ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. নিজামউদ্দিন জামি

আজ চতুর্থ সমাবর্তন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ॥ প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

আজ চতুর্থ সমাবর্তন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ॥ প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘৬ দফা’র সমান বয়সী। সব বাধা অতিক্রম করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সগৌরবে এগিয়ে গেছে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে অগণিত শিক্ষার্থী। বর্তমান শিক্ষার্থী ২৪ হাজার, শিক্ষক ৮৯৯ জন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৯০০ জন। ৮টি অনুষদে ৪৩টি বিভাগে পাঠদান হচ্ছে। ৫টি রিসার্চ সেন্টার, ৭টি ইনস্টিটিউট, ২২টি কলেজ, ১২টি হল নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তৃত। লাইব্রেরি, জাদুঘরসহ আরও আছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক লেক। পাহাড়ী ঢলই এর প্রাণস্বরূপ। পাহাড় আর সমতল যেখানে হাত ধরাধরি করে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ১,৭৫৩.৮৮ একর বা ৭.১০ কিলোমিটার। হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর গ্রামে এটি অবস্থিত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে টহফবৎমৎধফ ডিগ্রী আছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, এমবিবিএস, বিডিএস, বিএসসি-ইন টেক্সটাইল, বিএসসি-ইন মেডিক্যাল টেকনোলজি, বিএসসি-ইন নার্সিং। চড়ংঃমৎধফ ডিগ্রী আছে- এমফিল, পিএইচডি, এমডি, এমপিএইচ। আন্তর্জাতিক মানের অনেক শিক্ষক-পণ্ডিত এখানে পাঠদান করেন। প্রফেসর এ আর মল্লিক (ভিসি), সাহিত্যিক আবুল ফজল, প্রফেসর আবদুল করিম, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী, মোঃ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ড. জামাল নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হুমায়ুন আজাদ, প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী (বর্তমান ভিসি), প্রফেসর মোহীত উল আলম প্রমুখ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উদ্যান হলেও এর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। আবাসিক হলগুলোর খাবারের মান ও সিট ব্যবস্থাপনা সুখকর নয়। কমপক্ষে আরও ৪-৬টি হল জরুরী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেন সার্ভিস চালু আছে। তবে ট্রেন এবং ট্রেনের রাস্তার হালহাকিকত নাজুক। তাছাড়া ট্রেনের বগি নিয়ে শিক্ষার্থীদের দখলদারিত্ব লেগেই আছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। হ্রাস পেয়েছে হলকেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া চর্চাও। অতীতে শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে। বিষয় স্বল্পতা দূরীকরণ, যুগোপযোগী বিষয় এবং সিলেবাস প্রণয়নই একটি শিক্ষাঙ্গনকে বহুদূর নিয়ে যেতে পারে। অবকাঠামোগত সমস্যা আছেই। শিক্ষক রাজনীতি ক্রমশ ম্লান হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতির অসহিষ্ণুতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বহুলাংশে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সার্বিক অর্থে ঝিমিয়ে পড়েছে। এমফিল, পিএইচডিসহ অন্যান্য গবেষণা ক্ষেত্রে ভোগান্তি কমেনি, বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভাগীয় গবেষণাপত্রগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ‘পদোন্নতি’ প্রাপ্তির হাতিয়ার হিসেবে। এসব গবেষণাপত্র বিভাগের দেয়াল টপকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পৌঁছে না। অপরদিকে অনভিজ্ঞরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ঢুকে পড়েছে, অভিজ্ঞরা বঞ্চিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা শেষ কবে বেরিয়েছে তাও জানা নেই অনেকের। রক্ত-লাশ-কোন্দল-ধাওয়া-পাল্টার ধাওয়ার ঘটনা কমলেও এখনও পরোপুরি বন্ধ হয়নি। স্বীকার করতেই হয়, সেশনজট অনেকাংশে কমেছে। বর্তমান ভিসির কাছে এসবই চ্যালেঞ্জ! শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ধীরে চলো’ নীতিকে মেনে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৫ (১৯২১-২০১৬) বছরে ৪৯টি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৯১) ২৫ বছরে সমাবর্তন হয়েছে ৪টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ (১৯৬৬-২০১৬) বছরে সমাবর্তন করছে ৪টি। অর্থাৎ সাড়ে ১২ বছরে ১টি। বহু চড়াই-উৎরাই মহাসমারোহে আজ (৩১ জানুয়ারি, ২০১৬) কাক্সিক্ষত চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব নতুন আশার সঞ্চার করেছেনÑ এটাই প্রত্যাশিত। সমাবর্তন যদিও শিক্ষার মান নির্ণয় করে না, তথাপি এ কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গতি সঞ্চার করে, শিক্ষার্থীদের স্বপ্নবুননে সহায়ক হয়। