ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

আদিমতা আদিম পৃথিবীর সঙ্গে তার সত্য-স্বভাব এবং স্বাস্থ্যের আদর্শকে অবলম্বন করে যে শিল্প-সাহিত্য প্রক্রিয়ায় অনেকে নিযুক্ত হয়েছেন তাকেই আদিমতা বলে। শিল্পী গঁগ্যাঁ, পল ক্লী আদিম শুচিতাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। পিকাসো চেষ্টা করেছিলেন তাঁর নিগ্রো মোটিফের কিছু চিত্রে এবং ভাস্কর্যে। প্রেমের ব্যঞ্জনার উদ্ভাষণে পূর্ণতার ব্যাখ্যায় পল ক্লীর একটি কবিতার কিছু পাঠ- ‘যখন বাস্তবকে আর সহ্য করা যায় না তখন স্বপ্ন হয় খোলা চোখের প্রহেলিকা- হে ভীষণ জাগ্রত স্বপ্ন মঞ্জরী হে অসম্ভব স্বপ্নের কুয়াশা-নিবিড় অন্তঃসার দিবস কি সব মুছে শুধু প্রেমের তাপে অগ্নি হবে না?’ বিশুদ্ধতাবাদ শিল্পে বিশুদ্ধতাবাদের উদ্ভাবক হচ্ছেন বিখ্যাত স্থপতি লা করবুসিয়র। স্থাপত্যের গঠনাত্মক স্বরূপে তিনি যে সমস্ত ডিজাইন তৈরি করেছেন নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলায় এবং বিশুদ্ধতায় তা পিওরিজম বলে পরিচিতি লাভ করে। এ পদ্ধতিকে অবলম্বন করে আধুনিককালে মসৃণ ডিম্বাকৃতি অথবা পাখির ডানার আদলে ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছেন শিল্পী ব্রঁকুশি (ইৎধহপঁংর)। বস্তুরূপহীন চিত্রধারা পিয়েৎ মন্দ্রিয়ান জ্যামিতিক লম্ব এবং সমান্তরাল রেখার সাহায্যে চতুষ্কৌনিক আয়তন নির্মাণ করে প্রধানত নীল, কালো, সাদা এবং লাল রংকে এক একটি আয়তনে আবদ্ধ করে একটি বস্তুরূপহীন চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর চিত্রগুলো আধুনিক স্থাপত্য কলায় প্রভাব বিস্তার করেছে। যান্ত্রিক সত্তাগত শিল্প আধুনিক কালে যন্ত্রের বিচিত্র আকৃতির স্বরূপকে চিত্রকর্মে, ভাস্কর্যে এবং স্থাপত্যে ব্যবহার করার পদ্ধতিকে মেশিন আর্ট বলে। চিত্রকর্মে এ পদ্ধতিকে একটি গ্রহণযোগ্য রূপ দিয়ে ফারনদ লেগার খ্যাতি অর্জন করেন। একে মেশিন ঈস্থেটিক (গধপযরহব ধবংঃযবঃরপ) বলা হয়ে থাকে। বিন্দুবাদ দৃষ্টির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে রং-এর বিভাজন পদ্ধতিতে ক্যানভাসে একক রংকে বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে যে শিল্পপ্রক্রিয়ার জন্ম হল তাকে বিন্দুবাদ বলা হয়। রং-এর মিশ্রণ না ঘটিয়ে বিন্দুগুলোকে একে অন্যের নিকটতম সন্নিবেশনায় উপস্থিত করে দৃষ্টিগত মিশ্রণ সৃষ্টি করে সুরাত (ঝবঁৎধঃ) বিন্দুবাদের জন্ম দিয়েছেন। অরফিজম যেখানে ভবিষ্যবাদ আক্ষরিক অর্থে গতিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলো, সেখানে অরফিজম তারই পরবর্তী ধারা হিসেবে ফর্ম, রং এবং গতিকে সমন্বিত করে উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছিলো। দেলোনে, পিকাবিয়া এবং ডুকাম্প চিত্রকর্মকে জ্যামিতিক ফর্মের পরিবেশনায়, রং-এর পরিশীলিত বিন্যাসে শরীরের বস্তুত্ব বা গধঃবৎরধষরঃু ভেঙ্গে একাকার করে অরফিজমের জন্ম দিয়েছেন। অরফিজমের উদ্দেশ্য ছিলো শিল্পকে তথাকথিত বিচারবুদ্ধি এবং যুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। রূপবাদ প্রথাসিদ্ধতার বাইরে উন্মুক্ত আলোয় বস্তুসত্তার