ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফিরে দেখা বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব

ধ্বংসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাহিত্য সভ্যতা সঙ্গীতের জয়গান

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

ধ্বংসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাহিত্য সভ্যতা সঙ্গীতের জয়গান

মোরসালিন মিজান ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুকে। মৌলবাদী তা-বে বিধ্বস্ত শহর। এই বেদনার কথা বিতৃষ্ণার বয়ান প্রাধান্য পেয়েছে সর্বত্র। এ কারণেই হয়ত শুভ উদ্যোগটি খুব বেশি সামনে আসতে পারেনি। অনেকে জানেন না, প্রায় একই সময়ে অভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব। এক বা দু’দিনের নয়, টানা তিন দিনের আয়োজন। বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগ স্থানীয় প্রয়াস হলেও সার্বিক চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। অভিজাতও বটে। বিস্তৃত পরিসরে এখানে তুলে ধরা হয় বঙ্গদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে। রাজধানী ঢাকা থেকে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক-শিল্পীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজন। যুক্ত করা হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে। কলকাতা ও ত্রিপুরা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বিদগ্ধজনেরা। সবাই মিলে জয়গান করেছেন বঙ্গ-সংস্কৃতির। আকালের এই কালে আয়োজনটির বিশেষ মূল্য একটুখানি ফিরে দেখার দাবি রাখে বৈকি। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি শেষে গত ৯ জানুয়ারি শুরু হয় উৎসব। চলে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত। একটি ভেন্যু ছিল শহরের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে ছিল অপর ভেন্যু। উভয় ভেন্যুতে সকাল ৯টায় শুরু হয়ে অনুষ্ঠান চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। সেমিনার, কবিতা, লোকগানসহ নানা পরিবেশনায় মুখরিত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আয়োজকদের মতে, এটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কিংবা ইতিহাসের সম্মেলন নয়। একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির উৎসব। উৎসবের যে চরিত্র দাঁড়িয়েছিল তা দেখে কথার মানে আরও পরিষ্কার হয়। বঙ্গ-সংস্কৃতির স্বরূপ আবিষ্কারে প্রয়াসী হন আয়োজকরা। সংস্কৃতির বিপুল শক্তি কাজে লাগিয়ে শুদ্ধ সুন্দরের চর্চাকে এগিয়ে নেয়ার শপথ নেন। উৎসবের উদ্বোধনী অধিবেশন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতির বিশিষ্টজন ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন। উৎসবের চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এ্যাডভোকেট মোঃ আবু তাহের। অনুষ্ঠানে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি প্রেম ও অবদান বিবেচনা করে সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই কৃতী সন্তান চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম ও বাঁশির জনপ্রিয় শিল্পী ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলামকে। আয়োজকরা তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন। হাতে তুলে দেন সম্মাননা ক্রেস্ট। উৎসবের বিভিন্ন দিনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বঙ্গ-সংস্কৃতি ঘিরে কত রকমের আলোচনা! সুলিখিত প্রবন্ধ। পাঠ। নানামুখী বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে যে রূপ তা উৎসবকে অর্থবহ করে তোলে। দ্বিতীয় দিন ভাষা চত্বরে সকালের অধিবেশনে সেমিনারের বিষয় ছিলÑ বাংলাদেশের নারী শিক্ষার সংস্কৃতি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. সরকার আবদুল মান্নান। আলোচনা করেনÑ ড. আনিস রহমান, জেসমিন খানম, শাহনাজ মুন্নী, ড. এসএ মুতাকাব্বির মাসুদ প্রমুখ। অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মোঃ হানিফ। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক এএসএম শফিকুল্লাহ। একই মঞ্চে বিকেলের অধিবেশনে আয়োজন করা হয় ‘বাংলাদেশে বিজ্ঞান সংস্কৃতি চর্চা ও জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’ শীর্ষক সেমিনার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্যামল চক্রবর্তী। প্রধান অতিথি ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার। সভাপতিত্ব করেন ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন। অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে সকালে আয়োজিত সেমিনারের বিষয় ছিল ‘লোকখাদ্যের পরিবেশ প্রসঙ্গ’। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. আমিনুর রহমান সুলতান। মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হাকিম আরিফ। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সভাপতিত্বে আরও আলোচনা করেনÑ ত্রিপুরা থেকে আগত কবি সুভাষ দাস, কবি বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, কবি দিলীপ দাস প্রমুখ। বিকেলে আলোচনার বিষয় ছিল ‘এপার-ওপারের বাংলা কবিতা’। প্রধান অতিথি ছিলেন পর্ষদের চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। তৃতীয় দিন ভাষা চত্বরে আয়োজন করা হয় সেমিনার ‘সমকাল সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্কট’। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. আবুল আজাদ। সভাপতিত্ব করেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় সেমিনার ‘লড়াকু সংস্কৃতি ও সংগ্রামী চেতনা’। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ফকরুল চৌধুরী। মুখ্য আলোচক ছিলেন ড. খালেদ হোসাইন। প্রধান অতিথি ছিলেন ড. পবিত্র সরকার। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। উৎসব মঞ্চে প্রতিদিনই ছিল কবিতা। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন খ্যাতিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল কবিরা। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশপাশের এলাকা থেকে কবি ও ছড়াকাররা এসেছিলেন। প্রথম দিন ভাষা চত্বরে সমবেত হন ছড়াকাররা। নিজেদের পছন্দের ছড়া পড়ে শোনান তারা। সৈয়দ শামসুল হকের অনুপস্থিতিতে এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি কাজী রোজী। বিশেষ অতিথি ছিলেন রফিকুল হক দাদু ভাই। অনুষ্ঠানে কবি ও কবিতা বিষয়ক আলোচনারও আয়োজন করা হয়। এর আগে অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে আবৃত্তি করেন গোলাম সারোয়ার। দ্বিতীয় দিন ভাষা চত্বরে আবৃত্তি করেন চট্টগ্রামের বাচিকশিল্পী প্রবীর পাল। অন্যান্য দিনেও ছিল ছড়া ও কবিতা নিয়ে আয়োজন। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় কবিরা তাঁদের কবিতায় দুই বাংলার বিচ্ছেদের কথা বলেন। সমকালীন ভাবনাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সঙ্গীতের ভাষায়ও ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গ-সংস্কৃতি। প্রথম দিন অনার্স কলেজ প্রাঙ্গণে ছিল ঢাকার সরকারী সঙ্গীত কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। বিকেলে সরব হয়ে ওঠে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর। শুরু করা হয় পঞ্চকবির গান দিয়ে। বাঙালীর প্রিয় কথা ও সুরগুলো বেজে ওঠে শিল্পীদের কণ্ঠে। সরাইলের ত্রিতাল সঙ্গীত নিকেতনের শিল্পীদের শিকড় সন্ধানী পরিবেশনা শুধু মুগ্ধ করে না, আশাবাদী করে তোলে। উৎসবজুড়েই ছিল এই ধরনের আয়োজন। উৎসব উপলক্ষে একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনাও বের করা হয়। ৪৮০ পৃষ্ঠার সঙ্কলনে বাংলাদেশের বিখ্যাত বহু লেখকের লেখা স্থান পায়। বঙ্গ-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে লেখেনÑ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, পবিত্র সরকার, শামসুজ্জামন খান, মফিদুল হক, শান্তনু কায়সার, ড. শ্যামল চক্রবর্তী, জয়দুল হোসেন, সাযযাদ কাদির, আনিস রহমান, সরকার আবদুল মান্নান প্রমুখ। সব মিলিয়ে প্রশংসা না করে পারা যায় না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে কোন মফস্বল শহরে এমন আয়োজন বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ছাড়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আয়োজকদের পক্ষে জয়দুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মফস্বল শহরে এই ধরনের বড় আয়োজন সহজ কথা নয়। কিন্তু আমাদের প্রেম-শ্রম আয়োজনটিকে সফল করেছে। বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতি যে দায়বদ্ধতা, এটিই আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। তিনি নিজ থেকেই উৎসবটির প্রশংসা করেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। এর কিছু মন্দ দিক আছে। সে জায়গা থেকে দেখলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উৎসবটি চমৎকার উদ্যোগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রতিক সময়ের মৌলবাদী আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতি পর্যন্ত ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকলা একাডেমিতে আক্রমণ চালিয়েছে। এমন বর্বরতার বিপরীতে আমাদের সুখস্মৃতিটি বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব। সত্য সুন্দরের এই উৎসবের মাঝেই বাংলাদেশ ফুটে ওঠে। এমন উৎসব আরও বেশি করে আয়োজনের আহ্বান জানান তিনি। মফিদুল হকের কথায় মনে পড়ে যায় আসাদ চৌধুরীর বলাটি। কবিতায় তিনি বলেছিলেনÑ জল্লাদের শাণিত অস্ত্র/ সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,/ দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে/ সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করার পূর্বে/ ছাড়পত্রহীন সূর্য কিরণকে বিষাক্ত করার পূর্বে/ এসো বারবার,/ বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে। বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব হোক সেই বজ্র।
×