ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের কথাকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের কথাকার

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তুলিতে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে ব্যতিক্রম ভঙ্গিতে, নান্দনিক চিত্রে। তাঁর ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ গল্পের পরতে পরতে স্বাধীনতাযুদ্ধের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের যুগল ছাপচিত্র স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এটি একটি রূপক গল্প তো বটেই, সে রূপকতার মধ্যে বুক চিতিয়ে আছে ইতিহাসের নির্মম এক বাস্তবতার ছায়া। গল্পটি শুরু হয়েছে একটি স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে। গল্পের নায়ক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইমামুদ্দিনের এতিম সন্তান ‘বুলেট’ (ডাক নাম) অবিকল বাবার মতোন খুঁতখুঁতে স্বভাব নিয়েই পৃথিবীতে এসেছে। ফলে লালমিয়া নিজের স্বপ্নের ঘটনাটা ইমামুদ্দিনের ছেলের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছেন ( ইমামুদ্দিনও বেঁচে থাকতে লালমিয়ার যেকোনো কথায় বাগড়া দিয়ে বক্তব্যের মধ্যে ছন্দপতন ঘটিয়ে ছড়াতো)। বুলেটের আচরণ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী লালমিয়ার ভেতরে রাগ-ক্ষোভের সঞ্চার ঘটলেও, চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলা মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুটির একমাত্র সন্তানকে নিজের কাছে রেখে বড় করতে পারায় তার গৌরবের কোনো শুমার নেই। ফলে রাগগোস্সা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আগের দিন রাতে লালমিয়া স্বপ্নের মধ্যে এমন একজন নেক্কার বান্দাকে দেখেছে অই বয়ানটাই পিচ্ছি বুলেটের কাছে পেশ করতে উদ্গীব হয়ে উঠলো। কিন্তু হাজারো চেষ্টা করে লোকটার মুখটা আবিষ্কার করতে না পারার খেসারতে বুলেটের মুহুর্মুহু প্রশ্নবাণে জর্জরিত লালমিয়া অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। লালমিয়ার বক্তব্যের একাংশ লেখক ঠিক এই ভাবে তুলে ধরছেনÑ ‘আরে খামোস মাইরা হোন না ছ্যামরা! - বুইড়া মুসল্লি, মুরুব্বি, আমাগো মুরুব্বির মুরুব্বি।-তাজিম কইরা পাওয়ের দিকে দেখলাম। বুইড়া মিয়ার পাওয়ের দিকে দেখচি তো, নজরে পড়লো পাওয়ের পাতা দুইখান। হায়, হায়! পাওয়ের পাতা দুইখান তার পিছন দিকে!’ মানুষের পায়ের পাতা সাধারণত সামনের দিকে ছড়ানো থাকে কিন্তু স্বপ্নে আসা নেক্কার লোকটার পায়ের পাতা পিছনের দিকে ঠাসা! এই অদ্ভুত রহস্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায় গল্পের শেষ দিকে। ভদ্র্রবেশি এই লোকটা আসলে অন্য কেউ নয়, এই লোকটাই হচ্ছে এলাকার কুখ্যাত রাজাকার নাজির আলি, যে কিনা যুদ্ধকালীন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো, দখল করেছিলো সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর আর পাকবাহিনীর সাথে আঁতাত করে ধর্ষণ-হত্যায় মেতে উঠেছিলো। ফতোয়া দিয়ে বাঙালি জাতিকে কাফের আর ইন্ডিয়ান মুর্তাদদের অনুসারী ঘোষণা করেছিলো! ইসলামের সূতিকাগার হচ্ছে আরবদেশ। কিন্তু একশ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী মনে করে পাকিস্তান হচ্ছে ইসলামের আসল সূতিকাগার। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা মানেই ধর্মের বিপক্ষে কথা বলা, নাস্তিক বনে যাওয়া। এই নাজির আলিরাইতো একদা শান্তির ধর্ম ইসলামের বাণীকে অপব্যবহার করে মানুষ হত্যাকে ‘কতল’ এবং নারী ধর্ষণকে ‘গনিমতে’র মাল হিসেবে অপপ্রচার করে বেড়িয়েছিলো। ধর্মের লেবাসধারী এই অধার্মিক লোকটাই(নাজির আলি)তো একদিন নারী ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে সমর্থন দিয়ে ঠা-ামাথায় বলে উঠেছিলোÑ ‘আমার দ্বীনের জন্যে হাজার মাইল দূর থেকে মিলিটারি এসে জান কোরবান করে দিচ্ছে, তাদের শরীরের তো কিছু চাহিদা থাকে। সেটুকু মেটাতে না পারলে নিমকহারামি করা হয় না?’ রথখোলার ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার গ্রেনেড ছুঁড়ে উড়িয়ে দিয়ে পালানোর সময় রাজাকার নাজির আলির সহযোগিয়তায় মিলিটারির হাতে খুন হয় বুলেটের মুক্তিযোদ্ধা পিতা ইমামুদ্দিন। তারপর তার মা ও চাচাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায় তারা। সাথে ইমামুদ্দিনের বাল্যবন্ধু লালমিয়াকেও নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাজাকার নেতা নাজির আলির দোকানের কর্মচারী হওয়ায় নিজের স্বার্থেই সে পাকবাহিনীর হাত থেকে লালমিয়াকে উদ্ধার করে আনলো এবং সাবধান করে দিলো। কিন্তু ইমামুদ্দিনের স্ত্রী ও ভাইকে ফেরৎ আনার ক্ষেত্রে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। উল্টো খোশমেজাজে সে এ ঘটনার শক্ত সমর্থন দিলো। লেখকের ভাষায়Ñ ‘নাজির আলি লালমিয়াকে মিলিটারির হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে দুই সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু ইমামুদ্দিনের ভাই ও বৌকে ছাড়িয়ে আনা তার সাধ্যের বাইরে। মিলিটারিকে জখম করে ইমামুদ্দিন মারা পড়ল, ‘কিছু গুনাগারি তো দিতেই হইবো!’ দেশ স্বাধীনের পরপরই এলাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো নাজির আলি, ফিরে এসেছে অনেক বছর পরে। ততদিনে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে নাজির আলি নিজেও। মুখভর্তি লম্বা সাদা দাড়ি, চুলে-গোফে মেহেদী, বিশাল ধর্মীয় আলখেল্লা পরে একদিন সে মহল্লার বড় মসজিদে নামাজ আদায় করে সবাইকে লম্বা করে সালাম ঠুকতে লাগলো। ছড়াতে লাগলো ধর্মের বাণী। এলাকায় প্রচার করতে লাগলো সে মক্কা-মদীনার পবিত্র মাটিতে এতোদিন খোদার গুণকীর্তন এবং নবীজির দরুদ পাঠ করে কাটিয়ে দিয়ে এসেছে। বাকি জীবনে খোদার গোলামি এবং এলাকাবাসীর সেবা করেই সে কাটাতে চায়। সবাই তার ভ-ামির ধরতে না পারলেও অত্যাচারের শিকার হয়েছে যারা তারা ঠিকই তার ভ-ামি ধরতে পেরেছে। কিন্তু কিছুই করার নাই। স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রভাবশালীরা