার করে না, তাও তিনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিনি ধবল ধোলাই দিয়েছেন আর কাউকে নয়। হতে পারে তার বিপদে শিক্ষকরা সবার আগে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। তিনি সদয় ছিলেন খন্দকার মোশতাক, ওসমানীর প্রতি। এমন কী জিয়ার প্রতিও। সেজন্য আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভয় হয়। সবারই প্রতি সদয় হয়ে না নিজের সর্বনাশ করেন। আর তাহলে আমাদের সর্বনাশ। আটকেপড়া পাকিস্তানীরা দেশটিকে আলবদরদের দেশ করতে চাইছে। শেখ হাসিনা অনেকের প্রতি সদয় বটে কিন্তু এ বিশ্বাস আমাদের আছে যে, তিনি থাকতে আর যাই হোক বাংলাদেশ আলবদরদের দেশ হবে না, তিনি তা হতে দেবেন না। সে কারণে তাঁর সম্পর্কে যত আলোচনা-সমালোচনাই করি না কেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই আজ তাঁর সমর্থক। ॥ দুই ॥ আমি খাঁটি বাঙালী, তাই কথা বলতে ভালোবাসি। শুরু করেছিলাম সিøপার বা আটকেপড়া পাকিস্তানীদের প্রসঙ্গ দিয়ে, এখন চলে এসেছি কোথায়। ঐ দু’টি প্রসঙ্গের কথা মনে পড়ল সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে পাকিস্তানের প্রক্সি দেয়া প্রধান দল বিএনপির নেত্রী খালেদা ও তার সাঙ্গাৎদের এ সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে। এদের বক্তব্য নিয়ে অনেকেই মহাউত্তেজিত। কিন্তু, এটি কী এমন নতুন বক্তব্য? বিএনপি নেতারা বা জামায়াত নেতারা বা তাদের বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতারা ২০০০ সাল থেকেই এব কথা বলে আসছেন। আমরা তাতে কর্ণপাত করিনি, প্রশ্রয় দিয়েছি এবং ফন্দিবাজদের মধ্যে বলেছি, বিএনপিতেও মুক্তিযোদ্ধা আছে। আলবদর মান্নান, আলীমকে যারা মন্ত্রী বানায় সেই গত শতকের সত্তর থেকে, তারপর ধারাবাহিকভাবে যারা রাজাকারদের স্পীকার, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট করে আসছে তারা নাকি মুক্তিযোদ্ধার দল! পৃথিবীর একমাত্র সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও এমন ধারণা কেউ করে না। যাক, যা বলছিলাম। সিøপার জিয়াকে কেন ১৯৭৫ সালে উজ্জীবিত করেছিল পাকিস্তান? এ বিষয়টি এখন অনুধাবন করতে হবে। কেন তিনি শুরুতেই বাঙালীর সংবিধান বিনষ্ট করলেন এবং পাকিস্তানায়ন শুরু করলেন। একজন রাজাকারকে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী সব বানানো হলোÑ আমাদের খারাপ লাগল না, এখন ৩০ লক্ষ নিয়ে খারাপ লাগছে। বলিহারি বাঙালী। এর আগে আরও খারাপ কথা বলেছেন আটকেপড়া পাকিস্তানীরা। কেউ কর্ণপাত করেনি। আমরা এদের প্রতি সদয় থেকেছি, প্রশ্রয় দিয়েছি, বন্ধু মেনেছি, আত্মীয়তা করেছি, ভেবেছি বলুক না তারা এসব তাতে কী আছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ভবি ভুলবার নয়। তারা বিশেষ এজেন্ডা নিয়েই কাজ করছে। আমি কিছু পুরনো কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জানি এতে অনেকে বিরক্ত হবেন, কারণ এসব কথা যারা বলেছে বা বলছে তাদের ধোলাই আমরা দিইনি। কিন্তু কী করব বলুন, ইতিহাসের ছাত্র, স্বভাব তো আর বদলাতে পারিনি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের ঠিক আগে খালেদা বলেছিলেনÑ ১. “ধানের শীষের পক্ষে [পড়ুন পাকিস্তানের পক্ষে] থাকলে দেশ রক্ষা পাবে। আর শেখ হাসিনার সঙ্গে গেলে দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে।” ২. “তাই জয় বাংলা সেøাগানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জাতীয়তাবাদী শক্তিদের [অর্থাৎ পাকিস্তানীদের] এক হতে হবে।” ৩. পটল নামে [তিনি আছেন না পটল তুলেছেন জানি না] এক বিএনপি নেতা বলেছিলেনÑ “পরাধীনতার জন্য জয় বাংলা সেøাগান দেয়া হয়। স্বাধীনতার পক্ষে সেøাগান হলো নারায়ে তাকবির।” [ভোরের কাগজ, ১৭.