ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ

ঐতিহ্য ও কিংবদন্তির মসলিন, স্বত্ব রক্ষার নতুন যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঐতিহ্য ও কিংবদন্তির মসলিন, স্বত্ব রক্ষার নতুন যুদ্ধ

মোরসালিন মিজান মসলিন সূক্ষ্ম বুননের সুতি বস্ত্র বিশেষ। হ্যাঁ, বস্ত্র বিশেষ। তারও বেশি বিস্ময়! সারা দুনিয়ার শৌখিন মানুষ প্রাচীন বাংলার এই আবিষ্কারে বুদ হয়ে আছেন। সেই কবেকার ইতিহাস! এখনও বাঙালীর রুচি শিল্পীমন ও মানসের পরিচয় বহন করে মসলিন। আজকের বাংলাদেশকে গৌরব দেয়। আর বেদনার যে ইতিহাস, সবার জানা। দীর্ঘকালের ব্যবধানে বাংলার বস্ত্র শিল্পের অসামান্য অবদান হারিয়ে গেছে। বহু অমূল্য সম্পদের মতোই হয়ে গেছে বিলুপ্ত। তাই বলে মসলিন তো অন্য কারও হয়ে যেতে পারে না। ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, তেমন দাবিও উঠছে! কোন কোন দেশ আমাদের উর্বর মাটির ফসল নিজেদের করতে বিচিত্র তথ্য প্রচার করছে। এ অবস্থায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার কাজটি করেছেন দৃক পিকচার গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলাম। মসলিন আমাদের- এই সত্য প্রমাণে কার্যকরী কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। এই কাজে তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করছে সরকার। যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজন করা হচ্ছে মসলিন পুনরুজ্জীবনের উৎসব। বর্ণাঢ্য উৎসব থেকে মসলিন যে কেবলই বাংলাদেশের, সে তথ্য সকল প্রমাণসহ তুলে ধরা হবে। এরই মাঝে বিপুল উৎসবের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করছে জাতীয় জাদুঘর, দৃক পিকচার লাইব্রেরি লিমিটেড ও ব্র্যাক (আড়ং)। আগামী শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে মাসব্যাপী মসলিন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে উৎসবের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে উৎসব চলবে আগামী ৪ মার্চ পর্যন্ত। আয়োজকরা জানান, উদ্বোধনী দিন জাতীয় জাদুঘরে বিশেষ মসলিন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা মসলিন বিশেষ ব্যবস্থায় এখানে প্রদর্শন করা হবে। ইউরোপ ও ভারতের বিভিন্ন সংগ্রাহকদের কাছ থেকে ধার হিসেবেও প্রাচীন বাংলার মসলিন শাড়ি ও পোশাক আনা হয়েছে। দৃকের আনা এসব মসলিন প্রদর্শনীতে রাখা হবে। থাকবে সুইজারল্যান্ডের তৈরি মসলিনের নমুনা। জানা যায়, দৃকের তত্ত্বাবধানে ঢাকার বর্তমান তাঁতশিল্পীদের দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু মসলিন তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো দেখা যাবে গ্যালারিতে। এখানেই শেষ নয়, মসলিন বোনার যন্ত্র ও আনুষঙ্গিক উপকরণ স্থান পাবে প্রদর্শনীতে। উৎসব বিস্তৃত হবে আহসান মঞ্জিল পর্যন্ত। আয়োজক সূত্র জানায়, ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এই জাদুঘর প্রাঙ্গণে মসলিন সন্ধ্যার আয়োজন করা হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে তুলে ধরা হবে মসলিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। থাকবে গীতিনৃত্য নাট্য ও লেজার শো। উৎসবের খুব জরুরী অংশ সেমিনার ও কর্মশালা। ৭ ফেব্রুয়ারি সেমিনার আয়োজন করা হবে। এর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এতে বাংলাদেশী গবেষকদের পাশাপাশি যোগ দেবেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক মসলিন গবেষক। বিদেশী গবেষকদের সামনে মসলিনের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ। ৮ ফেব্রুয়ারি একই লক্ষ্যে বিদেশী অতিথিদের মসলিন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁয়ের আশপাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জামদানী পল্লী পরিদর্শনে নেয়া হবে। এসবের বাইরে, পরবর্তীতে মসলিন বিষয়ক ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্র নির্মাণ, এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার, মসলিন বিষয়ক বই পুস্তক ক্রয়, প্রাচীন বস্ত্র সংরক্ষণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মসলিন বিষয়ক প্রামাণ্য পুস্তক ও স্মরণিকা মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হবে। ভবিষ্যতে জাতীয় জাদুঘরে মসলিন গ্যালারি প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেয়া হবে। মসলিনের পুনরুজ্জীবনে কাজ অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানান আয়োজকরা। গত কয়েকদিন ধরেই জাতীয় জাদুঘর এই আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। একটু আধটু বিষয়টি সম্পর্কে জানা যাচ্ছিল। আর তারপর রবিবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, দৃকের সিইও সাইফুল ইসলাম ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সংশ্লিষ্ট অনেকেই উপস্থিত থাকায় মসলিনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ভাল জানা যায়। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, মসলিন বাংলাদেশের সম্পদ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ যে গাছ থেকে তুলো সংগ্রহ করে মসলিন তৈরি করা হতো তা কেবল বাংলাদেশই ছিল। অথচ এখন পার্শ্ববর্তী একটি দেশ মসলিনের স্বত্ব দাবি করছে। মসলিন তাঁদের ছিল না কখনোই। নিজেদের এসব অধিকার আদায়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ লড়ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকার সম্পর্কে সব সময় সজাগ থাকেন। মসলিন পুনরুজ্জীবিত করার উৎসব, এ কারণেই তাঁর মন্ত্রণালয় আছে বলে জানান তিনি। মসলিন নিয়ে নতুন সংগ্রামের বিস্তারিত তুলে ধরেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে আমি দেখেছি মসলিন নিয়ে অনেক ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। অমূল্য সম্পদ সর্বপ্রথম আমাদের এই অঞ্চলের কারিগররা আবিষ্কার করেন। অথচ ইতিহাসটি আড়াল করে দাবি করা হচ্ছে মসলিনের স্বত্ব ভারতের। দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাইফুল বলেন, বাংলাদেশের মসলিন পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ সম্পদ আর কারও হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটি বাংলাদেশের সম্পদ। এই দাবির সমর্থনে প্রচুর তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিকভাবে এগুলো তুলে ধরতে হবে। এ কারণেই মসলিন পুনরুজ্জীবন উৎসবের আয়োজন। আয়োজনটি সফল করতে সকলের সহায়তা কামনা করেন জাদুঘরের মহাপরিচালকও। প্রাচীন বাংলার বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় মাথা তুলে সামনে আসুকÑ সকলের তাই প্রত্যাশা।
×