ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

মিছিলের সমান বয়সী কবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

মিছিলের সমান বয়সী কবি

মধ্যসত্তরের তারুণ্যদীপ্ত ও দ্রোহী কবিতা নিয়ে কাব্যজগতে প্রবেশ কবি কামাল চৌধুরীর। জীবনযাপনের কোলাহলের ভেতরেও কবিতাই তার সঙ্গোপনে সাধনা। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গদ্য লিখেছেন, সেটাও কবিতা বিষয়ক। কবিতার বাইরে উৎসাহী সমাজ-সংস্কৃতি অধ্যয়ন ও গবেষণায়। কামালের লেখালেখির হাতেখড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়। নিয়মিত লিখছেন সত্তর দশক থেকে। ১৯৭৪ সালে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সমকালীন কাব্যজগতে প্রবেশ তার। কবির সঙ্গে আলাপনে জানা যায় তার জীবনের টুকিটাকি। কবির জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি। গোদনাইল হাইস্কুল। ম্যাগাজিনে লিখলাম। এক সময় দেখলাম যে আমি প্রচুর লেখালেখি করছি। পাঠ্যপুস্তক ফেলে সারাদিন শুধু কবিতা লিখছি। আমার এসএসসি পরীক্ষার খাতা ভরে উঠতে লাগলো কবিতায়। কবিতা পথিক যেমন হওয়ার, তেমনটা হয়ে গেলাম। আব্বা খুব চিন্তিত ছিলেন পরীক্ষার ফল খারাপ হবে ভেবে। যদিও পরীক্ষায় আমার ফল খারাপ ছিল না, বরং ভালই ছিল। পরীক্ষা পাসের পর থেকে কিছু কিছু লেখা পাঠাতে শুরু করলাম বিভিন্ন জায়গায়। এরপর আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে ভর্তি হয়ে আমি কবিতার একটি বিশাল জগৎ পেলাম। ঢাকা কলেজে আমার দুই প্রিয় বন্ধু পেলাম। একজন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, আরেক জন জাফর ওয়াজেদ। এই দুই কবি বন্ধুর সঙ্গে আমার সারাদিন আড্ডা চলত। দুই বন্ধুর ছিল দুই রকম প্রতিভা। রুদ্রের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হলো, তখন সে বললÑ আমি তো একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছি ‘অনামিকার অন্য চোখ’ নামে। সেটা দিলো আমাকে। ক্যান্টিনে সারাক্ষণ আড্ডা চলত, পড়ালেখার তখন মাথায় নেই। সে সময় আমরা, বিশেষ করে ঢাকা কলেজের সময়ে, অর্থাৎ ’৭৪-৭৫ সালে একই সঙ্গে আমরা সৃষ্টিশীলতা এবং অপচয়ের কাল হিসেবে কাটিয়েছি। অপচয় বলব, যে সময়টা আমরা আরও ভাল কাজে লাগতে পারতাম, সে সময় আমরা আড্ডা দিয়ে নষ্ট করেছি। তবে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া আমাদের চলেছে সমান তালে। অন্যদিকে একাডেমিক লেখাপড়া থেকে আমরা দূরে সরে গিয়েছিলাম। ফলে প্রত্যেকের ফলাফলই খারাপ ছিল। সে সময় মইনুল আহসান সাবেরও আমাদের সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়ত। সে সময় আলী রীয়াজ আমাদের আড্ডায় এসে যোগ দিত। অধ্যাপক আবদুল্লাহ্্ আবু সায়ীদ স্যার প্রকাশ করতেন ‘কণ্ঠস্বর’ নামে একটি পত্রিকা। তখন সায়ীদ স্যার ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। কণ্ঠস্বর-এর শেষ সংখ্যায় আমার ও রুদ্রের কবিতা ছাপা হলো। এর আগে আমার দুই-একটি পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বেশকিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো, সেগুলোতে কবিতা প্রকাশ পায়। তখন ‘আজাদ’ পত্রিকাটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। আজাদ পত্রিকায় আমি একটা লেখা পাঠালাম। রুদ্র বলল, আজাদ-এ তারও একটি লেখা ছাপা হয়েছে। রুদ্র বললÑ ‘আমি ওই পত্রিকার সম্পাদককে চিনি, চলো যাই।’ রুদ্রের সঙ্গে গেলাম, কবিতাটি পরে ছাপা হয়। এরপরে আমি ইত্তেফাকে লেখা দিলাম। রুদ্রও কবিতা দিয়েছিল। আমারটা ছাপা হলো, রুদ্রের কবিতা ছাপা হয়নি। এরপর কবি আহসান হাবীবের হাত দিয়ে আমার কবিতা ছাপা হলো দৈনিক বাংলায়। এভাবেই আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। আমার পিতৃদত্ত নাম কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী হলেও শুরু থেকেই আমি কামাল চৌধুরী নামে লিখে আসছি। ঢাকা কলেজের পাঠ শেষে ’৭৬-এ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। থাকতাম ফজলুল হক হলে। প্রথমে ১৩ নম্বর, এরপর ৩০৯ নম্বর রুমে। দুই বন্ধু রুদ্র ও জাফর ভর্তি হলো বাংলা বিভাগে। আমি ও সাবের ভর্তি হলাম সমাজ বিজ্ঞানে। আমিও আসলে বাংলায় ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম, বাংলা তো আমি এমনতেই পড়ব, তাই এ মনে করে অন্য বিভাগে ভর্তি হলাম। ওই সময়ে আমাদের আড্ডাটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আড্ডা দিতাম গফুর মিঞার রেস্টুরেন্টে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাশে ছিল শরীফ মিঞার দোকান। তার পাশে ছিল গফুর মিঞার রেস্তরাঁ। ৬০-এর কবি-লেখকরা আড্ডা দিত শরীফ মিঞার দোকানে। আর আমরা যারা সত্তরের দশকের লেখক তারা আড্ডা দিতাম গফুর মিঞার দোকানে। রুদ্র, জাফর, জ্যোতি, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আলী রীয়াজ, আবিদ রহমান, অনুজ লেখক তুষার দাশ, মোহন রায়হানসহ আরও অনেকে আড্ডা দিতাম। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর সময়। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা ভাবতাম, কী করা যায়? সে সময় একদিন আমি গফুর মিঞার দোকানে বসে একটি সেøাগান লিখলামÑ ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে।’ সে সময় হায়দার আলী নামে এক ছাত্রনেতা ছিলেন। হায়দার ভাই ছিলেন আমাদের এক বছরের সিনিয়র। তাকে আমি এটা দিলাম। তিনি ছিলেন চিকা মারায় ওস্তাদ মানুষ। রাতের মধ্যে সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমার এই সেøাগানটি দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে দিলেন তিনি। ওই সময় সেটা ছিল খুবই দুঃসাহসিক কাজ। আতঙ্কের ভেতর দিন কাটাতে হতো সবাইকে। যাই হোক, পরে আমার সেই সেøাগানটি ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’Ñ এই হিসেবে ছন্দবদ্ধ করা হলো। ’৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়নের ‘জয়ধ্বনি’ পত্রিকায় আমার একটি লেখা ছাপা হলো। ‘জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু’ শিরোনামের কবিতাটি ছিল এমনÑ ‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/ বক্ষপুরে ভয়/ ভাবলে না কার রক্ত এটা/ স্মৃতিগন্ধময়/ দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু জাতীয়তাময়।’ কবিতাটি প্রকাশের পরদিন দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে, দেয়াল পত্রিকায় ছেয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি তখন উত্তাল হয়ে উঠল। ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগল। তবে আমরা যারা সাহিত্যকর্মী তারা ‘রাখাল’ নামে একটি সাংস্কৃতিক মুভমেন্ট শুরু করলাম। সমাজ বদলের প্রয়োজনে রাজনীতি ও সাহিত্যকে একীভূত করা ছিল আমাদের কাজ। আমরা মধুর ক্যান্টিনেও কবিতা পাঠের আসর করেছি। এর মধ্যে একটি বিষয় শেয়ার করতে চাই। ওই সময় ডাকসুর নির্বাচন শুরু হলো। আমরা তিন বন্ধু (রুদ্র, জাফর ও আমি) সদস্য পদের জন্য ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ প্যানেলের হয়ে দাঁড়ালাম। ওই সময় আমি ছাত্র রাজনীতিতে ফুল টাইমার হয়ে গেলাম। বন্ধুরা মিলে এখানে-ওখানে যাই। পাশাপাশি লেখালেখি চলে। এ সময় সত্তরের কবিদের একত্র করার লক্ষ্যে ‘নক্ষত্রবীথি’ নামে একটি পত্রিকা করলাম। আমাদের বন্ধু রেজা সেলিম, আলী রীয়াজদের বাড়ি ছিল আমাদের আরও দুটি আড্ডার জায়গা। সেই পত্রিকা নিয়ে আমরা গেলাম বাংলা একাডেমিতে অগ্রজ কবি রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনকে দিতে। এক সময় ষাটের অগ্রজ কবিদের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম বই। বইটির নাম ‘মিছিলের সমান বয়সী।’ দ্রাবিড় প্রকাশনী নাম দিয়ে আমরা নিজেরাই সেটা বের করি। মুহাম্মদ নূরুল হুদা ভাই, রুদ্র ও আমি মিলে এই প্রকাশনার যাত্রা শুরু করলাম। কবিতার কাজটি খুব সহজ নয়। যেমন : শূন্য সংখ্যাটি যদি ডিজিট হিসেবে ধরা হয় তবে এর কোন মূল্য নেই। তবে এটিকে যদি একটা নাম্বার হিসেবে ধরি, তবে এর গুরুত্ব আছে। কারণ নাম্বারটা যোগ হচ্ছে। ডিজিটাও যোগ হচ্ছে, তবে সেটা নাম্বার হিসেবে যোগ হচ্ছে। কোন সংখ্যার ডানে বসালে বাড়ছে, বামে বসালে কমছে। তার মানে হচ্ছে যে, সবকিছুর মধ্যে একটা ভ্যালু এ্যাড করতে হবে। সেক্ষেত্রে সাহিত্যের ভ্যালুটা কী? সাহিত্যের একটা লিটারেরি প্রোপার্টি বা সাহিত্য মূল্য আছে। লেখাটি যখন শুধু লেখা, তখন সেটার কোন মূল্য নেই। এটা একটা বর্ণনা হতে পারে, অন্তর্গত বোধ হতে পারে। কিন্তু লেখার ভেতর যখন সাহিত্য মূল্যটা থাকবে তখন এটাকে আমি বলব এটা এক শিল্প হয়ে উঠেছে; কবিতা হয়েছে। এ জন্য কোন কিছুর সঙ্গে আমরা যখন মূল্য যোগ করতে যাই, তখন কাজটা কঠিন। বাংলার ইতিহাসে শত শত কবিতা রচিত হয়েছে। চারণ কবিরা যে কবিতা রচনা করে গেছেন তার ওপর কাজ করছি আমরা। ওটা ছিল আমাদের কবিতা ভিত্তি। কবিতার কাজটি কঠিন। কারণ কবিতা অনেক জিনিসকে এক জায়গায় করে। আমার যে অভিজ্ঞতা তা আমি দেখছি, অনুভব করছি। উক্তি ও উপলব্ধিকে আমি একটা জায়গায় আনার চেষ্টা করছি। আমি দেখছি সেখানে ছন্দটা কাজ করে কিনা, সেখানে মেটাফর কাজ করে কিনা, নন্দনতত্ত্ব কাজ করছে কিনা, শব্দ-আঙ্গিক-বিন্যাস সবকিছু মিলে ভাষাটা কিন্তু আর ভাষা থাকছে না। একটা ভাষাকে আমি অনেক মাত্রায় দেখে তাকে অন্য একটি জায়গায় নেয়ার চেষ্টা করি। বলায় বার্তা, লেখার বার্তা ও কবিতার বার্তা কিন্তু এক নয়। এই কাজটি যখন করতে হয় তখন একজন কবিকে বহু কিছু আত্মস্থ করতে হয়। তাকে তার সময়কে, আত্মজীবনীকে আত্মস্থ’ করতে হয়। কবি যাই লেখেন তা তার আত্মজীবনীর অংশ, সেটা তার স্বপ্নের অংশ। কবি মেমোয়াস লেখেন, কিন্তু তা আরেক জনের মতো নয়। কবি মেমোয়াস লেখেন ছোট ছোট বিন্দু দিয়ে। বিন্দু থেকে সিন্ধু হবে কিংবা আলাদা ব্যাখ্যা হবে। আমরা আমাদের যাপিত জীবনের বহু অভিজ্ঞতাকে এক জায়গায় কম্পোজ করার চেষ্টা করি। ফলে কবিতাকে সময়ের থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, শুধু আত্মজীবনী কবিতা না, শুধু স্বপ্ন কবিতা না, শুধু বাস্তবতা কবিতা না। কোথায় তাহলে কবিতা? আমি মনে করি, স্বপ্ন ও বাস্তবের পরে যে জায়গাটি তৈরি করে তা-ই কবিতা। যার সবটুকু ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য কবিতাকে বলা হয় রহস্যময়, কবিতাকে বলা হয় মনোজাগতিক। অবজেক্টটিভলি লিখলে কবিতা হবে না, কবিতার বিষয়টি গাণিতিক। কিন্তু কবিতার অনুভব হচ্ছে মনোজাগতিক। ‘হে মাটি পৃথিবীপুত্র’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের কবি উৎপলকুমার বসুর মূল্যায়ন : “চমৎকার কবিতা লেখেন কামাল চৌধুরী। বাংলা কবিতায়, গত কয়েক দশকে, যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই কবিতাগুলো পাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অফুরন্ত অথচ নিয়ন্ত্রিত চিত্রকল্পের ব্যবহার, ‘তুমি’ বলে অনির্দিষ্ট কাউকে আহ্বান যিনি প্রেমিকা হতে পারেন, দেশমাতা হতে পারেন, আবার নেহাতই কোন বন্ধু বা সহযাত্রী হতে পারেন এবং সেই সঙ্গে বহু দৃশ্য, সংলাপ ও রাগ-অনুরাগে লিপ্ত মানুষ-জন, ভূ-প্রকৃতি এবং পাঠক-পাঠিকা সমেত আশ্চর্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা এক জগতের কথা এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে।”
×