ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাসনাত মোবারক

রম্যরসে সমাজ নিরীক্ষণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

রম্যরসে সমাজ নিরীক্ষণ

প্রাত্যহিক জীবনে আমরা কত গল্পই না তৈরি করি। কত গল্পই না বলে যাই। আর এতসব গল্পের ভেতরে কেউবা আছেন, শুধু সাজিয়ে গল্প বলে যান। আর এই গল্প বলে যাওয়ার মধ্যে কথকের রসবোধ শ্রোতাকে আটকে রাখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। গল্পকথক আর লেখক সম্পূর্ণ সৃজনের আলাদা ধাঁচ। গল্পলেখক গল্প বয়ানের সময় শব্দ সৌন্দর্যের বিষয়টি মাথায় রাখেন সর্বক্ষণ। শব্দ আর বাক্যের যথাযথ মেলবন্ধনই গল্পলেখককে সত্যিকারের গল্প লেখক হিসেবে পরিণত করে। পাঠক তো হরহামেশা কত গল্পই শুনছেন। তাহলে গল্প পাঠের কেন প্রয়োজন। হ্যাঁ তখনই পড়বেন যখন লেখকের পারঙ্গমত ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়। স্বকীয়তা খুঁজে পায় গল্পের বয়ানে ও শব্দের বুননে। তরুণ গল্পকার শফিক হাসানের ‘সবার উপরে ছাগলের সত্য’ গল্পগ্রন্থ পাঠান্তে একেবারেই গুণমুগ্ধ হয়েছি লেখার প্রতি। গল্পগ্রন্থটি পুরোপুরিই রম্যের, রঙ্গ, করুণ রসাত্মক। হয়ত ভাবতে পারেন রসাত্মক আবার করুণ হয় কী করে। হয় যদি লেখকের কালো কালির কলমটিতে ক্যারিশমা থেকে থাকে। একটি জীবনবাদী গল্পগ্রন্থের ভেতরে খুঁজে পাই জীবনের বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি। চিত্রায়ন করেছেন সমাজের নানা অসঙ্গতি। গল্পের অন্তঃশরীরে বিশালভাবে প্রবেশ করিয়েছেন সামাজিক চিত্র। নির্মাণশীল এই গ্রন্থের সমাজের এক শ্রেণীর কপট, ভ মানুষের সত্যিকার চরিত্রটি চিত্রণ করেছেন। গল্পকার সহজ শব্দ তথা সরল বাক্যে গ্রন্থের আবরণ করেছেন। জীবন তথা জগৎ এই তো সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়। এর উপস্থিতি না থাকলে তাকে তো সাহিত্য বলা যায় না। সে সেক্ষেত্রে নিরীক্ষাপ্রবণ এই গল্পকার শিল্পচৈতন্যের জায়গা ধরে রেখেছেন। প্রতিফলিত হয়েছে সমাজ, রূপায়ণ করেছেন সাহিত্য। কোমল ভাবাবেশে অনুপ্রবেশকৃত গল্পে গল্পে সত্যিকার অর্থেই গুণমুগ্ধ হয়েছি। কোথাও হোঁচট খাইনি। গ্রন্থভুক্ত তেরোটি গল্পের শৈল্পিক উপস্থাপনার জানান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে প্রথম গল্প ‘মহাবিপদে রবিঠাকুর’। স্যাটায়ার করে উপস্থাপন করার ক্ষমতা একমাত্র বড় শিল্পী মাত্র পারেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথকে জীবন্ত করে তুলেছেন। প্রত্যেক বড় লেখকই ধারাবাহিক সিরিজ, নির্দিষ্ট কিছু চরিত্র থাকে। সেই চরিত্রের মাধ্যমে গল্প বলা তথা লিখে যান। তেমনি এই গল্পকারেরও নোমান মামা চরিত্রটি। এই ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের গ্রন্থভুক্ত বেশকিছু গল্পে নোমান মামাকে সবার মামা হিসেবে মনে হয়েছে। ঘটমান প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে গল্পে গল্পে একজন নোমান মামাকে উপস্থাপন করেছেন। বেশ পাকাপাকিভাবেই এই চরিত্রের রূপায়ণ। গল্পে গল্পে নতুন মাত্রা বা পথেরও অবতারণা রয়েছে। তাই তো গ্রন্থ পাঠের ভেতর থেকে তাড়না জুগিয়ে অবশেষে দু’চারটি দৌড়থোড়া বাক্য লেখারও অনুপ্রেরণা হলো গ্রন্থ বিষয়ে। শব্দ কৌশলী এ গল্পকার গল্পের মাধ্যমে নিজের বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ রেখেছেন। ‘নোমান মামার ক্রিকেট আন্দোলন’ গল্পে বৃহত্তর পরিসরে ধাক্কা দিয়েছেন সমাজের বাউ ুলে স্বভাবের তরুণ সমাজকে। সহজ আঙ্গিকে গল্পকার বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্ত সমাজব্যবস্থাকে। সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার তরুণ সমাজ। সেই তরুণ সমাজকে দিয়েই গল্পের বাতাবরণ করেছেন। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গল্পগুলো পাঠ করলে অনায়াসে বোধগম্য হবে লেখকের ক্যারিশমা। রোমাঞ্চ আর রঙ্গের ঢঙে গল্পকে এগিয়ে চলছেন পাঠনের পরিরাজ্যে। ‘সাইনাস গ্রন্থের আগন্তুক’ গল্পে পুরোটাই বাঙালী কপট বুদ্ধিজীবীদের ধাক্কা দিয়েছেন। আমাদের সমাজ তথা প্রচলিত ধ্যান আর ধারণার অনুষঙ্গ নিয়ে লিখেছেন ‘ভাংতি বাণিজ্য’ গল্পটি। ‘দুই পায়ের চালাক গরু’ গল্পটি পাটকের পাঠতৃষ্ণা শেষে পরিতৃপ্ত করে ছাড়বে। প্রচলিত প্রবাদ ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ সেক্ষেত্রে গল্পকার মুন্সিয়ানার সাথে অবশেষে নোমান মামাকে চালাক গরু বানিয়ে ছাড়লেন। নোমান মামা প্রতারণার জালে আটকে পড়েছে। নোমান মামার করুণ পরিণতির জন্য পাঠকও অনুতপ্ত হবেন। লেখকের ভাষায় বলছিÑ ‘ভাবতে ভাবতে মামা আবিষ্কার করলেনÑ তিনি নিজেই আস্ত একটা গরু তবে সবচেয়ে সস্তা। যে গরু ঈদের দুইদিন পর কোরবানি হয়েছে, তাও ছুরি ছাড়াই!’ ‘পাদুকাপুরাণ’ গল্পটি এক ধুরন্ধর কবিকে নিয়ে। কুদ্দুস নামের এক ভ কবির কবি হওয়ার অতৃপ্ত বাসনা। অতি অল্পতেই কুদ্দুস খ্যাতি চান। লেখক অতি সফলতার সাথে গল্প বলতে বলতে অবশেষে ভ কবিকে জুতা পরিয়ে ছেড়েছেন। গল্পটি পাঠ শেষে একদিকে হাসি ধরে রাখতে পারিনি আবার ভেতর থেকে করুণার উদ্রেক হয়েছে। এতে ধরে নেওয়া যায় গল্পকার সফল হয়েছেন। অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটিতে তাড়না দিয়েছেন লেখক। পাঠকের মনোজগৎকে শক্তিশালীভাবে নাড়া দিয়েছেন। সমাজের এক শ্রেণীর দুষ্টপ্রকৃতির মানুষদের ছাগল বানিয়ে ছেড়েছেন। গল্পের ছলে, আড়ালে, অন্তরালে, পাঠক পাঠে অনায়াসে বুঝবেন ‘সবার উপরে ছাগল সত্য’। ‘মড়ক কিংবা মোড়ক’ নামক গল্পে লেখক তার নোমান মামাকে কবি বানিয়ে ফেলেছেন। সহজাত প্রবণতায় কবি হওয়ার প্ররোচনায় যারা ভোগেন সেই শ্রেণীর মধ্যে নোমান মামাও অন্যতম। তাই নোমান মামার কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে ঘটে হিতে বিপরীত ঘটনা। সেই বর্ণনা গল্পকার শফিক হাসান দিয়েছেন ক্যারিশম্যাটিকভাবে। পাঠককে সরাসরি উপস্থিত করেছেন বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে। আরো মজার কাহিনী প্রক্সি, অভাবির ভাবি, হঠাৎ নায়ক রয়েছে বইটিতে। তবে সেক্ষেত্রে ‘রেডিও এফএম ইয়ং স্টার নুন’ গল্পে গুলিস্তানের ফুটপাথের হকার থেকে স্টার হয়ে যাওয়া আক্কাসের কথা না বললেই নয়। হকার আক্কার স্টর হওয়ার পর আক্কাস আকাশ নাম ধারণ করে। বিপত্তিটি ঘটে যায় যখন আক্কাস এফএম রেডিওর অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে অংশগ্রহণ করে। ‘সিমকার্ডের জবানবন্দি’ গল্পটি একটি অসাধারণ বয়ান। সপ্রতিভ এই গল্পকারের সরবে গল্পগুলো পাঠককে আনন্দের পাশাপাশি শিক্ষাও দেয় বটে।
×