একটি নতুন রূপের চিত্রাঙ্কন করলেন ক্লদ মনে (গধহবঃ), রেনোয়া, দেগা এবং এঁদের সমসাময়িক আরও কয়েকজন ফরাসী শিল্পী। আপতিত সূর্যরশ্মির সতত চঞ্চলতা এবং কম্পমানতায় বস্তস্বরূপকে রং-এর বৈচিত্র্য এবং ঘনত্বে উদ্ভাসিত করার যে প্রয়াস ঘটেছিল তাকে রূপবাদ বলে। ইমপ্রেশনিস্টদের বিষয়বস্তু ছিলো ল্যান্ডস্কেপ, নদী, রাস্তা এবং সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দৃশ্যও যেমন ক্যাফে অথবা থিয়েটার হল। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে সূর্যরশ্মি যেখানে ঘনীভূত, তীব্র নয়, বরঞ্চ লঘুভাবে পরিব্যাপ্ত সেখানে ধূসর বর্ণের বৈচিত্র্যগুলো সহজেই ধরা পড়ে। ইমপ্রেশনিস্টরা উন্মুক্ত এলাকায় আলোর অনুভূতিকে চিত্ররূপে ধরার চেষ্টা করলেন; দেখা গেলো, আলোর বিচিত্র রং-এর বিভাজনের কম্পমানতার কারণে বস্তুস্বরূপ নতুন নতুন গঠন নিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। নির্মিতিবাদ যন্ত্রের উপকরণ, ধাতব দ্রব্যের প্রয়োগ এবং ভাস্কর্যের একক দণ্ডায়মানতাÑএ তিনের সমন্বয়ে নির্মিতিবাদের সৃষ্টি। যন্ত্রযুগের নানাবিধ নির্মাণ কৌশলে পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটেছে, ফর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এর ফলে আধুনিককালে কোনো কোনো শিল্পী চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যের মধ্যে ফর্মের দিক থেকে সমন্বয় সাধন করে একটি নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছিলেন যাকে আমরা নির্মিতিবাদ বলছি। ১৯২০ সালের পর থেকে এ শিল্প আন্দোলনটি বিক্ষিপ্তভাবে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয়। কবিতার ক্ষেত্রে ১৯২০-এর দশকে কয়েকজন তরুণ রুশ কবি নির্মাণবাদ প্রচার করেন। তাদের মতে, কবিতা হবে প্রযুক্তি বা প্রকৌশলকর্মের মতো নির্মাণ। কোনো কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা, চিত্রকল্প এবং অন্যান্য কৌশলকে কবিতাটির বিষয়বস্তুর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই মতবাদের অনুসারী প্রধান কবি ভেরা ইনবার এবং ইলায়া সেলভিনস্কি। অধিচৈতন্য হাজার বছরের আধ্যাত্মবাদের ইতিহাসে ‘ইনটিউইশন’-এর ক্ষেত্রে ইকবালের অবদান উজ্জ্বলতম। ‘ইনটিউইশন’-এর যথার্থ তাৎপর্যবাহী প্রতিশব্দ হতে পারে অধিচৈতন্য; শিল্প-সাহিত্যে স্যুরিয়ালিস্টরা যে ধরনের জ্ঞানের কথা প্রচার করেন সে বিবেচনায় একে স্বজ্ঞা কিংবা স্বতঃজ্ঞানও বলা যায়। ইকবাল ইনটিউইশনকে অভিজ্ঞতাবাদী চৈতন্য এবং বুদ্ধিবাদী চৈতন্য এ দুয়ের সমপর্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বলে মনে করেন। তবে জ্ঞানের উর্ধমুখী যাত্রায় এইসব সাধারণ চৈতন্যের স্তর অতিক্রম করেই কেবল ইনটিউইশন-এর স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। অধিচৈতন্য সংবেদন ও মননের মতোই একটি জ্ঞানবৃত্তি বিশেষ। এ এক অনুভূতিজাত ব্যাপার। তবে তার অর্থ এ নয় যে, এর জন্য মন্ময়তার মধ্যে আচ্ছন্ন হতে হবে। চরিত্র-বিচারে অধিচৈতন্য বিষয়মুখী। বিংশ শতাব্দীর শিল্প-সাহিত্যে এ ধারণার উপস্থিতি ব্যাপক। (চলবে) সৌম্য সালেক
×