ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গভবনের হাই প্রোফাইল বৈঠক সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ সূত্র

বিতর্কের পথ তৈরি না করার পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিতর্কের পথ তৈরি  না করার পরামর্শ

বিকাশ দত্ত ॥ বঙ্গভবনের বহুল আলোচিত মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিতর্কের পথ তৈরি না করে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। সংযত হয়ে কথা বলা ও বাড়াবাড়ি না করতে বলা হয়েছে। তবে অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্য নিয়ে সুপ্রীমকোর্ট অঙ্গন থেকে শুরু করে দেশব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এমনকি এ বিষয় নিয়ে জাতীয় সংসদের সিনিয়র সদস্যরাও দ্বিমত পোষণ করেন। সিনিয়র সদস্যগণ বলেন, ওনার কোন এজেন্ডা আছে। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে সঠিক বলে বিএনপি বলে বর্তমান সরকার অবৈধ। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে যখন একের পর এক প্রতিক্রিয়া আসছে এরই মধ্যে হঠাৎ করে ২৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। যদিও অংশগ্রহণকারী কেউ কেউ ওই বৈঠককে সৌজন্য ডিনার হিসেবে বললেও মুখ্য বিষয় ছিল প্রধান বিচারতির বক্তব্যকে নিয়ে আলোচনা। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের কারণে একদিকে বিচার বিভাগ, অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছিল। বৈঠকে প্রধান বিচারপতিকে সংযত হয়ে কথা বলা এবং এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে যাতে বিরোধী দল আন্দোলনের সুযোগ না পায়। এছাড়া সেটেল বিষয়গুলো নিয়ে আর যাতে বিতর্ক না হয় সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। যদি দলই ক্ষমতায় না থাকে তাহলে প্রধান বিচারপতি কিভাবে থাকবেন। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের কারণে ক্ষমাতসীন দল অনেকটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। কারণ প্রধান বিচারপতি এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন যাতে করে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। এর কয়েকদিন পর বলেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা অসাংবিধানিক। তিনি বলেন, অতীতে চুরি-ডাকাতি করলেও এখন থেকে এসব আদালতে চুরি-ডাকাতি করতে দেয়া হবে না। দেশের আইন বিশেষজ্ঞ, বর্তমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী, শ্রম আপীলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অন্য বিচারপতিগণ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহনের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিদের রায় লেখা বেআইনী ও অসাংবিধানিক। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে কোন প্রধান বিচারপতি তার প্রধান বিচারপতি হিসেবে বর্ষপূর্তির কোন বাণী দেননি। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতিবৃন্দ এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা কোনভাবেই প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না। অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিগণ যুগ যুগ ধরে রায় লিখে আসছেন। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিভিন্ন দেশে এ নিয়ম চলে আসছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি অতীতের বিচারপতিদের উদ্দেশে বলেন, তারা আইন জানতেন না। এরপর ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদেও এ বিষয় নিয়ে অনির্ধারিত বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেখানে সিনিয়র সদস্যগণ বলেন, অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক নয়। অতীতের রায় অসাংবিধানিক হলে রাষ্ট্রের সকল ভিত্তিই অসাংবিধনিক হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি নিজেও অসাংবিধানিক হয়ে যান। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর বিএনপিপন্থী আইনজীবী সমিতি প্রধান বিচারপতির বক্তব্য সমর্থন করে সংবাদ সম্মেলন করে। অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, তার বক্তব্যের ফলে প্রশ্নের মুখে পড়বে মাসদার হোসেন মামলাসহ পঞ্চম সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায় বাতিলসহ অনেক রায়। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে সই করা হয়। এই চর্চা দীর্ঘদিনের। অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয় তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়ত টিকবে না। কারণ মাসদার হোসেন মামলার রায় বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পর লিখেছিলেন। আর এ চর্চা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে এমনকি ইংল্যান্ডেও আছে। ২০ জানুয়ারি এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন, বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী বলে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তা প্রধান বিচারপতির নিজস্ব ব্যাপার। এটা আদালতের কোন সিদ্ধান্ত নয়। এমন হলে অনেক বিচারপতি অবসরে যাওয়ার ২-৩ মাস আগে থেকে আর বেঞ্চে বসতে পারত না। ২১ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, অবসরের পর রায় লেখা যাবে না- এমন কোন নির্দেশনা সংবিধানে নেই। তাই যে বিষয়টি সংবিধানে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই তাকে সংবিধানপরিপন্থী বলা যাবে না। ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, সংযত হয়ে কথা বলুন। অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিদের রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থী- প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্য অনাকািক্সক্ষত ও অনভিপ্রেত, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ২৮ জানুয়ারি বৈঠকে উপস্থিত আইনমন্ত্রী ও এ্যাটর্নি জেনারেল নৈশভোজের কথা বললেও মূলত প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পর সারাদেশের জনগণের মধ্যে কানাঘুষা চলছিল- কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা কেউ-ই মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানাচ্ছে, এর আগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সে সময়ে বহুল আলোচিত চায়ের দাওয়াত জানানো হয়েছিল। এবার প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন তার নানা ধরনের বক্তব্যের পর তাকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও এ্যাটর্নি জেনারেলের বৈঠক হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে নাড়া দেয় কী হয়েছিল বৈঠকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি সর্বোপরি দেশের ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট না হয় সে বিষয়ের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
×