ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বিভাগ চালুর পরও সেবা দিতে ব্যর্থ বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

নতুন বিভাগ চালুর পরও সেবা দিতে ব্যর্থ বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

সমুদ্র হক ॥ সেবাদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থানের পুরস্কারপ্রাপ্তি, চিকিৎসার আরও ১১টি নতুন বিভাগ খোলার পরও উন্নত যন্ত্রপাতিগুলো চালু না হওয়া এবং লোকবলের তীব্র সঙ্কটে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সেবার মান ধরে রাখতে পারছে না। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মধ্য নগরী বগুড়ায় বাইপাস সড়কের ধারে ৫শ’ শয্যার আধুনিক এই হাসপাতাল চালু হয় ২ হাজার ৫ সালে। সরকারী নথিতে নামকরণ করা হয় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) ও হাসপাতাল। কথা ছিল উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ উন্নত পরিষেবা দেবে এই হাসপাতাল। তা আজও হয়ে ওঠেনি। শজিমেক হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের অবকাঠামো দৃষ্টি নন্দন। ক্যাথল্যাব, ম্যাগনেটিক রেজনন ইমেজিং (এমআরআই), কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যানসহ মানবদেহের বিভিন্ন জটিল পরীক্ষার যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা হয়। এসব যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য কয়েকজন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে পাঠানো হয়। শুরুর এই পরিকল্পনা ছিল খুবই ভাল। বছর দুয়েকের মধ্যে বিঘœ ঘটার পালা শুরু হয়। যেমন বিদেশ হতে প্যাকেটবন্দী হয়ে আসা উন্নত যন্ত্রপাতিগুলো আর খোলা হয় না। যে ক’জন চিকিৎসক উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গিয়েছিলন তাদের ক’জন ফিরে আসার পর ঢাকার বড় হাসপাতালে চলে যান। এ অবস্থায় বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল থেকে কিছু উন্নত যন্ত্র ঢাকা ও খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। বাকি যে কয়টি যন্ত্র স্থাপিত হয় তাও অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য টেকনিশিয়ানের অভাবে চালু করা যায়নি। বছর কয়েক আগে মানুষের হার্টের ব্লক নির্ণয়কারী এবং সেই ব্লকে রিং পরানোর ইউনিট ক্যাথল্যাব (এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টিক যন্ত্র) চালু করে মাত্র একজন রোগীর পরীক্ষা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই যন্ত্রে আর রিং পরানো হয়নি (যায়নি)। খোঁজখবর করে জানা যায় এনজিওগ্রাম ঠিকমতো চালানোর অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় (এবং না পাওয়ায়) প্রায় দেড় যুগ ধরে তা পড়ে আছে। সূত্র জানায়, কার্ডিওলজি বিভাগের সঙ্গে যুক্ত এই যন্ত্র চালনা এবং হার্টের রোগীদের দ্রুত ভাল চিকিৎসা দেয়ার জন্য যে লোকবল থাকার কথা তা নেই। দিনে দিনে দেশে হার্টের রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০ শয্যার কার্ডিওলজি বিভাগে নিত্যদিন হার্টের রোগী আসছে ৭০-৮০ জন করে। বেশিরভাগ রোগীকে বেড দেয়া যায় না। আবার ফিরেও দেয়া যায় না। ইকো কার্ডিওগ্রাম ও ইলেকট্রকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) করে যা পাওয়া যায় তার ওপর ভিত্তি করে দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা দেন। রোগীর অবস্থা বিবেচনায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ক্যাথল্যাব চালু থাকলে অনেক হৃদরোগীর রিং পরানো যেত। হালে সড়ক দূর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানের বগুড়া নগরীর এই শজিমেক হাসপাতালে প্রচ- চাপ পড়েছে। আহতদের ভিড় ও চাপ সামলাতে ক্যাজুয়েলটি বিভাগ নেই। লোকবল এতই কম যে সড়ক দুর্ঘটনার রোগী বেশি এলে অন্যান্য সেবার বিঘœ ঘটে। এমনিতেই ৫শ’ শয্যার এই হাসপাতালে গড়ে নিত্যদিন ৮শ’ করে রোগী রাখতে হয়। বিভিন্ন বিভাগে বাড়তি রোগীর সেবা দিতে যে লোকবল দরকার তা নেই। ওপর মহলে বিস্তর লেখালেখি করার পরও কোন সাড়া মিলছে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দেয়ার লক্ষ্যে শজিমেক হাসপাতালে ১১টি নতুন বিভাগ চালু করেছে। উল্লেখ্য, হাসপাতাল চালুর সময় এই বিভাগগুলো ছিল না। পূর্বের বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত নতুন বিভাগগুলো হলো- নিউরো মেডিসিন ও সার্জারি, রেপেরেটরি মেডিসিন, নেফরোলজি, পেডেট্রিক নেফরোলজি, ইউরোলজি, হেমটোলজি, হেপাটোলজি, গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজি, ফিজিও মেডিসিন, প্লাস্টিক বার্ন। মানবদেহের প্রায় সব চিকিৎসার বিভাগ এই হাসপাতালে থাকার পরও অনেক বিভাগে লোকবল নেই। কোথাও অনুমোদিত পোস্টও নেই। উন্নত সেবাদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালে কোন বার্ন ইউনিট নেই। গত বছর বিএনপি-জামায়াতের কথিত আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ রোগীদের কোন রকমে চিকিৎসা দেয়া হয় সাধারণ ওয়ার্ডের ১০টি শয্যাকে আলাদা করে। কথা ছিল এই হাসপাতালে ৫ শয্যার বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপিত হবে। তা আর হয়নি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় দশতলার ভিত দিয়ে নির্মিত হয় অবকাঠামো। পাঁচতলা নির্মিত হওয়ার পর কথা ছিল শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে সব বিভাগ চালু করতে পর্যায়ক্রমে হাসপাতাল দশ তলায় উন্নীত করা হবে। বর্তমানে রোগী বেড়েছে, বিভাগ বেড়েছে অবকাঠামো বাড়েনি। এদিকে প্রায় ১৫ বছর আগে এই হাসপাতাল চালু হয়েছে অথচ আজও সমাজসেবা অধিদফতরের কোন অফিস স্থাপিত হয়নি। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি সরকারী হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও অপারেশনে ওষুধ এবং উপকরণ সরবরাহে সমাজসেবা অধিদফতরের কার্যক্রম থাকবে। শজিমেক হাসপাতালে তা আজও চালু হয়নি। শজিমেকের উপাধ্যক্ষ রেজাউল আলম জুয়েল জানালেন, সমাজসেবা অধিদফতরের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ হাসপাতাল পরিদর্শন করে দ্রুত অফিস স্থাপনের আশ্বাস দেয়ার পরও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সবচেয়ে বড় উন্নত ও আধুনিক এই হাসপাতালটি সেবাদানে পুরস্কৃত হয়েছে তবে আরও উন্নত সেবা ধরে রাখতে পারছে না।
×