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকাসমূহে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তচিন্তার বিচরণও অবাধ হবে নিশ্চয়। তারুণ্যের কলকাকলিতে মুখর থাকবে প্রিয় প্রাঙ্গণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের পুনর্মিলনীতে জানিয়েছেন, গবেষণার জন্য তারা ১০০ কোটির টাকার তহবিল গঠন করেছেন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছেÑ এসব তারই সূচক। যুদ্ধদিনের কথা না বললে অপূর্ণ থাকবে রচনাটি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ৮ মার্চে উপাচার্য এ আর মল্লিকের সভাপতিত্বে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। আহ্বায়ক হন প্রফেসর মোঃ ফজলী হোসেন। ২৬ মার্চ আলাওল হলকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষকরা ইতিহাসের প্রথম প্রতিরোধ করেন। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তা টিকে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে শিক্ষকরা নিজ নিজ এলাকায় আশ্রয় নেন। বাইরের শিক্ষকরা ছিলেন রাউজানের কু-েশ্বরীতে। পরে ভারত ও অন্যান্য জায়গায় তারা ফিরে যান। জাফর ইমামের নেতৃত্বে শেষের দিকে আবারও ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন মুক্তিবাহিনী। বিজয়ের পর ২৫ ডিসেম্বর তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। এখানকার শহীদদের তালিকাও দীর্ঘ। সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে সীমান্তে শহীদ হন চাকসুর জিএস আবদুর রব। সঙ্গে শহীদ হন ভূপেন। এছাড়াও ইতিহাসের ছাত্র ফরহাদ হোসেন, দর্শনের শিক্ষক বাবু অবনীমোহন দত্ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আবুল মনসুর, মোহাম্মদ হোসেন, মনিরুল ইসলাম খোকা ও মোস্তফা কামাল, বাণিজ্য বিভাগের খন্দকার এহসানুল হক অনসারী, অর্থনীতির আবদুল মান্নান ও নাজিম উদ্দিন খান, ইংরেজীর আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্বের মোঃ ইফতেখার উদ্দিন, প্রকৌশল বিভাগের প্রভাস কুমার বড়ুয়া ও সৈয়দ আহমদ প্রমুখ পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে শহীদ হন। প্রকৌশল বিভাগের চেনম্যান মোহাম্মদ হোসেন চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে শহীদ হন। এছাড়াও স্বাধীনতাউত্তর নানা আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছেন, রাজনীতির বলি হয়েছেন। সে বিবেকের তাড়না এখনও আমাদের তাড়া করে। ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ চাকসুর প্রথম নির্বাচন, ১৯৭২ সালে ২৬ জুন দ্বিতীয় নির্বাচন, ১৯৭৪ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয় নির্বাচন, ১৯৭৯ সালে ২৭ অক্টোবর চতুর্থ নির্বাচন, ১৯৮১ সালের ১৯ মার্চ পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ও শেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। এখন সবই ইতিহাস! শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিজ্ঞান-কলা-রাজনীতি-প্রশাসন সর্বত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সরব পদচারণা আমাদের আশা জাগায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা বিভ্রান্ত এ বিজাতীয় মতবাদ প্রচার করে রাষ্ট্রেরসমূহ ক্ষতি করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজাবার সময় এখনই। ’৫২, ’৭১ এর চেতনায় নিজেদের ঋদ্ধ করা না গেলে সবই বৃথা। বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র-শিক্ষকের প্রাণের উৎসব ‘চতুর্থ সমাবর্তন’ সফল হোক। লেখক : শিক্ষক, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×