স্টাফ রিপোর্টার ॥ কবিতা মানেই শুধু মননের খোরাক নয়, কবিতাও হতে পারে প্রতিবাদের হাতিয়ার। স্বদেশের চেতনাকে লালন করেই গড়ে ওঠে কবিতার শরীর। সেই সূত্রে কবিও হয়ে ওঠেন সমাজ পরিবর্তনের অগ্রনায়ক কিংবা প্রগতির পথিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কবির রচিত কবিতা রেখেছে সোচ্চার ভূমিকা। কবিদের আদর্শিক সেই সংগ্রামের ধারাবাবিকতায় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বানে ১৯৮৭ সালে প্রথম শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসব। এ বছর অনুষ্ঠিত হবে ৩০তম উৎসবটি। দুই দিনব্যাপী উৎসবের সূচনা হবে কাল সোমবার পয়লা ফেব্রুয়ারি। চলমান সময়কে ধারণ করে এবারের সেøাগান নির্ধারিত হয়েছে ‘কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে উৎসব উদ্বোধন করবেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত উৎসবে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ও নবীন-প্রবীণ কবিসহ ভারত, নরওয়ে, সুইডেন, স্লোভাকিয়া, মরক্কো, তাইওয়ান ও নেপালের আমন্ত্রিত কবিরা। এবারের উৎসবের প্রাক্কালে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও নন্দিত কবি রফিক আজাদ। তার সুচিকিৎসার জন্য সহযোদ্ধা কবিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্যের দাবি জানিয়েছেন।
ত্রিশতম উৎসব উপলক্ষে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন এবারের উৎসব আহ্বায়ক কবি রবিউল হুসাইন, যুগ্ম-আহ্বায়ক কবি কাজী রোজী, পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ, কবি ও কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি হালিম আজাদ, উৎসবের প্রচার প্রচার উপ-পরিষদের আহ্বায়ক হালিম আজাদ, কবি নাসির আহমেদ, ছড়াকার আসলাম সানী, কবি আমিনুর রহমান সুলতান, কবি রফিক আজাদের ছেলে অভিন্ন আজাদ প্রমুখ। উৎসবের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত কবি রফিক আজাদের উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এই কবির সুচিকিৎসার জন্য তাকে দ্রুত এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানানো হয়। পরিষদ সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, রফিক আজাদ শুধু বরেণ্য কবিই নন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশপ্রেমিক এই কবি গত পনেরো দিন ধরে রাজধানীর শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিইউতে আছেন। তবে অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। তাই চিকিৎসার জন্য বিশেষ বিমানে (এয়ার এ্যাম্বুলেন্স) বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি করছে জাতীয় কবিতা পরিষদ।
অভিন্ন আজাদ বলেন, বাবার কিডনি, ডায়াবেটিস, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা রয়েছে। এখানে চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা করছেন কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে এই রোগের আসু সমাধান সম্ভব নয়। তাই সিঙ্গাপুরের মতো রাষ্ট্রে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়ত বাবাকে সুস্থভাবে দেখতে পেতাম।
উৎসব প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। পয়লা ফেব্রুয়ারি পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথমে সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হবে। এরপর নজরুলের সমাধি সৌধে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হবে পুষ্পস্তবক। সকাল ১০টায় উৎসব আঙিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার চত্বরে ত্রিশতম উৎসবটি উদ্বোধন করবেন বরেণ্য কবি ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। পরিবেশিত হবে উৎসব সঙ্গীত। এরপর চলবে সারাদেশ থেকে নিবন্ধিত কবিদের কবিতাপাঠ, সেমিনারসহ নানা অধিবেশন। এবারের উৎসবের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত কবিরা তাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ‘কবিতা মৈত্রীর ও কবিতা শান্তির’ বিষয়ে কথা বলবেন।
লিখিত বক্তব্যে তারিক সুজাত বলেন, বাংলাদেশের কবিরা চিরকালই প্রগতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এক্ষেত্রের বিশ্বের সকল ভাষার সংগ্রামী কবি ও কবিতার ধারার সঙ্গে বাঙালী কবিদের লড়াই একই মন্ত্রে গাঁথা। একুশ আমাদের জন্য অন্তহীন সম্ভাবনার উৎস। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সকল ভাষাসৈনিক ও ভাষা শহীদদের। জাতীয় কবিতা উৎসব দিয়েই শুরু হয় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। শহীদের রক্তমাখা ফেব্রুয়ারি বার বার আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে প্রতিবাদী হতে। এবারের উৎসব স্লোগান প্রসঙ্গে বলেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নিয়েই বাংলাদেশের কবিরা অব্যাহতভাবে গত তিন দশক ধরে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। নিকট সময়ে এই বাংলার মাটিতেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। তাই ৩০ লাখ শহীদের ঋণ কিছুটা হলেও আমরা শোধ করতে পেরেছি। এ কারণেই এবারের স্লোগান ‘কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির।’
রবিউল হুসাইন বলেন, গত তিনটি দশক ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় কবিতা উৎসব। এটি এখন জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসবের পরিণত হয়েছে। কবিতা নিয়ে যে দেশের মানুষ ৩০ বছর পথ চলতে পারে সে দেশের মানুষ কখনও পরাজিত হবে না। বিজয়ী জাতি হিসেবেই আমরা এগিয়ে যাব সম্মুখের পানে।
নাসির আহমেদ বলেন, কবিতাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় কবিতা পরিষদ। এ ধারাবাহিকতা চলছে।
এবারের উৎসবে অংশ নিচ্ছে ভারত, সুইডেন, নেপাল, নরওয়ে, স্লোভাকিয়া, মরক্কো ও তাইওয়ানের কবিরা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কবিদের মধ্যে রয়েছেন বীথি চট্টোপাধ্যায়, সেবন্তী ঘোষ, আনসার উল হক, রাসবিহারী দত্ত, শঙ্কর সাহা, মোহর চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ দাস, যোগমায়া চাকমা, সঙ্গীতা দেওয়ানজী, আকবর আহমেদ ও চন্দ্রিমা দত্ত। এ ছাড়াও দেশটি থেকে অংশ নেবেন প্রাবন্ধিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য এবং আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র মিত্র ও অনিন্দিতা কাজী। সুইডেন থেকে অংশ নেবেন কবি লারস হেগার, বেনত্্ বার্গ ও লত্তে সেদেরহোলম। নরওয়ে থেকে অংশ নেবেন এরলিং কিতেনসেন, স্লোভাকিয়া থেকে মিলান রিচার ও মরক্কো থেকে বেনাইসা বোমালা। তাইওয়ান থেকে অংশগ্রহণ করবেন লী কুই-শিন, লীন ফো-অর, লী রিও-ইয়াং, ড. ফাং ইয়া-চীন, তাই চীন-চো ও চীন জিউ-জেন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: