ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(৩০ জানুয়ারির পর) তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ হয়েছিল। তাজউদ্দীন নিজেই নাকি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেনÑ এ তথ্য মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তাজউদ্দীনকে ডালিম বিস্তর লেকচার দিয়েছেন, প্রত্যুত্তরে দেখা যাবে তাজউদ্দীন তেমন ৎবংঢ়ড়হফ করছেন না। ডালিমের সন্দেহ হয়েছিল তিনি জাসদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু কর্নেল তাহের থেকে শাজাহান সিরাজ সবাই একবাক্যে তা অস্বীকার করেছেন। ডালিমের মতে, “তার সঙ্গে দুদিনের আলোচনায় একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা গেল ভারত সম্পর্কে তার একটা বিশেষ দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা রয়েছে যার বাইরে তিনি যেতে পারছেন না।” [পৃ. ৪৬৫] মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ‘এ কারণে’ ডালিমরা তাজউদ্দীনকে পছন্দ করেননি। ভারত সোভিয়েতের প্রতি তাদের একটা শারীরিক ঘৃণা ছিল। সোভিয়েত নাবিকদের কর্ণফুলী থেকে মাইন অপসারণও তারা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র মনে করেছেন। ডালিম একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন, সরকার তাদের ওপর নজর রাখছিল এবং ঢাকার এসপি মাহবুব তাকে এ বিষয়ে সতর্কও করে দেন। ডালিমকে তিনবার হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। ডালিমের মতে এটি ছিল সরকারী প্রচেষ্টা। দেশের বিবরণীতে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন এবং সরকারী দলের দুর্নীতির কথা বলেছেন। সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। আওয়ামী শাসন সম্পর্কে যেসব বিষোদগার সাধারণত এখন বিএনপিরা করে থাকে সেসব বিষোদগার আছে। তবে এর মধ্যে চোখ এড়িয়ে যায় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো জেনারেল শফিউল্লাহর মন্তব্য। ১৯৮৭ সালে লন্ডনের জনমত পত্রিকায় জেনারেল এই সাক্ষাতকারটি দিয়েছিলেন। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল- “শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক বাহিনীর উন্নতির পক্ষে ছিলেন না, এ কথা কি সত্য?” উত্তর : “হ্যাঁ, আমি বলব এ কথা সত্য।” [পৃ. ৪৫২] এ কথা কতখানি সত্য পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। কিন্তু মূল বিষয় যেটি বলতে চেয়েছি তা হলো, বাংলাদেশের সামরিক সদস্য তিনি বিভিন্ন দল বা মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন কিন্তু তাদের মনের গড়ন একই রকম। তারা মনের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করতে পারেন না। ডালিম যে কারণে পরিচিতি অর্জন করেছেন অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড তার বিবরণ দিয়েছেন বিংশ অধ্যায়ে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের পটভূমিটা ডালিম তার লেখায় এভাবে তৈরি করেছেন- ১. শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও জাতির পিতা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি মহল ‘বদ্ধপরিকর’ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর থেকেই। ’৭১ সালে তিনি সংগ্রামে ছিলেন না। সেই সময় “এক অখ্যাত মেজরের ডাকে সাড়া দিয়ে” বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। “এ সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করা কখনই সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাব ছিল শেখ মুজিবের। তারই ফলে জাতি যখন হয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল তখন শেখ মুজিব চরম সুবিধাবাদীর মতো আপস রফায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে। জনগণের সব আশাকে নস্যাত করে দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের সঙ্গে না থেকে কারাবরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন পাকিস্তানে।” [পৃ. ৪৮০] শুরু থেকেই এ অভিযোগ ডালিমরা করেছেন এবং এ বিষয়ে ইতোমধ্যে মতামত ব্যক্ত করেছি। ডালিমরা ইচ্ছে করে ভুলে যান বঙ্গবন্ধু উপাধিটি দেয়া হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৩ এপ্রিল। স্বাধীনতার ঘোষণায় তাকেই স্বাধীনতার জনক বলা হয়েছে এবং সেটা মেনেই ডালিমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ২.