৪.১৯৯৬]। ৪. চুরির দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি বা আটকেপড়া পাকিস্তানীদের এক বড় নেতা যিনি এখন পালিয়ে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেই সাদেক হোসেন খোকা বলেছিলেন “মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের কোন অবদান নেই। এ জন্যই বিএনপি অন্য নেতা ও বীরদের নামে রাজধানীতে তোরণ নির্মাণ করলেও শেখ মুজিবের নামে তোরণ নির্মাণ করবে না।” [সংবাদ, ৮.১২.১৯৯৬] ৫. মীর শওকত নামে আরেক সিøপার (যিনি এখন প্রয়াত) বলেছিলেন- “এই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অবদান রয়েছে।” [ঐ] ৬. আটকে পড়া পাকিস্তানীদের আরেক দল জামায়াতের সাঈদী [এখন কারাগারে] বলেছিলেন- “১৯৭৫ ও ১৯৭১-এ পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছিলাম বলে ওরা আমাদের রাজাকার বলে। যারা আজ আমাদের রাজাকার বলে তারা পিতার অবৈধ সন্তান।” [দৈ. সংবাদ, ১৯.১.২০০১] এ স্বীকারোক্তির পর নতুন কোন কিছু বলার থাকে? ৭. বর্তমান সরকারের আমলে বোধ হয় ফতোয়াবিরোধী রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। এই ফ্রন্টের আরেক নেতা ফজলুল করিম যাকে বলা হয় চর মোনাইয়ের পীর যা বলেছিলেন তা বিশেষ আকার দালালদের কথা বার্তার মতোই- “ফতোয়া নিষিদ্ধ [হিল্লা বিয়ে] করে বিবাহ বন্ধনের এই শক্ত গাঁথুনি উঠিয়ে দিলে পরবর্তী সন্তানরা সব হারামজাদা হবে।” [আজকের কাগজ, ২০.১.২০০৭] ৮. এই ফ্রন্টের আরেক নেতা বায়তুল মোকাররমের প্রাক্তন খতিব উবায়দুল বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জারজ সন্তান। ৯. এই ফ্রন্টের আরেক নেতা প্রয়াত আযিযুল হক (যিনি ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রধান ছিলেন) বলেছিলেনÑ “আমরা চাই নাই পাকিস্তান বাইঙ্গা বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। আমরা তখনো যা করেছি তা ঠিকÑ এখনও যা করেছি ঠিক। জামায়াতীদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নাই।” [বিচিত্রা, ১৯৯৭] আরও উদ্ধৃতি চান, দিতে পারি। কিন্তু এই উদ্ধৃতিগুলোর মাধ্যমে এটাতো স্পষ্ট যে, এরা পাকিস্তানের পক্ষে রাজনীতি করতে চায়, দেশের মানুষকে পাকিস্তানী মানসে দীক্ষিত করতে চায়। ধর্মের অপব্যবহার করে, ধর্মের নামে মিথ্যা বলে তারা ধর্মান্ধতা গাঢ় করতে চায়। শুধু তাই নয়, তাদের অজ্ঞতা অপরিসীম। একজন শায়খুল হাদিস ও একজন রাজনীতিবিদ/আইনজীবীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি যা এর উদাহরণ। ধর্মান্ধ ও অজ্ঞতার কাছে যুক্তি কোন বিষয় নয়। তাদের কাছে প্রত্যক্ষ প্রভুরা কী বলে সেটিই মূল বিষয়। খুব সম্ভব ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক করে মেয়েদের একটি হলের নাম প্রীতিলতা হল রাখা হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি নেতা মীর নাসির ও চট্টগ্রামের ৫২ জন মূর্খ আইনজীবী এক বিবৃতি দেন- “ঐ মহিলা [প্রীতিলতা] এতদাঞ্চলের জাতি সত্তার বিকাশ ও শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়নের চরম বিরোধী ছিলেন। ...১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে কলকাতার লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে ঢাকা কেন্দ্রিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- শুরু হয়। মুসলমানসহ সাধারণ মানুষের দ্রুত উন্নয়ন সহ্য করতে না পেরে প্রীতিলতা গংরা বঙ্গভঙ্গ রদের সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু করে। (বাকি অংশ আগামীকাল)
×