ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আটক কামালের তথ্য ॥ দু’একদিনে আরও আসামি গ্রেফতার হতে পারে

চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে বর্ষবরণে নারী নিগ্রহের ঘটনায়

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে বর্ষবরণে নারী নিগ্রহের ঘটনায়

আজাদ সুলায়মান ॥ টিএসসিতে বর্ষবরণের দিন নারী নিগ্রহের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ আল মাসুদ কামালকে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। মহানগর গোয়েন্দা হেফাজতে ২ দিনের রিমান্ডে থাকা কামাল ওই দিনের ঘটনায় কিভাবে নিজেকে অন্যদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেনÑ সে সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অপর আসামিদের আটকের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে। শুক্রবার এ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দু-একদিনের মধ্যে আরও বড় ধরনের সফলতা পাওয়া যাবে। এ ঘটনায় জড়িত আরও দুই আসামি যে কোন সময় গোয়েন্দা জালে আটক হতে পারে। এদিকে গত বছর পহেলা বৈশাখে ন্যক্কারজনক এ ঘটনার ছয় মাসের মাথায় মামলার ফাইনাল রিপোর্ট প্রদানের কেন আসামি ধরা হলো এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে তোলপাড় হওয়া এ ঘটনার মাত্র ছয় মাসের মাথায় গোয়েন্দা পুলিশে হঠাৎ কেন ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করে, তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা গোয়েন্দা পুলিশও দিতে পারছে না। আদালতে দাখিলকৃত ফাইনাল রিপোর্টে শুধু উল্লেখ করা হয়েছেÑ আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় চার্জশীট দেয়া যায়নি। পুলিশের সাদামাটা এমন ব্যাখ্যাও যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয় ও রহস্যময় বলে দাবি করেছেন নিপীড়নবিরোধী কমিটির নেতৃবৃন্দ। শুক্রবার টিএসসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওই কমিটির এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, নববর্ষে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের পরও এমন ঘটনায় গোটা দেশবাসী স্তম্ভিত। তারপর এ ঘটনায় জড়িতদের নিয়ে পুলিশ যেটা করেছে সেটা আরও ন্যক্কারজনক। এতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠেÑ এ ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে। যে কারণে মামলার দায়েরের ছয় মাসের মাথায়ও কোন সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, কেউ আটক বা চিহ্নিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত ২২ ডিসেম্বর এসব কারণ উল্লেখ করে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করা হয়। এ অবস্থায় হঠাৎ কেন আবার সেই গোয়েন্দাদের মাঝে কামালকে আটক করার জন্য শুভবুদ্ধির উদয় হলো সেটা বিস্ময়কর। যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকারীদের ভাষ্যমতে- পহেলা বৈশাখে ঘটনাস্থলের সিসি ফুটেজে চিহ্নিত হওয়া ৮ জনের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তারপর কেটে গেছে আরও কয়েক মাস। এ সময়ে তদন্তকারীদের তৎপরতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় রয়ে গেছে। এ ৮ জনের একজন গ্রেফতারকৃত কামাল দাড়ি কেটে নিজের বেশভূষা ও চেহারা-সুরত কিছুটা পরিবর্তন করলেও তিনি কিন্তু খোদ রাজধানীতেই অবস্থান করছিলেন। ঘটনার পর কিছুদিন বাইরে আত্মগোপনে থাকে। কামালের নিজ বাসা চকবাজারের খাজা দেওয়ান লেনের প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সূত্রের দাবিÑ ঘটনার পর কয়েকদিন শুধু সে বাসায় থাকত না। রাজধানীতেই অন্যত্র আত্মগোপন করে থাকত। কিন্তু গত ২২ ডিসেম্বর মামলার ফাইনাল রিপোর্ট প্রদানের পর কামাল নিজ বাসায় বসবাস করতে থাকে। এ বিষয়ে জনৈক গোয়েন্দা কর্মকতা জানান, কামাল সেদিনের ঘটনায় নিজেকে জড়িত নয় বলে দাবি করলেও কিভাবে মেয়েদের অন্যরা যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছিত করেছিল তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে। এমন পত্রিকায় যে ৮ জনের ছবি ছাপানো হয়েছে তাদের ৪ জনকে সে ভালভাবেই চেনে বলে স্বীকার করেছে। এদের দুজন বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কথাও জানিয়েছে। তার দেয়া এ সব তথ্য কতটা বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সেটাই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তার দেয়া তথ্য মতে- গোয়েন্দাদের একাধিক রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় বৃহস্পতিবারও অভিযান চালিয়েছে। অন্তত আরও দুজন যে কোন সময় ধরা পড়তে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এ সম্পর্কে পুলিশের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, টিএসসিতে নারী নিগ্রহের ঘটনার নয় মাস পর আসামি আটক করা, সাত মাসের মাথায় চার্জশীট না দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়াটা সন্দেহের সৃষ্টি করলেও এটা অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক বা বেআইনী কিছু নয়। এমন বিধান আইনের রয়েছে। কোন অপরাধের ঘটনায় পর্যাপ্ত সাক্ষী-প্রমাণাদি না থাকা, আসামি চিহ্নিত করা না গেলে ফাইনাল দেয়াটাও আইনী প্রক্রিয়ারই অংশ। একই ঘটনায় পরে যদি আসামি চিহ্নিত করা যায়, আটক করা যায়, তদন্তে অগ্রগতি থাকে তাহলে আদালতে পিটিশন দাখিল করে ওই মামলা পুনরুজ্জীবিত করা যায়। ডিবি এখন সেই কাজটাই করছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়Ñ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ জনকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ার পরও কেন তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি সেটাই কঠিন প্রশ্ন ও নানা রহস্যে ঘেরা। বিশেষ করে আসামি কামালকে এমন সময় ধরা হলো যারÑ কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ কার্যালয়ে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কঠোর ঘোষণা দিয়েছেন অপরাধীরা যত প্রভাবশালীই হোক কাউকেই ছাড় নয়। এমনকি তারা নিজ দলের লোক হলেও। দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অন্যায় কাজে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলেও পুলিশকে তাতে সাড়া না দেয়ার নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী। মূলত প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই বুধবার সন্ধ্যায় নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হন কামাল। