ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কন্ট্রোল রুম, ওয়াচ টাওয়ার ছাড়াও থাকছে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা

বইমেলা ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বলয় সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

বইমেলা ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বলয় সৃষ্টি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ লেখক অভিজিত রায় ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন হত্যা এবং মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলার ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় বইমেলায় প্রকাশক ও পাঠকের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে দাবি করেছেন নিহতদের পরিবার। যদিও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ মনে করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কোন কিছুই বইমেলায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে এবারের বইমেলায় থাকছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা। মেলা প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা। থাকছে একাধিক কন্ট্রোলরুম ও ওয়াচ টাওয়ার। দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশি শেষে মেলায় ঢুকতে দেয়া হবে। অতিরিক্ত নিরাপত্তা মেলাকে আরও সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করবে। এতে কোন প্রকার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে বাংলা একাডেমি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা। আগামীকাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হচ্ছে একুশে বইমেলা। চলবে ভাষার মাসজুড়ে। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে মেলা প্রাঙ্গণ। আর ছুটির দিনগুলোতে মেলা শুরু হবে বেলা এগারোটায়। চলবে যথারীতি রাত আটটা পর্যন্ত। সোমবার মেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার বইমেলায় নিরাপত্তা থাকছে বিগত যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি। এর প্রধান কারণ লেখক অভিজিত রায় ও প্রকাশক দীপন হত্যা, মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিন জনকে আহত করা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গত বছর বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারী নিপীড়নের ঘটনা। নারী নিপীড়নের ওই ঘটনায় একজন গ্রেফতার হলেও অন্য তিনটি ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী লেখক ড. অভিজিত রায়কে টিএসসিতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি বইমেলায় অংশ নিতেই দেশে এসেছিলেন। বইমেলায় তাঁর বইও প্রকাশিত হয়। অভিজিত রায়ের লেখা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামক বইটি শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। তারই জের ধরে গত বছরের ৩১ অক্টোবর দুপুরে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৩১ নম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে (৪০) ঘাড় ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। একই দিন অভিজিত রায়ের লেখা ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ ও ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামের দুটি বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরে হামলা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়া সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর ৫ তলা বাড়ির চতুর্থ তলায় প্রকাশনী সংস্থাটির কার্যালয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল (৫০), লেখক এবং ব্লগার প্রকৌশলী তারেক রহিম (৪২) ও রণদীপম বসুকে (৪০) হত্যাচেষ্টা করা হয়। এ তিনটি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছে ডিএমপি। অভিজিত রায়ের হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তাঁর বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অজয় রায়। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অভিজিতের হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় এবারের বইমেলায় পাঠক ও প্রকাশকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি মেলায় আগতদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। প্রকাশকরা স্বাভাবিক কারণেই নানা হিসাব-নিকাশ করে বই প্রকাশ করবেন। পাঠকরা মুক্তচিন্তার বই থেকে বঞ্চিত হবেন। অব্যাহত হুমকির মুখে আস্তে আস্তে মুক্তচিন্তার মানুষরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এ ধারা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল ধারা ব্যাহত হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ ধরনের মানুষদের হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়া রাষ্ট্রের জন্য অশুভ লক্ষণ। এমনটা দাবি করেছেন প্রকাশক দীপনের পিতা ঢাবি বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অভিজিত, দীপন ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে প্রগতিশীল প্রকাশক ও লেখকসহ তিনজনকে আহত করার ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়া খুবই খারাপ লক্ষণ। এতে অপরাধীরা উৎসাহিত হতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও অপরাধ ঘটাও বিচিত্র নয়। এ ধরনের প্রগতিশীল ব্যক্তিদের হত্যার ঘটনা এবার বইমেলায় সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনেক প্রকাশক যেসব লেখকের লেখায় ধর্ম, উগ্র মৌলবাদ, জঙ্গীবাদসহ স্পর্শকাতর বিষয় থাকছে তাদের লেখা প্রকাশ করতেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। অনেক প্রগতিশীল লেখক আতঙ্কে লেখা কমিয়ে দিয়েছেন। বা লেখার ধরন পাল্টে ফেলেছেন। প্রকৃত ভাব সংবলিত লেখাটি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লিখতে পারছেন না। ফলে পাঠক মুক্তচিন্তা বা প্রগতিশীলদের লেখা বই থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া অনেক পাঠক ভয় বা আতঙ্ক থেকেও এসব লেখকের লেখা বই কিনবেন না। যার প্রভাব পড়বে সুদূরপ্রসারী। দীপনের হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় অনেক প্রকাশকের মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তারা বাণিজ্যিক ব্যবসা সংক্রান্ত নানা ধরনের বই প্রকাশে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। গভীর জ্ঞান, মানবিক কথাবার্তা বা উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ সম্পর্কিত লেখকদের লেখা বই প্রকাশ করছেন না। এর ফলে উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের ভয়াবহ রূপ সম্পর্কে পাঠকরা আর জানতে পারছেন না। পাঠকরা রীতিমতো এসব বিষয়ে অন্ধকারেই থাকছেন। অদূর ভবিষ্যতে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে জঙ্গীবাদ দমন তো দূরের কথা ভবিষ্যতে আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠাও বিচিত্র নয়। এ ব্যাপারে সৃজনশীল প্রকাশন সংস্থা শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবীন আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, অভিজিত রায় ও দীপন হত্যা এবং শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলায় ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। এতে প্রকাশকরা রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন। অনেক প্রকাশক এবার বইমেলায় উগ্র মৌলবাদ বা জঙ্গীবাদ বা এ ধরনের লেখা বই প্রকাশ করেননি। এবারের বইমেলায় এ ধরনের বই কম প্রকাশিত হবে। এমনকি অনেক প্রকাশক বাংলা একাডেমির বইমেলায় অবস্থান করা না করা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কায় রয়েছেন। এমন পরিস্থিতি প্রকাশনা সংস্থা, পাঠক ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি প্রগতিশীল মানুষদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অন্যথায় আতঙ্ক থেকেই যাবে। যদিও ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, অপরাধীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। তাদের গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানও বলছেন, বইমেলা ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। অভিজিত রায় ও দীপন হত্যা এবং শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলার মাস্টারমাইন্ড গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
×