ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রহ্মপুত্রের পতিত চরাঞ্চল এখন সবজিভা-ার;###;লাখপতি কৃষক শতাধিক

ময়মনসিংহে সবজি বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

ময়মনসিংহে সবজি বিপ্লব

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ সবজির ভা-ার বলে খ্যাত ময়মনসিংহের বোররচরের কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্রহ্মপুত্র পারের দুর্গম এ চরের কৃষক-কিষানীদের এখন দম ফেলারও যেন সময় নেই। ক্ষেত থেকে সবজি তোলা, বাছাই, প্যাকেট কিংবা বস্তায় ভর্তি, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে তুলে দেয়াসহ বাজারজাত নিয়েই কৃষকদের এমন ব্যস্ততা। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কেবল এ বোররচর থেকেই রাজধানী ঢাকার কারওয়ান, যাত্রাবাড়ী বাজার ও সিলেট চট্টগ্রামসহ দেশের নানা জায়গায় যাচ্ছে প্রতিদিন ১০০ ট্রাক সবজি। যার পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার মণ। টাকার অঙ্কে দৈনিক সবজির বাজারে লেনদেন হচ্ছে এক কোটি ৫০ লাখ টাকার ওপরে। আর সবজির মৌসুমে লেনদেনের এ অঙ্ক শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ স্থানীয় কৃষকদের। ময়মনসিংহ খামারবাড়ি কর্তৃপক্ষ চরাঞ্চলের সবজি খাতের এ লেনদেন স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে। স্থানীয় খামার বাড়ি সূত্র জানায়, ময়মনসিংহে এবার রেকর্ড ১৫ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে টমেটো, আলু, কপি, বেগুনসহ নানাজাতের শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ৬৩২ মেট্রিকটন। অনুকূল আবহাওয়া ও বাম্পার ফলনের কারণে উৎপাদনের এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি করেছে স্থানীয় খামারবাড়ি কর্তৃপক্ষ। উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তাতে প্রতিকেজি সবজি গড় পড়তায় ২০ টাকা হিসেবে ধরা হলেও এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৫৬৫ কোটি ২৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার ওপরে। এ বাজারের সিংহভাগই বোররচরের দখলে। কেবল তাই নয় বোররচরের কৃষকদের দাবি, মৌসুমে বোররচরের উৎপাদিত সবজির বাজারমূল্য শত কোটি টাকার ওপরে! তবে এর সিংহভাগ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের ব্রহ্মপুত্র পারের দুর্গম বোররচরে এক সময় সরিষা, কচুমুখী, গম আর কালাই ছাড়া তেমন কোন ফসল হতো না। বছরের বেশিরভাগ সময় বোররচরের জমিত পতিত থাকত। গরুর পাল তাতে চষে বেড়াত। নদী ভাঙ্গা নিয়ত সংগ্রামী মানুষের দিন চলত অর্ধাহার আর অনাহারে। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য পাল্টে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা বোররচরে এখন সোনা ফলছে। ধান, পাট ও গমের পাশাপাশি শীতকালীন সবজি ফলছে ব্রহ্মপুত্র পারের বোররচর, ডিগ্রী পাড়া, বৈঠামারি, বাঘেরকান্দা, মৃর্ধাপাড়া, রাঘবপুর, বাড়তিপাড়া, ভাটিপাড়া, পয়েস্তি, মধুমারি ও চরশেকলদি গ্রামজুড়ে। মাত্র এক দশকে শীতকালীন সবজির আবাদ করে বোররচরের শতাধিক কৃষক ও কিষানি ভাগ্য বদলে এখন লাখপতি বনেছেন। শীতকালে উর্বর বোররচরে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, আলু, বেগুন, কাঁচামরিচ, শশা, গাজর, লাউ, সীমসহ সব জাতের সবজির আবাদ হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরের যতদূর চোখ যায় ততদূর কেবল সবজির ক্ষেত। এখন সবজির ভরা মৌসুম চলছে। আর তাই বোররচরের কৃষক কিষানীরা আবাদের সবজির বাজারজাত নিয়ে মহাব্যস্ত। সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতিদিন ভোর বেলায় বাড়ির কৃষক ও কিষানীরা দলবেঁধে সবজি ক্ষেত থেকে পরিপক্ব টমেটো, বেগুন, ফুলকপি বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, আলু তুলে মাঠে কিংবা বাড়ির পাশে স্তূপ করছেন। অনেকে ক্ষেত থেকে সবজি তুলে সরাসরি স্থানীয় বাজারে তুলছেন। আর যাদের সবজি রাজধানী ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোথাও পাঠানো হবে তারা বাছাই করে পাইকার ও আড়তদারদের সরবরাহ করা ক্যারেটে ভর্তি করছেন। এভাবে বাছাই ও ক্যারেট ভর্তির পর বিকেলে বোররচর থেকে ট্রাক, পিকআপ কিংবা কাভার্ডভ্যানে করে এ সবজি যাচ্ছে ঢাকার কাওরান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ নানা জায়গায়। দেশের নানা জায়গা থেকে আসা পাইকার ও আড়তদাররাও ভিড় করছেন সবজির ভা-ার বোররচরে। ফলে কৃষক-কিষানীদের ব্যস্ততার পাশাপাশি পাইকার ও আড়তদারদের আনাগোনায় পুরো বোররচর এখন ব্যস্ততম মোকাম। বোররচরে দৈনিক লেনদেন শত কোটি টাকা ॥ বোররচরের অবস্থা সম্পন্ন কৃষক সাইফুল ইসলাম। স্থানীয়দের কাছে সাইফুল ডাক্তার নামেই তার পরিচিতি। আলাপকালে সাইফুল ইসলাম জানান, বোররচরে এবার সবজির ফলন হয়েছে বাম্পার। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন বোররচর থেকে রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজার ও যাত্রাবাড়ীসহ সিলেট ও চট্টগ্রামে গড় পড়তায় ১০০ ট্রাক সবজি যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকে ট্রাকে সবজি লোড করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর এসব ট্রাক বোররচর ছেড়ে যাচ্ছে। সাইফুলের দেয়া হিসেব মতে, ১০০ ট্রাকে প্রায় ১৯ হাজার মণ সবজি প্রতিদিন বোররচর থেকে নানা জায়গায় যাচ্ছে। গড়ে ২০ টাকা কেজি দরে এ সবজির বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওপরে। এ হিসাবে চলতি মৌসুমে বোররচরে সবজির বাজারে লেনদের অঙ্ক শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি স্থানীয় কৃষকদের। সবজি চাষী শামছুল হকের কথা ॥ বোররচর কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন কৃষক শামছুল হক (৪৫) এবার ৩২ কাঠা জমিতে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শশা, কাঁচামরিচ জাতীয় সবজির আবাদ করেছেন। সার কীটনাশক, লেবার, সেচ ও হালচাষ বাবদ তার খরচ পড়েছে ৩ লাখ টাকা। মৌসুমের শুরুতে কিছুটা বাড়তি দাম পেলেও এখন বাজার পড়ে গেছে। বর্তমানে তিনি প্রতিকেজি টমেটো ৮ টাকা, বেগুন ৫ টাকা, কাঁচামরিচ ২০ টাকা, ফুলকপি বড় সাইজ ১০ টাকা, বাঁধাকপি বড় সাইজ ৮ টাকা দরে বিক্রি করছেন। বাম্পার ফলন হওয়ায় প্রতিকাঠা জমিতে টমেটো মিলছে ৭৫Ñ৮০ মণ, বেগুন ৫০Ñ৬০ মণ, কাঁচামরিচ ১০০ মণ, ফুলকপি ১৩০০ পিস এবং বাঁধাকপি ১২০০ পিস। এ পর্যন্ত তার বিক্রি হয়েছে ২ লাখ টাকার ওপরে। ক্ষেতে যে পরিমাণ সবজি রয়েছে তাতে আরও প্রায় ২ লাখ টাকা বিক্রি হতে পারে। এ হিসেবে শামছুল হকের চলতি মৌসুমে ১ লাখ টাকা লাভ হতে পারে বলে আশা করছেন। লাখপতি এ কৃষক জানান, ন্যায্য দাম পেলে সবজির মৌসুমে তার লাভ ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেত। বোররচরে এমন লাখপতি কৃষক-কিষানীর সংখ্যা শতাধিক বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র কিষানী শামীমা আক্তার শাপলা জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ২০ শতক জমিতে টমেটো আবাদ করেন। তার খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। মৌসুমের শুরুতে দাম ভাল পাওয়ায় উৎপাদিত টমেটো বিক্রি করেছেন ৭৫ হাজার টাকা! তবে এখন দাম পড়ে যাওয়ায় অনেক কৃষক ও কিষানির মুখে লোকসান ও হতাশার সুর। ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বোররচরের কৃষকরা। লাভের গুড় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ॥ ময়মনসিংহের বোররচরসহ বিভিন্ন ক্ষেতে প্রতিকেজি টমেটো এখন বিক্রি হচ্ছে ৮Ñ১০ টাকায়। ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজার আড়তে এ টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৫Ñ২০ টাকা কেজি দরে। অথচ পাইকারদের কাছ থেকে ভোক্তাদের এ টমেটো কিনতে হচ্ছে ২৫Ñ৩০ টাকা কেজি করে। প্রতিটি বড় সাইজের ফুলকপি ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৫Ñ২০ টাকায়। অথচ কৃষক পাচ্ছে মাত্র ৮ টাকা। বেগুন কৃষকদের ক্ষেতে বিক্রি হচ্ছে না বলেই চলে। ফলে কৃষকরা এখন ক্ষেত থেকে বেগুন তুলছেন না। কোন কোন ক্ষেতে ৪Ñ৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বেগুন। অথচ কৃষকদের হাত বদল হয়ে আড়ত আর পাইকারের হাত ঘুরে এ বেগুন ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজার, সানকিপাড়া ও নতুন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫Ñ২০ টাকা কেজি দরে। ২০ টাকা কেজি দরের কাঁচামরিচ আড়তদার ও পাইকারের হাত ঘুরে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে! অথচ কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। আর ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। মাঝখানে লাভের গুড় চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। বাম্পার ফলনেও হাসি নেই চাষীদের মুখে ॥ চলতি মৌসুমে সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে ময়মনসিংহের সবখানে। তারপরও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হাসি নেই চাষীদের মুখে। ক্রমাগত দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসানের শঙ্কায় সবজি চাষীদের মধ্যে হতাশার সুর বিরাজ করছে। বোরচরের চাষীদের মধ্যে এ শঙ্কা ও হতাশার সুর ঘরে ঘরে। বোররচর পশ্চিম কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক আবু তাহের (৫০) এবার প্রায় ৫ একর জমিতে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, কাঁচামরিচ আবাদ করেছিলেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত সবজি বিক্রি করেছেন ২ লাখ টাকার। ক্ষেতে যে পরিমাণ সবজি রয়েছে তাতে ১ লাখ টাকা বিক্রি হতে পারে। এ হিসেবে নিশ্চিত লোকসান হবে বলে মনে করছেন তাহের। একই লোকসানের আশঙ্কা কুষ্টিয়াপাড়ার মাহমুদুল হাসানের (৩০)। ৩ একর জমিতে সবজি আবাদ করে বিক্রি করেছেন ২ লাখ টাকার। এখনও খরচের ১ লাখ টাকা ক্ষেতে পড়ে আছে। পাইকার ও আড়তদারদের ভিড় বোররচরে ॥ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের নানা জায়গা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পাইকার ও আড়তদার প্রতিদিন বোররচরে ভিড় করছেন। অনেকে সরাসরি কৃষকদের সবজি কিনে নিচ্ছেন। যাত্রাবাড়ী বাজারের ভাই ভাই আড়তের মালিক শেখ আক্কাস আলী জানান, বোররচরের বিষমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি বলে তিনি সরাসরি এ সবজি কিনে বাজারজাত করছেন। ঢাকার বাজারে বোররচরের সবজির দামও মেলে ভাল। শেখ আক্কাস আলী আরও জানান, বোররচর থেকে সবজির সরবরাহ নিশ্চিত করতে তিনি প্রতি মৌসুমে বোররচরের কৃষকদের সবজি চাষে আগাম বিনিয়োগ করছেন। তবে কৃষকদের প্রতি শর্ত থাকছে মৌসুমের সবজি তার আড়তে তুলতে হবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা আড়তদারের এমন সহায়তায় সবজির বাজারজাতে স্বস্তির কথা জানিয়েছেন। কৃষকদের দাবি সরকার কিংবা স্থানীয় ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে এগিয়ে এলে আড়তদারের দ্বারস্থ হতে হতো না তাদের। বোররচরে ২২ কৃষক নিয়ে দল গঠন ॥ সবজির বাজারজাত, পরিবহন ও ন্যায্য দাম পেতে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে বোররচরের ২২ কৃষক একটি দল গঠন করেছেন। এসব কৃষকদের উৎপাদিত সবজি সরাসরি রাজধানী ঢাকার আড়তে পৌঁছে যাচ্ছে। ট্রাক ভাড়া করে দলের সদস্য কৃষকরা নিজেদের উৎপাদিত সবজি সরাসরি ট্রাকে পরিবহন করছেন। এসব কৃষকদের সবজি বাজারজাতে প্রতিদিন ২টি ট্রাকের প্রয়োজন পড়ছে। স্থানীয় অপর কৃষকরাও এ দলের সহায়তায় তাদের সবজি বাজারজাত করতে পারছেন। কৃষকদের এ দল গঠনে সহায়তা দিচ্ছে রাজধানী ঢাকার কয়েকটি আড়ত। বোররচরের সবজি যাবে ইউরোপ আমেরিকায় ॥ বোররচরের কীটনাশক ও বিষমুক্ত সবজির বাজার উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকায়। বোররচরের সবজি বিশেষ করে বেগুন ইউরোপ আমেরিকায় রফতানির প্রক্রিয়া চলছে। স্থানীয় খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আলতাবুর রহমান জানান, গত ২ বছরে ময়মনসিংহ সদরের ৩০Ñ৪০ জন কৃষক বাছাই করে তাদের বিষমুক্ত সবজি আবাদের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ কৃষক বোররচরের। হরটেক্স ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা এসব কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর বাইরে সবজির ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতসহ বছরজুড়ে বাজারে সবজির সরবরাহ নিশ্চিত করতে কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানায় খামারবাড়ি।
×