ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে যাচ্ছে ব্রিটিশের পাগল আইন ॥ থাকছে জেল জরিমানা অর্থদণ্ডের বিধান

এবার মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

এবার মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করছে সরকার

আরাফাত মুন্না ॥ জেল-জরিমানা ও অর্থদ-ের বিধান রেখে মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন এ আইনের নামকরণ করা হয়েছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৬’। এ আইনের মাধ্যমে মানসিক রোগে আক্রান্ত নারী-পুরুষের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এর আগে ১৯১২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত ‘দ্য লুনাসি এ্যাক্টে’র মাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিষয়ের বিবাদ নিষ্পত্তি করা হতো, যা বাংলায় পাগল আইন হিসেবে পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ১০৪ বছর পর সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করছে। আইন কমিশনের সূত্র মতে, ১৯৮৭ সালে ভারত এই আইন পরিবর্তন করে মানসিক স্বাস্থ্য আইন এবং পাকিস্তান ২০০১ সালে মানসিক স্বাস্থ্য অর্ডিন্যান্স জারি করে। বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট উদ্যোগ নিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বাত্মক সহযোগিতায় আইনের প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করে আইন কমিশন। পরে দুই বছর আইনটি নিয়ে কাজ করেন তারা। গত বছর জুলাইয়ে কমিশন আইনটি প্রণয়নের লক্ষ্যে সুপারিশসহ খসড়া পাঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সূত্র জানায়, নতুন আইন অনুসারে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া মানসিক হাসপাতাল অথবা সেবালয় প্রতিষ্ঠা করলে দুই বছরের সশ্রম কারাদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত হবেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতরা। মানসিক রোগে আক্রান্ত নন, এমন ব্যক্তিকে রোগী বানিয়ে মিথ্যা সনদ দিলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এক বছর সশ্রম কারাদ- অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। এ ছাড়া উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে মানসিক হাসপাতালে কিংবা সেবালয়ে আটকে রাখলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি এক বছরের সশ্রম কারাদ- অথবা ৫ লাখ টাকা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। মানসিক রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেও তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এ আইনে। সূত্রটি আরো জানায়, এ ধরনের অপরাধ বিচারে প্রতিটি জেলায় একটি করে মানসিক স্বাস্থ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে আইনে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার ছাড়া অন্য কেউ কোন ব্যক্তিকে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বলে সাব্যস্ত করতে পারবেন না বলেও প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন এ আইনে প্রতিটি জেলায় জেলা জজের অধীনে সাব জজ পদমর্যাদার একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি মানসিক আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি নিজের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে অক্ষম হলে নির্ধারিত পারিশ্রমিকে আদালত একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে তার সম্পত্তির ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করবেন। তবে তার বৈধ কোন উত্তরাধিকারীকে সম্পত্তির ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করা যাবে না। অবশ্য এর আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি সম্পর্কে আদালতে বিশেষ প্রতিবেদন জমা দেবেন। সম্পত্তির ব্যবস্থাপক অসুস্থ ব্যক্তির নামে অথবা তার পক্ষে যে কোন সম্পত্তি গ্রহণ করতে পারবেন। তার যে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবেন। তার অংশীদারি কারবারের অবসান করতে পারবেন এবং তার পক্ষে যে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তবে আদালতের অনুমতি ছাড়া মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক, হস্তান্তর, বিক্রি, ভাড়া প্রদান এবং কোন ধরনের বিনিময় করতে পারবেন না। লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে ৫ বছরের বেশি লিজ দিতে পারবেন না। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সম্পত্তির ব্যবস্থাপককে প্রত্যেক আর্থিক বছর শেষ হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে তার দায়িত্বে থাকা সম্পত্তি, সম্পদ, গৃহীত অর্থ, চিকিৎসায় ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণ এবং স্থিতি হিসাব আদালতে জমা দিতে হবে। আইন কমিশনের পাঠানো খসড়ায় দেখা যায়, এতে ১১ অধ্যায়ে মোট ৭১ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও রিভিউ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় নিপতিত ও মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অধিকার, মানসিক হাসপাতাল ও সেবালয়, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও আটকাদেশ, রিসেপশন অর্ডার ছাড়পত্রের প্রক্রিয়া, অভিভাবকত্ব, সম্পত্তি ও অন্যান্য বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ, মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে কতিপয় সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধান এবং বিবিধ। আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর তৃতীয় অধ্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় নিপতিত ও মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারার ক্ষমতাবলে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি যেসব অধিকার পাবেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রকৃতিস্থ সময়ে সর্বক্ষেত্রে সমান আইনী সুবিধা পাওয়া, মানসিক অসুস্থ হওয়া অথবা মানসিক অক্ষমতা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে নাবালক, মহিলা, সংখ্যালঘু এবং অভিবাসী ব্যক্তিদের বৈষম্যের শিকার না হওয়া, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির অংশীদারিত্ব, স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং বোধগম্য উপায়ে তথ্য প্রাপ্তি, প্রাক প্রাথমিক হতে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মূলধারার শিক্ষার সব স্তরে অধ্যয়ন এবং সর্বস্তরে একীভূত শিক্ষায় অংশগ্রহণ, মানসিক চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজনে কর্মক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা শিথিলকরণের সুবিধাপ্রাপ্তি। একই অধ্যায়ের একটি ধারায় একজন মানসিক রোগীর আরও যেসব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নারী হলে পর্যাপ্ত গোপনীয়তা এবং পুরুষদের থাকার জায়গা থেকে পৃথক স্থানে অবস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যৌন বা শারীরিক নিপীড়ন থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং প্রসবোত্তর সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
×