ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক ফুলের সমাহার ॥ আগে পরিবার ছিল একই বৃন্তে

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

অনেক ফুলের সমাহার ॥ আগে পরিবার ছিল একই বৃন্তে

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম ...’ সিলেট অঞ্চলের আব্দুল করিমের গাওয়া এই গানটির কথা সুর মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা দিনগুলোর কতই না মধুময় কথা। একটা সময় বঙ্গীয় ব-দ্বীপের প্রতিটি পরিবার ছিল একই বৃন্তে অনেক ফুলের মতো। সকলেই সকলকে নিয়ে ভেবেছে, যেন কেউ ঝরে না পড়ে। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও গ্রামের একই উঠান দিয়ে গোটা পাড়া ঘুরে বেড়ানো গেছে। পঞ্চশের দশকে রান্না হয়েছে একই হাঁড়িতে। সে তো রান্নার হাঁড়ি নয়, যেন মজলিশ। কে আপন ভাইবোন, কে চাচাত জ্যাঠাত ফুপাত ভাইবোন, তা বোঝার উপায় ছিল না। বনেদী পরিবার ও গৃহস্থ পরিবার হয়ে একেবারে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার পর্যন্ত একই চিত্র। এমনকি সম্পর্কে গ্রামের ভাই চাচারাও ছিল পরিবারের স্বজন। বলা হতো একই অন্নে লালিত পরিবার বা একান্নবর্তী পরিবার। দিনে দিনে সেই চিত্র এখন এতটাই বিরল যে, কাছাকাছি তো দূরে থাক টেলিস্কোপেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই চিত্র ফেলে আসা অ-নে-ক দূরে ... তবুও যেন খুব কাছের অতীত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবারের সদস্য বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে পরিবার ভেঙে বসতি গড়ে তোলে নিজেদেরই জমিতে। তারপর পরিবার খ-িত হওয়ার সঙ্গে জমি জিরাতও খ-িত হতে থাকে। বাড়িঘর উঠতে থাকে আবাদী জমির ওপরই। পরিবার ভেঙে টুকরো হওয়ার পালায় একপর্যায়ে নিউক্লিয়ার পরিবারের দিকে ধাবিত হয়। বর্তমানে নিউক্লিয়ার পরিবারও এতটাই খ-িত যে সন্তান বড় এবং বিয়ে হওয়ার সঙ্গেই মা বাবাকে ছেড়ে বসতি গড়ে নিজেদের ভিন্ন ঘরে। গ্রামের একান্নবর্তী পরিবার ভাঙার অধ্যায় শুরু হয় গ্রাম থেকে শহুরে জীবনে ঢোকার পালায়। শহুরে জীবন ধারায় লালিত হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর চিড় ধরতে থাকে অদৃশ্য কাঁচের দেয়ালে। দিনে দিনে যে স্বচ্ছ দেয়ালের উভয় প্রান্তের মানুষ একে অপরকে আকুতি জানিয়ে এগিয়ে আসে আবেগে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কাঁচের দেয়াল আটকে দেয়। এই দেয়াল ভাঙে না, তবে হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেয়। তারপর এগিয়ে চলার অমোঘ নিয়মে একটা সময় একই উঠানের হাঁড়ি ভিন্ন হয়ে পাশের উঠানের উনুনে চড়ে বসে। এভাবে দেখা যায়, অনেক ঘর আর বিশাল আঙ্গিনায় দৃশ্যত কোন দেয়াল নেই তবে ভিন্ন প্রতিটি উঠানের এক কোণায় উনুন বসেছে। যেখানে যার যা রান্না হয়, তার গন্ধ ভেসে যায় পরিবারের অন্য সদস্যদের নাকে। ছিন্ন পরিবার কি একাই তা খেতে পারে! হৃদয়ের বন্ধনের আবেগে তরকারি বিনিময় হয়। এ যেন ফেলে আসা দিনের সেই মধুময়তার এক চিলতে আঁচড়। যার পরশে বন্ধনের গভীরতা উছলে ওঠে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মতো। জীবন বহমান নদীর মতো, থেমে থাকে না। একটা সময় সবই অতীত হয়ে যায়। সেই গানের মতো অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভোলে না কেউ ভোলে ...। বর্তমানের নিউক্লিয়ার পরিবারের সন্তানেরা কীভাবে বেড়ে উঠছে! তারা কি জানে কেমন ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের বন্ধন! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বিষয়গুলো প্রজন্ম জানে না বা জানানো হয় না। জীববিজ্ঞান বলেÑ ধরণীর প্রত্যেক শিশু ধী শক্তি বিকাশ ও স্নায়ুতন্ত্রে একশ’ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যা দিয়ে মস্তিষ্কের সর্বাধিক বিকাশ ঘটে তিন বছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ। এরপর পাঁচ বছরে ৯০ শতাংশ। আট বছরে ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ। বাকি দুই থেকে পাঁচ শতাংশ সারাজীবনে বিকশিত হতেও পারে আবার নাও পারে। মানব দেহের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি স্নায়ু। শিশু নিয়ন্ত্রিত ও মেধাবী হতে শেখে এই নিউরনের মাধ্যমে। একটি নিউরন ১৫ হাজার নিউরনের সংযোগ ঘটিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যার সংযোগ যত বেশি ঘটে এবং শক্ত হয়, তার ধী শক্তি জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায়। শিশুর নিউরনে বিকাশের সময় স্বজনদের কাছে থাকা দরকার। একান্নবর্তী পরিবারে শিশুর বাবা মা ছাড়াও দাদা দাদী নানা নানী পরিবারের স্বজনরা কাছে থেকে শিশুর একাকিত্ব দূর করে দিয়েছে। বেড়ে ওঠার সময় শিশুর সঙ্গে চাহনি দিয়ে হাত পা নিয়ে নাচানাচির মাধ্যমে খেলা করে শিশুকে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে একা নয় তার সঙ্গে অনেকে আছে। শিশু মনের কান্নাও এক ধরণের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে মা এগিয়ে এসে হাত বাড়াতেই প্রাণবন্ত হাসিতে শিশু কোলে উঠে আসে। গাইনোকলজিস্ট ও মনোবিজ্ঞানীদের কথা- ভূমিষ্ঠের পর শিশু যতদিন মায়ের বুকের দুধ পান করে, তখন মা ও শিশু একে অপরের চাহনিতে যে মমত্ববোধ এনে দেয় স্বর্গসুখ হয়ে তাই রয়ে যায় চিরন্তন হয়ে। বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যমিলিতে পরিণত জীবিকার প্রয়োজনে মা তার নবজাত শিশুকে স্বজনের কাছে কখনও কাজের বুয়ার কাছে রেখে চাকরি স্থলে যায়। বাবাকেও যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে। সন্তানের মধ্যে পেয়ে বসে একাকিত্ব। এভাবে বেড়ে ওঠে সে। জীবনের পরবর্তী শিক্ষার ধাপে সে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় মেধাবী ও পারদর্শী হয়। তাকে পেয়ে বসে ইন্ট্রোভার্ট (আত্মকেন্দ্রিকতা)। দেখা যায় একাডেমিক এডুকেশনের বাইরে এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাঠের বাইরে বেশি কিছু শেখে না। বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। এমনও দেখা যায় আপন চাচাত জ্যাঠাত ভাই পাশাপাশি বা কোন অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়েছে, কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। পরিচয়ের পালার পর একে অপরকে চিনছে ঠিকই, তবে এর মধ্যে আপন হয়ে মিশছে সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে। এর অন্যতম কারণ; পারিবারিক বন্ধনের দূরত্ব। একটা সময় পরিবারের সব সদস্য দুপুরের ও রাতের আহার মাদুর পেতে বসে একসঙ্গে করেছে। যখন ডাইনিং টেবিল ছিল না। পরে ডাইনিং টেবিলেও এক সঙ্গে বসা হয় ঠিকই, তবে সেই গভীরতা কেড়ে নিয়েছে আধুনিকতা। রাতের আহার সেরে বেশিরভাগ সময় সকলে বসে যে যার মতো গল্পগুজব করেছে। নিজেদের কথা শেয়ার করার মধ্যে সম্পর্কের যে গভীরতা গড়ে ওঠে, তা আর কোনভাবেই হয় না। নিজের ও নিজেদের আনন্দের কথা শেয়ার করা, দুঃখবোধের কথা ভাগাভাগি করার মধ্যে বন্ধন যে কতভাবে অটুট হয়ে ওঠে তা আজকের দিনে সামান্য বিষয়েই প্রমাণিত হয়। নিজের আবেগের অনুভূতির কথা বলার জন্য খুঁজে পাওয়া যায় না আপনজনকে। কে যে আপন আর কে যে পর তাও বোঝা যায় না। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×