বঙ্গবন্ধু “বাকশাল গঠন করে একনায়কত্ব কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য রাজনীতি ও সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গেল।” [পৃ. ৪৭৮] ৩. “শিকড় গেড়ে বসার আগেই একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক মহল থেকে অনেকেই ইঙ্গিত দিলেন, সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক হলেই সম্ভব হবে এই একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জাতিকে মুক্ত করা। তাদের এ ধরনের ইঙ্গিতের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমরা।” ওসমানী মন্তব্য করেছিলেন, “মুজিবকে সরাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?” [পৃ. ৪৭৮-৭৯] ৪. “শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিপ্লব ঘটিয়ে শেখ মুজিবের একনায়কত্ব ও বাকশালের পতন ঘটাতে হবে।” [পৃ. ৪৮১] পরিকল্পনা এগিয়ে চলে। সেনা পরিষদের সঙ্গে মিটিং হয় লে. কর্নেল রশীদ ও ফারুকের। “তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রশ্নে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।” [পৃ. ৪৮১] তারা সামরিক অভ্যুত্থানের প্রস্তাব দেয় এবং জানায় খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে তারা বিকল্প সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। আলাপ-আলোচনার পর স্থির হয় জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হবে। এবং একে খন্দকারের বদলে এমজি তোয়াবকে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হবে। খোন্দকার মোশতাক এসব বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন। ডালিমদের মনে হয়েছিল, ওপরের দিকের অনেক নেতা মুজিব ও ভারতবিরোধী। মোশতাককে তাদের নেতা বলে মানতে আপত্তি নেই তবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব নেতা বলেছিলেন, “নেতৃত্বে যোগ্যতার বিচারে খোন্দকার মোশতাকের স্থান শেখ মুজিবুর রহমানেরও ওপরে।” [পৃ. ৪৮৩] ১২ আগস্ট তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান সম্পর্কে। গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়Ñশেখ মুজিব, শেখ ফজলুল হক মনি, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ, তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাককে। ডালিমের ভাষ্য অনুযায়ী শেখ মুজিব, শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসা থেকে প্রথম গুলি হয় এবং তিনজন বিপ্লবী শহীদ হলেন। এটি সর্বৈর মিথ্যা। তোফায়েল [তাকে গ্রেফতার করা হয়] ও রাজ্জাক পালিয়ে গেলেও পরে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল থেকে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতির কাছে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। “অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কর্নেল তাহের, কর্নেল আকবর হোসেন, মেজর শাহজাহান ওমর, মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর রহমতউল্লাহ, ক্যাপ্টেন সাজেদ, ক্যাপ্টেন মোস্তাক ও সরাফত [সব অবসরপ্রাপ্ত] এসে হাজির হলো রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছে তারা। বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এলো পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী ইতোমধ্যেই সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পকে নিরস্ত্র করেন তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে।” [পৃ. ৪৯২] অর্থাৎ এরা সবাই কমবেশি জড়িত ছিলেন ষড়যন্ত্রে। শফিউল্লাহ অভ্যুত্থান প্রতিরোধের জন্য নির্দেশ দেন শাফায়াত জামিলকে। তিনি সাড়া দেননি। অনুরোধ করেন খালেদ মোশাররফকে। তিনি জবাব দেন- “ইধহমধনধহফযঁ রং ফবধফ. ঞযব ধৎসু যধং ৎবাড়ষঃবফ ধহফ যিড়ষব ধৎসু যধং পবষবনৎধঃবফ.”. [পৃ, ৪৯৩] এর পরের ঘটনাবলি সবার জানা। পুনরুক্তি করলাম না। ডালিমের মন্তব্যÑ“১৫ আগস্টের বিপ্লব স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন পেয়ে একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।” [পৃ. ৪৯৮] বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ডালিমদের সাহায্যে জেনারেল জিয়া কিভাবে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করলেন তার বিবরণ আছে পরবর্তী অধ্যায়ে। ডালিমরা চেয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করতে এবং ‘প্রপার স্ক্রিনিং’-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করতে। “সেনাবাহিনী থেকে বাকশালিপনা, দুর্নীতিপরায়ণ এবং উচ্চাভিলাষীদের বের করে দিতে হবে।” ডালিম উল্লেখ করেছেন স্পষ্টভাবে-“সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থনদানকারী জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ করা হয় রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা।” [পৃ. ৫০০] এর আগের বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ ঘটনার কথা জানতেন। এই উক্তির পর ধরে নেয়া যেতে পারে ডালিমদের প্রতি জোরালো সমর্থন ছিল তার এবং জেনারেল ওসমানী ছিলেন তাদের প্রশ্রয়দাতা, পরোক্ষভাবে জড়িত। চলবে...
×