ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

ওষুধ প্রয়োগে আচরণ পরিবর্তন

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

ওষুধ প্রয়োগে আচরণ পরিবর্তন

আচরণ কি ওষুধ দিয়ে বদলানো সম্ভব? আচার-আচরণ সাধারনত অভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে বদলানো যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, কোন প্রাণীর স্বভাবগত আচরণ স্থায়ী কিছু নয়, সেটাকে বদলে দেয়া সম্ভব। আর সেজন্য ওষুধ প্রয়োগেও করা যেতে পারে। ছুতার পিঁপড়ের সামাজিক আচরণ এপিজেনেটিক ওষুধ দিয়ে বদলে দেয়া যায়। এই প্রজাতির পিঁপড়েকে ওই এনজাইম খাওয়ানো হলে তাদের খাদ্য সন্ধান করার ক্ষমতা ও তৎপরতা বেড়ে যায়। সম্প্রতি এক নতুন গবেষণায় এই তথ্য জানা গেছে। এপিজেনেটিক ওষুধ ছুতার পিঁপড়ের মস্তিষ্কের ওপর ক্রিয়া করে সেটাকে রিপ্রোগ্রাম করে দিতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে একই ঘটনা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। জিন অনুক্রমের কোন পরিবর্তন ব্যতিরেকেই বংশপরম্পরায় স্থির বা অটলভাবে যেসব পরিবর্তন ঘটে সে বিষয়ক গবেষণাকে বলে এপিজেনেটিকস। প্রাণীদের অনেক বৈশিষ্ট্য যেমনÑ আকার, আচরণ ও বয়স বাড়ার বিষয়টি এপিজেনেটিকসের সঙ্গে যুক্ত এবং এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে বলে লক্ষ্য করা গেছে। তবে এপিজেনেটিকের যে ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় সে বিষয়ক জ্ঞান ও ধারণার ক্ষেত্রে এক বিশাল শূন্যতা রয়ে গেছে। সামাজিক আচরণ গবেষণা করে দেখার এক আদর্শ মডেল হলো পিঁপড়ে। কারণ প্রতিটি পিঁপড়ে কলোনিতে রয়েছে হাজার হাজার পিঁপড়ে। এরা সবাই সহোদর। এদের মধ্যে থাকে রানী পিঁপড়ে আর সবই শ্রমিক পিঁপড়ে, যারা স্ত্রীলীঙ্গের। এদের জেনেটিক গঠন প্রায় অভিন্ন। অনেকটা যমজ মানবশিশুর মতো। অবশ্য এই সহোদর পিঁপড়েদেরও আবার জাত অনুযায়ী স্বতন্ত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ থাকে। এর আগের এক গবেষণায় পিঁপড়েদের প্রথম জেনোমব্যাপী এপিজেনেটিক মানচিত্র তৈরি করা হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল যে, এপিজেনেটিক নিয়ন্ত্রণই হলো ছুতার পিঁপড়ে কলোনির প্রধান ও অপ্রধান সহদরাদের মধ্যে পার্থক্য টানার মূল চাবিকাঠি। প্রধানরা হলো পিঙ্গল বনের সৈনিক আর অপ্রধানরা হলো আকারে ছোট অথচ অধিকতর মেধাসম্পন্ন সহোদর। সৈনিক পিঁপড়েদের মাথা হয় বড় এবং চোয়ালের হাড় থাকে শক্ত, যার ফলে শত্রুদের পরাজিত করা এবং বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী প্রক্রিয়াজাত ও পরিবহন করা সহজতর হয়। শ্রমিক পিঁপড়েরা অনেক ছোট হলেও সংখ্যায় এরা সৈনিকদের চেয়ে ঢের বেশি। প্রতি একটা সৈনিক পিঁপড়ের স্থলে শ্রমিক পিপড়ে হলো দুটি। এরা খাদ্যের সন্ধান করা এবং সেই খাদ্য ঘরে তুলে আনতে অন্যান্য পিঁপড়েকে রিক্রুট করার মতো গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। সৈনিক পিঁপড়ের তুলনায় শ্রমিক পিঁপড়েদের এমন জিন থাকে, যা মস্তিস্কের বিকাশ ও নিউরোট্রান্সমিশনের কাজে যুক্ত। এখন নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে, হিস্টোন প্রোটিন কমপ্লেক্সের সঙ্গে যুক্ত এসিটাইল গ্রুপ নামক এপিজেনেটিক রাসায়নিকের ভারসাম্য পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট জাতের পিঁপড়ের খাদ্য সন্ধানগত আচরণ সরাসরি বদলে দেয়া যেতে পারে। এই অসাধারণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উন্মোচন করে গবেষক দল দেখিয়েছেন যে, হিস্টোনের (হিস্টোন এসিটাইলেশন) সঙ্গে এসিটাইল গ্রুপগুলো যুক্ত করা বা তা থেকে বাদ দেয়ার কাজে বাধাদানকারী যৌগ উপাদানগুলো