এখন তার আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক নেতারা কাছের মানুষ! যুদ্ধকালে হিন্দুর জমিন দখলে আনা জায়গাতে সে লালমিয়াকে এবং অসহায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধার মাকে থাকার সুবিধা করে দিয়ে নিজেকে আরো মহান সাজানোর চেষ্টা করলো। অথচ তলে তলে দেশকে আবার অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তান বানানোর গোপন ফন্দি আটঁতে লাগলো। সেই রাজাকার নেতারই ভিন্নরূপ স্বপ্নের মধ্যে ধরতে পারলো মুক্তিযোদ্ধাপুত্র বুলেট। লালমিয়ার মতো স্বপ্নটা সেও একদিন দেখলো। তবে সে কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছিলো পশুটাকে। ঘটনাটা সে লালমিয়ার কাছে খুলে বললো। ইলিয়াস অবুঝ বালক বুলেটের স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেনÑ ‘‘কাউলকা রাইতে ঐ শাহ সাহেব মুসল্লিরে দেখলাম। খাবে আমারে দেখা দিয়া গেল। আপনে যানি কুন মসজিদে দেখছিলেন? আমি দেখলাম খুব সুন্দর মসজিদের দোতলায় খাড়াইয়া শাহ্ সাহেবের রাস্তা দেখতাছে। পাও দুইখান তার ঠ্যাঙের লগে উল্টাদিকে ফিট করা। চাচা, আমার মনে লয়, শাহ সাহেবের পায়ের ব্যারাম আছেÑ।’ রাজাকারের পায়ের পাতা উল্টো দিকে ছড়ানো। তার মুখ একদিকে আর পায়ের পাতা আরেক দিকে অর্থাৎ পা তার মুখের বিপরীত। সাধারণ-চোখ দিয়ে দেখলে, এরা ইমানদার, সমাজের অনেক উঁচুস্তরের প্রণম্যজন। কিন্তু এই ধর্মভীরুর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর শয়তানি। মুনিব হওয়ার দৌলতেই হোকে কিংবা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই হোক অথবা অন্য কোনো গোপন কারণেই হোক না কেনÑ লালমিয়া নাজির আলির আসল চেহারাটা আবিষ্কার করতে না পারলেও অবুঝ বালক ‘বুলেট’ ঠিকই আবিষ্কার করে ফেলেছে। স্বভাবতই মানুষ অতীকে খুববেশি মনে রাখতে চায় না, সামনে যা দেখে সেটাই আঁকড়ে ধরতে চায়। তাই ভালো চেহারা দেখে ভক্তিশ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করতেও কুণ্ঠিত হয় না। অগোচরে থেকে গেলেও কেউ না কেউ ধরতে পারে এরা মানুষ নয়, মানুষরূপী ভ-, প্রতারক। লালমিয়া বুলেটের স্বপ্নের কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারলো না। নিদারুণ এক ধন্দে পড়ে গেলো সে। এ ব্যাপারে লালমিয়ার বক্তব্যও গল্পের একাংশে দেখা যায়Ñ ‘মিছা কথা কইস না ছ্যামরা।’ বিরক্তি, ভয়, ক্ষোভ এমনকি আদরে লালমিয়া চুপসে যায়, এই এতিম বালকের ভবিষ্যৎ কী? ছোঁড়া নামাজ পড়ে না, রোজা করে না, পেচ্ছাব করে পানি নেয় না, নাপাক থাকে;Ñআর সে কিনা স্বপ্নে ঐ সাহেরকে দেখার স্পর্ধা করল। কী সাহস! এরকম দুঃসাহসের পরিণতি কী ও জানে? বাপের বেপরোয়া স্বভাব, তার চাপাবাজির খাসলৎ কি জেগে উঠল এই ছেলের মধ্যেও?’’ স্বপ্নটাতে যখন ধীরে ধীরে উল্টো পায়ের লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। অশনিসংকেতই মনে হলো। কেননা এই বিকলাঙ্গ পা তাদের মস্তিষ্কের বিকৃতরূপ! ফলে একটা হিতব্যবস্থাও হয়ে গেলো। মোহাম্মদ কাসেম নামের ৭দিন বয়েসী যে শিশুবাচ্চাটির প্রস্রাবের তীব্রতায় শরীর ভিজে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকতে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইমামুদ্দিন গর্ব করে বলেছিলেনÑ ‘প্যাসাব করে, মনে লয় বুলেট ছাড়তাছে।’ তারপর থেকেই মোহাম্মদ কাসেম নাম বদলে অটোমেটিকভাবেই সে শিশুর নাম ‘বুলেটে’ পরিণত হয়ে গেলো। সেই গর্বিত পিতাকেই রাজাকার নাজির আলির সহযোগিতায় হত্যা করেছে পাকবাহিনী, মা আর চাচাকেও ফিরিয়ে দেয়নি তারা। স্বপ্নের ভেতরে হলেও সেই বর্বর বাহিনীর দোসরদের কর্মকা-ের প্রতিশোধ নিয়েছে সে, ঘৃণা ও প্রস্রাবের বুলেট নিক্ষেপ করে। তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার ভবিষ্যৎ বাণীটিই হঠাৎ যেন স্বপ্নের মধ্যে সত্যি হয়ে ধরা দিলো। লেখকের ভাষায়Ñ ‘এই লোকটির নেতৃত্বে ওলটানো পা-ওয়ালার একটি পার্টি বুলেটের দিকে তেড়ে এসেছিল, সেটা স্বপ্নে না জাগরণে, সেটা কোন জায়গা, সেটা কবেÑ এর কিছুই মনে করতে না পারলেও তার একটু উদ্বেগ, এমনকি উত্তেজনাও হয় না। লোকটির পায়ের পাতাজোড়া মেরামত করতে হলে ওগুলো আগে ফেলে দেওয়া দরকারÑ এই বিবেচনায় বুলেট ওদিকে কী ছুঁড়বে তাই নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে। সে তার প্যান্টের এ-পকেট হাতড়ায়, ও-পকেট হাতড়ায়, কিছুই নেই দেখে ভাবনা আরো বাড়ে। এই রকম ভাবতে ভাবতে তার বড্ডো পেচ্ছাব চাপে। হাউস বিল্ডিং কর্পোরেশনের ছাদে ঐ কর্পোরেশনের বা মিউনিসিপ্যালিটি কর্পোরেশনের বা সরকারেরও কোনো পাবলিক টয়লেট নাই। পেচ্ছাবের বেগ বাড়ে। একরকম বাধ্য হয়েই বুলেট ছাদ থেকে হলুদ প্র¯্রাবের ধারা বইয়ে দেয় নিচের দিকে। এর মধ্যেই সে তাগ করেছে গাল থেকে দুধের নহর বইয়ে দেয়া ঘিয়ে রঙের আলখাল্লাওয়ালার ওলটানো পায়ের পাতা। ইমামুদ্দিন ও তার রাইফেল উপাধিপ্রাপ্ত স্ত্রী উপস্থিত থাকলে ৭দিন বয়সের বুলেটের প্র¯্রাবের বেগের যথাযথ বিবর্তন ও বিকাশ ঘটেছে কিনা বলতে পারতো। তার তীব্র বেগ হয়তো সন্তোষজনক ছিলো, কিন্তু ওলটানো পায়ের পাতা তার প্র¯্রাবের ঝাঁঝ আঁচ করতে পেরে জাফরি-কাটা দেওয়াল টপকে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছে তাদের অদৃশ্য আখড়ার ভেতর। ওদিকে বাতাস বইছিল একটু-একটু, তার প্র¯্রাবের অনেকটাই হওয়ায় এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে।’ অদ্ভুত রহস্যঢাকা আর ঘোরের করতলে আটকে থাকা এই গল্পটিকে প্রতীকী গল্প, পরাবাস্তবতা কিংবা যাদুবাস্তবতার গল্প অথবা রূঢ়বাস্তবতার গল্পÑ যেটাই আখ্যায়িত করা হোক না কেন; স্বাধীনতার শত্রুরা যে সত্যের বিপরীত ¯্রােতে অবস্থান নিয়েছিলো। মুখের কথা আর অন্তরের চিত্রের মধ্যে যে তাদের গোপন বৈপরীত্য লুকিয়ে ছিলো। ধর্ম ও দেশের উন্নয়নের ধোয়া তুলে দেশকে যে তারা পিছনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। বারবার ধর্মকে কলঙ্কিত করে পাকিস্তান কায়েমের চক্রান্তে মেতে ওঠেছিলোÑ তারই প্রতীকীচিত্র এই উল্টো পায়ের পাতা! চিত্রকল্পটি ইলিয়াস