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারেÑ এ ৮ জন আসামি প্রভাবশালী ছিল বলেই কিংবা ওপর মহলের কোন গ্রীন সিগন্যাল ছিল না বলেই কি এতদিন ধরা হয়নি। উল্লেখ্য, বুধবার সন্ধ্যায় চকবাজারের খাজা দেওয়ান প্রথম লেনের ৭৭ নম্বর বাসা থেকে সন্দেহজনকভাবে ৫৪ ধারায় তাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে কামালকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বৃহস্পতিবার তাকে ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় কামাল গ্রেফতারের ৪৫ দিন আগে ‘মামলাটি আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট (সত্য)’ দাখিল করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আদালতে আবেদনও করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গত বছরের ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে একদল যুবক নারীদের লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় অচেনা কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করে। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যৌন নিপীড়নবিরোধী একটি কমিটি গঠন করে আন্দোলনে নামে। এতে ওই এলাকায় থাকা পুলিশেরই ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ৮ নারী লাঞ্ছনাকারীকে শনাক্ত করে পুলিশ। যার মধ্যে মোঃ কামাল একজন। যৌন নির্যাতনের ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপ-পরিদর্শক দীপক কুমার দাশ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারা মোতাবেক কামালকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আর এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা ওই মামলা পুনরজ্জীবিত করতে বৃহস্পতিবার ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন জমা পড়ে। তবে কবে এ বিষয়ে শুনানি হবে, তা ঠিক হয়নি। এ সম্পর্কে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, কামাল সেদিন মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছিল তাতে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। বুকে হাল্কা কাজ করা পাঞ্জাবি পরা লম্বা-চওড়া চাপ দাড়িওয়ালা কামালসহ তার মতো বেশধারী কয়েকজন ছিলেন আক্রমণের কেন্দ্রে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়-সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের সামনে থাকা কামালসহ একই বেশধারী ১০ থেকে ১২ জন নারীদের ওপর যৌন আক্রমণ করে। তাকে ৬টা ৩৯ মিনিটে ঘটনাস্থলে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে, যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। ৬টা ৪৮ মিনিটে দুজন নারীর ওপর হামলার সময় কামালও হামলাকারীদের দলে ছিল। তার চারপাশে মাথায় পট্টি বাঁধা দাড়িধারী আরও কয়েকজনকে দেখা যায়, যারাও আগে থেকেই ওই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল। ৬টা ৪৯ মিনিটে রিক্সা থেকে এক নারীকে টেনে নামানোর সময়ও কামালকে দেখা গেছে। ঘটনার সময় বাধা দিতে গিয়ে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ কয়েকজন। এ সময় ঘটনাস্থলে ও এর আশপাশে পুলিশ থাকলেও নারীদের ওপর হামলা ঠেকাতে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনার পর পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে মুখে চাপদাড়ি থাকা কামাল দাড়ি-গোঁফ কেটে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট প্রদানের পর কামাল বাসায় ফেরে। এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় পুলিশ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘নির্বিকার’ ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি এ ঘটনার পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বানও জানান অনেকে। এর একপর্যায়ে কর্তব্যে গাফিলতির কারণে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় শাহবাগ থানার এসআই আশরাফুল আলমকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল উৎসবে আসা নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কয়েক যুবক ৪ যৌন নিপীড়ককে ধরে ওই এসআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশরাফুল তাদের রহস্যজনক কারণে ছেড়ে দেন। ঘটনার সময় পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি ও নারী নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক ২টি কমিটি গঠন করা হয়। তারপর ১৭ মে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ছবি দেখে ৮ নিপীড়ককে চিহ্নিত করার কথা জানান পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। এসব ছবি প্রকাশ করে এই ৮ নিপীড়ককে ধরিয়ে দিতে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু তারপর গত ৮ মাসেও পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। অবশেষে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই দীপক কুমার দাস ঢাকার একটি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তাতে উল্লেখ করেনÑ আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণাদিও মেলেনি। যে কারণে চার্জশীট দেয়া সম্ভব হয়নি।
×