ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান -মুনতাসীর মামুন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান  -মুনতাসীর মামুন

(২৭ জানুয়ারির পর) আপনাকে আমাদের এই ৩টি দাবি নিয়ে যেতে হবে রাষ্ট্রপতির কাছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে এ দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। এই দাবিগুলো যদি আদায় করতে অপারগ হন তবে You have got no right to sit on your chair. You will be considered not fit enough to lead this army.’ [পৃ. 408] শফিউল্লাহ যখন বিচলিত তখন জিয়া এসে যোগ দেন ডালিমদের সঙ্গে এবং অফিসারদের শান্ত করে শফিউল্লাহকে বলেন রাষ্ট্রপতিকে প্রস্তাব দিতে ’to accept the demands for the greater interest of the nation and the armed forces.’ [পৃ. 408] তাদের ’demands are quite legitimate.” [পৃ. ৪৩৯] ডালিম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “তিনি সাহস করে ওই ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য রাখবেন সেটা আমাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এতে প্রমাণিত হয় পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মাঝে অনেকেই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ।” শফিউল্লাহ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করে ফিরে এলেন। তার সঙ্গে ছিলেন খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল। ডালিমরা তার সঙ্গে দেখা করলে জানান, রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তিনি সময় চেয়েছেন এবং সেনাপ্রধান বললেন, তাকে সময় দিতেই হবে। ডালিমরা এতে খুশি হলেন না। তারা আজিজ পল্লীতে বৈঠকে বসলেন। অন্যান্য ব্রিগেডের সঙ্গেও যোগাযোগ করলেন। রাতে খবর পেলেন আনমার্কড গাড়িতে সেনাপ্রধান ও শাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দেখা করতে গেছেন। তারা আরও জানলেন রাত সাড়ে ১২টার দিকে রক্ষীবাহিনীর ‘মুভমেন্ট’ শুরু হয়েছে। “রাত আড়াইটার পর বিভিন্ন বর্ডার এলাকা থেকে খবর আসতে লাগল মধ্যরাতের পর থেকে ভারতীয় বাহিনীর অস্বাভাবিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। তার মানে নিজের নিরাপত্তার জন্য শেখ মুজিব শুধু তার অনুগত রক্ষীবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর তার তল্পিবাহক নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখে স্বস্তি পাচ্ছেন না তাই বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যও চেয়ে বসেছেন মৈত্রী চুক্তির আওতায়। দুঃখ হলো, পেশাগত নিজ যোগ্যতায় নয় শেখ মুজিবের বদান্যতায় যারা এক লাফে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বনে গেছেন তারা নিজেদের চামড়া পর্যন্ত বিকিয়ে দিয়ে বসে আছেন শেখ সাহেব এবং তার দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল; জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন তেমন একজন।” [পৃ. ৪৪০] একজন জুনিয়র সেনা অফিসারের সঙ্গে একটি ঘটনা ঘটেছে এক রাজনৈতিক নেতার অনুচরদের। সেটি একেবারে রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, পুরো সেনাবাহিনী পক্ষ হলো এবং জাতির জনককে দুঃখ প্রকাশ করতে বলা হলো। শুধু তাই নয়, তার ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করা হলো। এই ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি হলো, হয়ত সেনাবাহিনীর এই তরুণ অফিসাররা পাকি মানসিকতায় এতই আক্রান্ত ছিলেন যে কোন রকম সিভিল কর্তৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না এবং তারা সেনাবাহিনীর ম্যানুয়েলবিরোধী কাজ করছিলেন। শুধু তাই নয় ষড়যন্ত্র করছিলেন। এই বক্তব্য যদি সঠিক না হয় তাহলে বলতে হবে, ডালিম নিজেকে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অফিসার হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সম্পদ যাকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ভাষ্যে, তা হলো ১৯৭৫ যারা ঘটিয়েছিলেন ১৯৭২ থেকে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে একটি আবহ তৈরি করতে চেয়েছেন। আর জে. জিয়া বা এরশাদ এদের সঙ্গেই ছিলেন এবং নিজেদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন। যে কারণে দেখি জে. জিয়া তার সময়ে জে. এরশাদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ডালিমকে অবসর দেয়া হয়। তিনি সদর দফতরে গেলেন। সেখানে “চরম উত্তেজনা, শফিউল্লাহ অফিসে নেই। তিনি নাকি অসুস্থ। জেনারেল জিয়া আমি এসেছি জানতে পেরে ডেকে পাঠালেন।” [পৃ. ৪৪৩] এরপর তাদের কথোপকথন তুলে দিচ্ছি তাতে বোঝা যাবে আমার পূর্বোক্ত অনুমান সঠিক কিনা। জিয়া সাদরে ডালিমকে গ্রহণ করলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো। তিনি সবকিছু মঙ্গলের জন্যই করেন। এটি মাত্র শুরু, আরও many more heads will roll. তারপর যোগ করলেন-’We must keep in touch and you can count on me for everything just as before. For any personal need my doors are always open to you. উত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে ডালিম বললেন, But you must remain alert as you are out last hopes. Future will say what is there in our common destiny.’’ [পৃ. ৪৪৩] ভাগ্য তাদের আবার একত্রিত করেছিল। ডালিম অবশ্য সেদিন সন্ধ্যায়ই ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। কর্নেল হুদাও সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতেই হুদা তার পদত্যাগপত্রের একটি কপি তার সামনে রেখে বললেন, অফিসিয়াল চিঠি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তার কাছে পৌঁছে যাবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, “তোমরা সবকিছুই একতরফাভাবে দেখ। আমার দিকটা একটু চিন্তা কর না। একদিকে আমার পার্টি অন্যদিকে ওরা। আমি কী করুম। পার্টির কাছে আমি বাঁধা, পার্টি ছাড়া তো আমার চলব না।” [পৃ. ৪৪৪] চাকরি যাওয়ার পর ডালিম ব্যবসা শুরু করেন। এটি নিয়ে একটি অধ্যায় রচিত হয়েছে। এ অধ্যায়ে অনেক বক্তব্য আছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে এ অধ্যায়ে একটি প্যাটার্ন পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ। ডালিম যাদের নিয়ে কোম্পানি খুলেছিলেন তারা হচ্ছেন তার ছোট ভাই স্বপন, ক্যাপ্টেন নূর ও লে. কর্নেল আকবর হোসেন। তারা ভালই ব্যবসা করছিলেন। ডালিম যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তারা হলেন- কামরুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মালেক উকিল, মনোরঞ্জন ধর, ফণিভূষণ মজুমদার, আবদুল মান্নান, এ আর মল্লিক, এম আর সিদ্দিকী, ফরিদ গাজী, নূরুল ইসলাম মনজুর এবং ভোলা মিয়া। তাদের সঙ্গে ঠিকঠিকই যোগাযোগ করেছিলেন কিনা ডালিম তা আজ আর জানা যাবে না। তবে এদের অধিকাংশ ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর কোন না কোনভাবে খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ছিলেন। চলবে...
×