ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি চায় সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করুক;###;আওয়ামী লীগ চায় ঐক্যবদ্ধ থেকেই সমর্থন

জাপার হিসাব-নিকাশ

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

জাপার হিসাব-নিকাশ

শরীফুল ইসলাম ॥ অবশেষে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে পিছু হটেছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এখন মনোভাব পরিবর্তন করে পুরো মেয়াদ সরকারের সঙ্গেই থাকছে দলটি। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চায় জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ থেকেই সরকারের প্রতি সমর্থন রাখুক। আর বিএনপি চায় পুরো জাতীয় পার্টি সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করুক। কোন কারণে তা না হলেও কিছু নেতা মিলে দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করুক এবং তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করুক। জানা যায়, বিভিন্ন মহলের প্ররোচনায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে চাইলেও বাস্তবতার আলোকে পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। কারণ, সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি হারাতে হবে। এ ছাড়া দলটি বর্তমানে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে যে মর্যাদা পাচ্ছে তা থেকে বঞ্চিত হবে। আর এরশাদের মাথার ওপর দুর্নীতির মামলার যে খড়গ ঝুলে আছে সেখানেও নতুন করে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই এরশাদসহ জাতীয় পার্টির অন্যান্য নেতা পুরো মেয়াদ সরকারের প্রতি সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সরকারের কাছ থেকে দূরে সরাতে নানামুখী চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এ জন্যই জাতীয় পার্টি সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিলে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে তাদের নানামুখী সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। কোন কারণে পুরো জাতীয় পার্টিকে সরকার থেকে দূরে সরাতে না পারলেও দলটিতে ভাঙ্গন ধরিয়ে একাংশকে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়াতে চায় বিএনপি। এছাড়া দেশের বাইরে থেকেও কোন কোন মহল জাতীয় পার্টিকে সরকার থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার নানামুখী চাপে রয়েছে। তবে এক সময়ের ক্ষমতাসীন দল জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে থাকায় আওয়ামী লীগ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নের সূচকগুলো উর্ধমুখী হওয়ায় সরকারের পক্ষে নানামুখী চাপ অগ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পুরো জাতীয় পার্টি কিংবা দলের একাংশ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে কিছুটা বেকায়দায় পড়বে সরকার। আর এ কারণেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চায় জাতীয় পার্টির ঐক্য বজায় থাকুক এবং তারা সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখুক। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলতে থাকেন দলের স্বার্থেই তাঁরা সরকার থেকে বেরিয়ে আসবেন। এর আগে এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। ১৭ জানুয়ারি নিজ এলাকা রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁর ছোট ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির কো- চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে দলের কাউন্সিলের জন্য জিএম কাদেরকে আহ্বায়ক ও সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব করে প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেন। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে দলের কিছু সিনিয়র নেতা পরদিন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এতে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে আর রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। ১৯ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দলের বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। এখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই। জাতীয় পার্টি সত্যিকারের বিরোধী দল হতে চায়। জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রওশন এরশাদকেই কো-চেয়ারম্যান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রওশন এরশাদের বয়স এখন ৭৬। তিন বছর পর নির্বাচন হলে তখন তার বয়স হবে ৭৯। এ জন্য তাকে করিনি। সে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করুক। তার সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই। বয়সে কম হওয়ায় জিএম কাদের পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি। রুহুল আমিন হাওলাদার প্রসঙ্গে এরশাদ বলেন, আমি হঠাৎ করেই রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তাই তাকেই আবার মহাসচিব পদে নিয়োগ দিয়েছি। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন এরশাদ। সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সম্পর্কে এরশাদ বলেন, বাবলু সেলফিস। সে আমার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমার স্ত্রীর অসম্মতিতে তাকে পার্টির কো- চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছে। এ জন্যই তাকে মহাসচিব থেকে বাদ দিয়েছি। এরশাদ বলেন, বাবলুকে আমি ভালবাসতাম, তাকে এনে আমার দলের মহাসচিব বানিয়েছি। কিন্তু সে এ পদের যোগ্য ছিল না। সে গত দুই বছরের মতো সময়ের মধ্যে একটি সম্মেলনও নিজে নিজে করতে পারেনি। সবকটিতেই আমাকে যেতে হয়েছে। এরশাদের এমন কথার পর জাতীয় পার্টিতে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। এরশাদ ও রওশন এরশাদ নিজ নিজ অনুসারী নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় পৃথকভাবে বৈঠক করতে থাকেন। এতে দলের ভাঙ্গন প্রায় নিশ্চিত হলেও বাদ পড়া মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় পার্টিতে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। এক পর্যায়ে এরশাদ ও রওশন এরশাদ উভয়েই পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসেন। এ পরিস্থিতিতে ২৮ জানুয়ারি দিনে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, তাদের দল সরকারের পুরো মেয়াদই সংসদে থাকবে। আর রাতে রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পর জাতীয় পার্টির উভয় পক্ষের নেতারাই পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের বলেন, সংসদ থেকে জাতীয় পার্টি পদত্যাগ করবে না। মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টি পদত্যাগ করবে কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে বলেন, জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গেই থাকবে। তিনি আরও বলেন, উন্নয়নমূলক সব কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোন সঙ্কট নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বৈঠকের জন্য সময় আগেই পাওয়া গিয়েছিল। সে কারণে বিরোধীদলীয় বৈঠকটি হয়েছে। যে কোন সময় এরশাদও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। অবশ্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই নিজেদের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করবে। আমরা আর মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করব না। সরকারের হাতে আরও তিন বছর সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে আমরা দলকে শক্তিশালী করব। ওই অনুষ্ঠানে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মান দেখিয়ে বিশেষ দূতের পদ দিয়েছেন, পতাকা দিয়েছেন, আমি উনাকে না জানিয়ে এ পদ ছাড়তে পারি না, তাহলে বিষয়টি অসম্মানজনক দেখায়। জাতীয় পার্টি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ও জিয়াউদ্দিন বাবলুকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করার পর জাতীয় পার্টিতে যে অস্থিরতা ছিল তা এখন কেটে গেছে। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে দলটির সম্পর্কে অবনতির ব্যাপারে যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তাও কেটে গেছে। এখন পুরো মেয়াদ সরকারের প্রতি সমর্থন রাখার ব্যাপারে দলের সব নেতাকর্মীই ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে দলের একটি অংশ জিএম কাদের কিংবা অন্য কোন সিনিয়র নেতাকে সরকারের মন্ত্রিসভায় দেখতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে লবিংও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে দলের আরেকটি অংশ তা চাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
×