কাজে লাগিয়ে ওই শ্রেণীর পিঁপড়ের খাদ্য সন্ধানগত আচরণ রিপ্রোগ্রামিং করা এবং এভাবে নিকটবর্তী জিনগুলোর বংশপরম্পরা বদলে দেয়া সম্ভব। গবেষক দলের অন্যতম ড্যানিয়েল এবং সিমোলা বলেন, গবেষণার ফলাফল থেকে এই দাঁড়ায় যে, পিঁপড়ে এবং সম্ভব অন্যান্য প্রাণীরও আচরণগত পরিবর্তন যোগ্যতা হিস্টোন রদবদলের মাধ্যমে এপিজেনেটিক পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এছাড়াও গবেষক দল প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অনুজীববিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটিয়ে বুঝতে পেরেছেন কিভাবে পিঁপড়েদের মধ্যে বর্ণ বা জাতগত পার্থক্যের উদ্ভব হয়। পিঁপড়ে, উইপোকা এবং কিছু কিছু মৌমাছি ও বোলতা হলো ইউসোশ্যাল বা সত্যিকারের সামাজিক প্রজাতি। আগের গবেষণাকর্ম থেকে জানা গিয়েছিল যে, হিস্টোন এসিটাইলেশন অভিন্ন জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসংবলিত প্রাণীদের মধ্যে বংশপরম্পরায় নাটকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে, যার পরিণতিতে পিঁপড়ের বিভিন্ন জাতের মধ্যে শরীরের আকার, আয়তন ও প্রজনন ক্ষমতায় ভৌত পরিবর্তন রচিত হয়। বর্তমান গবেষণায় সেই ব্যাখ্যাটি আরও বিশদ রূপ লাভ করেছে। এতে দেখানো হয়েছে যে, হিস্টোন এসিটাইলেশনে এপিজেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পিঁপড়েদের জাতগত আচরণও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এটা দেখানোর জন্য গবেষক দলটি এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়েছে যে, এসিটাইল গ্রুপগুলোকে যোগ করে ক্রোমাটিন কাঠামো অর্থাৎ হিস্টোন প্রোটিনকে ঘিরে থাকা ডিএনএ কু-লী আকৃতির কাঠামোকে বদলে দেয়া সম্ভব। তাতে করে শেষ পর্যন্ত জেনোমের ঘন সংবদ্ধ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যায়। হিস্টোন এসিটাইলেশনের রদবদলের ফলে ডিএনএ পাক খোলার সুযোগ পায়। অথচ অন্যগুলোর বেলায় ডিএনএ দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ হয়ে উঠে এবং যেসব প্রোটিন বংশপরস্পরাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সেগুলোর সান্নিধ্যে পৌঁছানো তাদের পক্ষে অসম্ভব। গবেষণার সময় খাদ্য সন্ধানী শ্রমিক পিঁপড়েদের একটি রাসায়নিক ইনহিবিটর খাওয়ানো হয়, যার ফলে তাদের শেষগুলো হিস্টোন থেকে এসিটাইল গ্রুপগুলোকে অপসারণ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই চিকিৎসার ফলে তাদের খাদ্য সন্ধান সংগ্রহ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারই পরিণতিতে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত জিনগুলোর কাছে হিস্টোন এসিটাইলেশন বেড়ে যায়। আবার এর উল্টোটি করলে অর্থাৎ এসিটাইল গ্রুপগুলোকে যোগ করার কাজে বাধা দেয়া হলে খাদ্য সন্ধান ও সংগ্রহ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। শ্রমিক পিঁপড়েদের খাদ্য সন্ধান ও সংগ্রহ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও প্রাপ্তবয়স্ক সৈনিক পিঁপড়েদের এই ইনহিবিটর খাইয়ে উল্টো ফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, এতে করে ওদের খাদ্য সন্ধান ও সংগ্রহ করার ক্ষমতা মোটেও বাড়েনি কিংবা বাড়লেও অতিসামান্যই বেড়েছে। অথচ অতি অল্পবয়সী সৈনিক পিঁপড়েদের মস্তিষ্কে এসব এপিজেনেটিক ইনহিবিটর সরাসরি ইনজেক্ট করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, তাদের খাদ্য সন্ধান ও সংগ্রহের ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেছে এবং তা এমন স্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছেছে, যা শুধুমাত্র শ্রমিক পিঁপড়েদের বেলাতেই দেখা যায়। সূত্র : এ্যানিমেল সায়েন্স
×