এতোটাই চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন যে লেখাটা পাঠমাত্রই পশ্চিমাবাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতি সর্বস্তরের জনতার ঘৃণার বারুদ উথলে উঠবে। গল্পে বুলেটের বাবা-মা এবং চাচার হত্যাকারীদের চেলারা এতোদিন পরেও যখন স্বাধীন রাষ্ট্রে দাপট খাটিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ছড়ি ঘুরায়; বাস্তবে তাদের কিছু করতে না পারলেও স্বপ্নযোগে সে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। এতেই তার সীমাহীন স্বস্তি, তবে এরচে বড় কোনো প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেও ভেতরটা তার আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। জাদুবাস্তবতার রূপকার নোবেল জয়ী লেখক গ্যাবরিয়াল গার্সিয়া মার্কাসের ‘কারলিউসের রাত’ গল্পে যখন একটি ধূর্ত পাখি অমানবিক কা- বেরিয়ে একটা দলকে বিভ্রান্ত করে দেয়, তখন পাঠকমাত্রই শঙ্কিত হন এবং পাখির প্রতিও ঘৃণা উগরে ওঠে। ইলিয়াসের গল্পের খলনায়কদের উল্টো পায়ের পাতার দৃশ্যপটও পাঠকের বিবেকবোধের কপাটকে ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয়। চীনা গল্পকার মো ইয়ানের গল্পের নায়িকা যখন ডানাহীনভাবেই এ গাছ থেকে ওগাছে ওড়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে অথবা মাকার্স যখন আকাশে হাতি উড়ানোর গল্প শোনান কিংবা কাফকা যখন মানুষকে পোকা বানিয়ে সমাজবন্দি করে রাখার ধৃষ্টতা দেখান, তখন অবিশ্বাসের চেয়ে বিশ্বাসের পাল্লাটাই ভারি হয়ে ওঠে। আর ইলিয়াস যখন রাজাকারের পায়ের পাতা উল্টো দিকে সেট করে দেন এবং নূরানি চেহারাধারীদের নোংরামুখ অবারিত করে দেন তখনও পাঠকমহলে অবিশ্বাসের হেতু একেবারেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা ইলিয়াসের আরো একটি শক্তিশালী গল্প হচ্ছে ‘রেইনকোর্ট’। শিক্ষিত ও নিরীহ জাতিগোষ্ঠীর উপর পাকবাহিনী যে ভয়ংকর নির্যাতন চালিয়েছিলো সেটাই রেইনকোট গল্পে অত্যন্ত করুণভাবে উঠে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের রেইনকোট পরিধান করে ভীরু এবং রাজনীতিবিমুখ দুলাভাই যে উদ্দামতা খুঁজে পেয়েছেন সেটাই গল্পটিকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে শহীদ মিনারসহ প্রেরণাদায়ক স্থাপত্যসমূহ ভেঙে ফেলার যে চক্রান্ত করা হয়েছিলো সেটাও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন তিনি ‘রেইনকোট’ গল্পে। সংখ্যার দিক থেকে ইলিয়াসের লেখাজোখা অল্পপ্রজ বটে কিন্তু বিষয়-বৈচিত্র্যের ভিন্নতার দিক থেকে তাঁর দৃষ্টি বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। সবসময়ই গল্পের টেবিলে তিনি হারকিসিমের বিষয়ের পসরা সাজিয়ে রাখেন। ইলিয়াস মনে করতেনÑ একজন মানুষের অন্তত তিনশ’ বছর বেঁচে থাকা উচিত। অথচ অর্ধশত বছর অতিক্রম করতে না করতেই ঘাতকব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তাড়াহুড়ো করেই যেন পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে চলে গেলেন তিনি!
×