ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

জয় বাংলা কিংবা একটি হারমোনিয়ামের গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

জয় বাংলা কিংবা একটি হারমোনিয়ামের গল্প

রাতটা উদাস আর ছন্নছাড়া মোহন্তদের মতো ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিঃশেষ অন্ধকারের ছায়া পথের উপর গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। নিঃস্তব্ধতা কাটাতে কাদের আলী মাটিতে দু-একবার পা ঠোকেন। ঢুব-থুব! ভোতা আওয়াজে হাহাকার আরও বেড়ে যায়। অপরাধবোধগুলো ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করে। মগজের ভেতর দুশ্চিন্তা কিলবিল করে। আবারও মনে হয় কাজটা ঠিক হয়নি। মনে মনে ওয়াদা করেন কাদের আলীÑ এমন জঘন্য কাজ আর করবেন না। ছিঃ! কেউ বউয়ের সঙ্গে এমন রূঢ় আচরণ করে? কি-ই চেয়েছিল বউ। মেয়ের জন্য একটা হারমোনিয়াম। একটাই মাত্র মেয়ে তাদের নিশামনি। মাঝ রাতে জন্ম হয়েছিল বলে এই নাম। টাকা পয়সা তো তাদের কমতি নেই। বড় ছেলে ব্রুনাই থাকে। বিয়ে থা করেনি এখনও। বাপের জন্য মাস শেষে হাজার দুয়েক টাকা পাঠায়-তা দিয়েই ভালভাবে চলতে পারেন কাদের আলী। নিজেও বসে থাকেন না। টুকটাক ব্যবসা করেন। সুপারী-নারিকেলের গুদাম আছে তার। লাভও কম হয় না সেখানে। বাজারে গেলে লোকজন তাকে সালাম দেয়। সম্ভোধন করে ব্যাপারী বলে। তিনি কতবার বলেনÑ মিয়া ভাই বাপ-দাদাদের বংশ খাঁ। ঈশা খাঁর বংশের লোক। বেপারী বললে দিলে চোট লাগে। পরদাদাগণ আকাশে বসে ‘বেপারী’ ডাকের জন্য হয়তো প্রতিনিয়ত তাকে অভিশাপ দেন। কাদের আলীর ভয় লাগে। কিন্তু মানুষজনের ভোল পাল্টায় না। তারা ‘বেপারী’ বলেই ডাকে। আস্তে আস্তে পদবিটা এক প্রকার গায়ের সঙ্গেই লেপ্টে গেছে যেন। এখনও এ ডাকে বিরক্তি লাগে, তবে অসহ্য লাগে না! আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিলেন। বাজারে যেতে হবে। সুপারীর পাইকাররা মাল নেবে ঢাকায়। দাঁত মেজে চিঁড়া-মুড়ি ভিজে খেতে বসেছিলেন তখনই কথাটা পেড়েছিল কুলসুমা। মুখটা হাসি হাসি ছিল তার। আব্বাস মাস্টার কাইল আসছিল। কাইয়া গেল তোমার মাইয়ার নাকি চমৎকার গানের গলা। অতি চমৎকার। আব্বার মাস্টারকে ভাল করেই চিনেন বেপারী। সুহিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান তিনি। কেউ কেউ তাকে ডাকে ‘বাংলা স্যার’ বলে। সুশ্রি চেহারা। চুল একটাও মাথায় বলতে নেই। তবে মুখে দাড়ি আছে। চাপদাড়ি। মাস্টারের মুখে সুখী মানুষের মতো সব সময় হাসি লেগেই থাকে। কথা বলেন রসিয়ে রসিয়ে। কদ্দুস মিয়ার চায়ের দোকানে বসলে চায়ের কাপে মাঝে মাঝে কবিতা নাড়াচাড়া করেন তিনি। বড়ই চমৎকার তার গলা। যখন তিনি মধ্যযুগীয় কবি আবদুল হাকিমের সেই কবিতাখানি আবৃত্তি করেন, শ্রোতারা তখন নিঃস্তব্ধ হয়ে শব্দগুলো গিলতে থাকে। আনন্দে কেউ কেউ ভঙ্গিমা করে বলে-আহা! আহা! কী কবিতাখানা! আবার পড়ো মাস্টার, আবার...। চার গ্রামের মধ্যে একটি মাত্র হাই স্কুল। সেই স্কুলের মাস্টার কারও বাড়িতে আসা চারটিখানি কথা নয়। আর ‘বাংলা স্যার’ হলে আরও আশ্চর্যের ব্যাপার বৈকি। কাদের আলীও ভাত পাতে বসে আচম্বিত হলেন। ভাতের সঙ্গে মসুর ডাল খানিকটা মিশিয়ে মাখতে মাখতে আগ্রহ ফুটল তার কথায়। সঙ্গে কিছুটা বিস্ময়ও। নিশি যে গান গায় কথাটা জানতেন না তিনি। তাই স্ত্রীকে বললেন, তাই নাকি! মেয়ে দেখি বাপের নাম রাখব। মাস্টার আর কি কইল? স্বামীর খুশি খুশি ভাব দেখে নিজেও খুশি হয় কুলসুমা। কাদের আলীর পাতে একটু সজনে ডাটা তুলে দিতে দিতে বলেন, ‘মাস্টার কইছিল একখান হারমোনিয়াম কিইন্যা দিলেই তোমার মাইয়া গান গাইয়া পূর্ব পাকিস্তানে নাম করব।’ খ্যাতি আনব। তিনিও মাঝে মাঝে আইসা গান শিখাইবেন নিশিমনিকে। একটু থামেন কুলসুমা। কাদের আলী খাচ্ছেন আর স্ত্রীর কথা শুনছেন। মেয়ের গুণ শুনে তার চোখ চক্চক্ করে। কুলসুমা বলতে থাকেন, মাইয়া তো কাইল থেইকাই আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করছে। রসুই ঘরে যায় সেখানে হাজির। পুকুর ঘাটেও। কয় আব্বারে কওনা একখান হারমোনিয়াম আনি দিতে। স্যার আমারে গান শিখাইব। এক কথা পড়া মুখস্থের মতো বলতে থাকে তোমার মাইয়া। আমি কই- তুই যা নিশি, তোর আব্বাকে তুই ক গিয়া। তোর কথা তোর আব্বা ফেলব না। সে তবু ঘ্যান ঘ্যান করে। তোমারে তো তার মেলা ভয়। তুমি যেন ভল্লুক। স্ত্রীর কথার ঢঙে কাদের আলী হাসেন। মিটিমিটি হাসি। ভাত খাওয়া শেষে হাত ধোন। তারপর বিছানায় আধশোয়া হয়ে মেয়েকে ডাকেন। নিশি বেড়ার ওপারে ঘাপটি মেরেছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাপ-মায়ের কথা শুনছিল গোপনে। কাদের আলীর মায়া জড়ানো ডাকে বিছানার কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় সে। মুখটা মৃদু হাসি হাসি রাখতে চেষ্টা করে সে। কিরে মা তুই নাকি ভাল গাইস? আব্বারে শুনাবি একটা? কাদের আলী খোশ মেজাজে থাকলে নিশিকে মা বা আম্মাজান বলে ডাকেন। আব্বার সামনে গান গাইতে লজ্জা লাগে নিশির। গলাটা শুকিয়ে যায়। তবু একটা গান ধরে। দেশের গান। ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা...। মিনিট পাঁচেক পর গান শেষ হয়। কাদের আলী স্তব্ধ হয়ে থাকেন। কেমন গুমোট ভাব। তার মেয়ে এতো সুন্দর গান গাইতে পারে? মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বলেন, আইজই তোরে হারমোনিয়াম কিইন্যা দিমু মা! আইজই। একটু জিরিয়ে টাকা নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন শহরে। মেয়ের জন্য হারমোনিয়াম কিনবেন। শহর বেশি দূরে না। পাঁচ-ছয় কিলো। মাঝপথে যেতেই দেখা হয়েছিল গাজী বাড়ির ইউসুফ গাজীর সঙ্গে। ইউসুফ গাজী আল্লাওয়ালা লোক। সপেদ পাঞ্জাবি, সপেদ দাড়ি। সারা গায়ের লোক তাকে সম্মানের চোখে দেখে। তিনিও শহরে যাচ্ছেন। কাদের আলীকে পেতেই একসঙ্গে হাঁটেন। কাদের আলী জিজ্ঞেস করেনÑ শহরে গিয়া আনবেন কি মৌলবী সাব? বোগদাদী আতর। ছোট্ট করে জবাব দেন গাজী সাহেব। কথা কম পছন্দ তার। তারপরও বলেন, আপনি যাবেন ক্যান? মহাজন আইব নাকি? কাদের আলী বিনীত ভঙ্গিতে বলেÑ একটা হারমোনিয়াম কিনব। মেয়ের আবদারের কথা খুলে বলেন মাওলানাকে। হারমোনিয়াম? নিজের মনে প্রশ্নটা করেই সটান হয়ে রাস্তায় আঁতকে দাঁড়িয়ে পড়েন গাজী সাব। কাদের আলীও দাঁড়িয়ে পড়েন। ইউসুফ গাজীকে সাপ দেখার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অজানা আশঙ্কা মনে জাগে। গাজী সাবের কণ্ঠ ততক্ষণে গরগর করে। তুমি মুসলমানের পোলা না? হারমোনিয়াম কিনব হিন্দুগো পোলা। এই শয়তানের বাক্স তুমি কিনবা ক্যান? তোমার কি আল্লাহর ভয় নাই। ছিঃ! মেয়েলোকের কথা শুনি হারমোনিয়াম কিনতে যাচ্ছ। জাহান্নামে যাইবা মিয়া...। ইউসুফ গাজীর গলা দিয়ে আগুন বের হয়। লকলকে আগুন। সেই আগুনে মুহূর্তেই পুড়ে ছারখার হয়ে যায় কাদের আলীর ইচ্ছেগুলো। কাটা কলা গাছের মতো পড়ে থাকেন তিনি। তাকে অপরাধীর মতো দেখায়। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি যেন! হাজী সাবের ধমকা-ধমকিতে এক সময় বাড়ির পথ ধরেন কাদের আলী। শহরে আর যাওয়া হয় না। হারমোনিয়ামের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা লাগে। ছিঃ! কেমন হিন্দু আনী জিনিস তিনি কিনে আনতে যাচ্ছিলেন বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ বাড়ে। কুলসুমাই তো মেয়ের পক্ষে সুপারিশ করেছিল হারমোনিয়াম কিনে দিতে। ঘরে এসে কুলসুমার উপর রাগে অপমানে ফেটে পড়ে কাদের আলী। মুখে যা আসে তার কোনটাই আটকায় না। কুলসুমা দরজায় খিল আটকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। তবু আগুন থামে না। নিশামনিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যাক ভাগ্য প্রসন্ন। ইউসুফ গাজী না থাকলে হারমোনিয়াম কিনার মতো কত বড় পাপ কাজটি করে ফেলতেন। মনে মনে ইউসুফ হুজুরকে অজস্র সালাম জানান কাদের আলী। সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে আসেন ঘর থেকে। হাঁটতে থাকেন বড় বিলের দিকে। মনটা ভারি হয়ে আসছে তার। মনটা খারাপ-বিষণœ লাগে। বড় বিলের আইলে বসে সন্ধ্যা নামে বেপারীর। ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। রাত বাড়ে। দু-একটা ব্যাঙ ডাকে কোথাও পর পর। অন্ধকার দেখতে দেখতে বেপারী এখনও ভাবেন। তারপর আচম্বিক সিদ্ধান্ত বদলে যায়। মাটিতে আরও বার কয়েক পা ঠুকেন কাদের আলী। আবারও অমুদ্রিত শব্দ হয়। তারপর আকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজেকেই বলেন যেনÑ শহর থেকে আসতি রাত বাড়বে না। দুই. স্বামীর প্রতি অভিমান নিয়ে খাটে শুয়েছিলেন কুলসুমা। বিকেলের ঘটনাটা বার বার মনে তোলপাড় করে। চোখ ভিজে আসে আপনি আপনি। গৌধূলি বেলায় বড়ই অচেনা লেগেছিল কাদের আলীকে। আশ্চর্য চিরচেনা মানুষ ছিল স্বামীটি। তার রূঢ় আচরণ এই অন্ধকার ঘরেও চোখে ভাসে। কাদের আলীর চোখরাঙানি আঙ্গুল ছোড়াছুড়ি আর ভ্রƒ কোচকানো কুলসুমার বুক খুড়ে ডুকে পড়ে মনে। অন্তহীন শূন্যতায় তবু খোড়া চলে। আষাঢ়ের রাত হু হু বাড়ে। রাতের গন্ধ এসে নাকে লাগে। মানুষটা এখনও ঘরে ফিরেনি। কুলসুমার মন খচ্ খচ্ করে। পাশেই মেয়েটা শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। নিঃশ্বাসের শব্দ এসে তার চোখে মুখে লাগে। মেয়েটা আর কিই বা চেয়েছে। একটা হারমোনিয়ামই তো? হারমোনিয়াম কিনলে কি এমন পাপ হতো তার কূল পায় না কুলসুমা। অন্ধকার নিঃশব্দ সময় মধ্য রাতে এসে ঠেকে। স্বামীর চিন্তায় কুলসুমার ঘুম আসে না। কোথায় মানুষটা যেন কি করছে। কতক্ষণে চোখে ঘুমের ঘোর লেগে গেছে তা টের পায় না সে। তারপর হঠাৎ তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে কুলসুমা। কে যেন দরজায় করাঘাত করেই চলছে। দরজা খুলে দিয়ে সে মাথা নিচু করে থাকে অভিমানে। কাদের আলী ঘরে ঢোকেন। মুখটা একটু হাসি হাসি। কুলসুমা আলগোছে কাদের আলীর দিকে তাকান। কাদের আলীর মাথায় একটা বাক্স মতো কি যেন। চারকোনা। কুলসুমার বস্তুটা চিনতে ভুল হয় না। সে কি স্বপ্ন দেখছে! একটা হারমোনিয়াম চিনতে আলো-আঁধারাতিও তার ভুল হয় না। কুলসুমা কী বলবেন খুঁজে পান না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। ততক্ষণে কাদের আলী জিনিসটা বিছানার উপর সন্তর্পণে নামিয়ে রাখে। বউয়ের দিকে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে মেয়েকে জাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কুলসুমা পৃথিবীর মাঝ বরাবর তখনও দুলছিল যেন। তিন. নতুন বছর শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সাল। নিশির জন্ম হয়েছিল ’৫৭-এর প্রথম এপ্রিল। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বড় ছেলের টাকা হাতে পেলেন কাদের আলী। তিন হাজার দুশ’ টাকা। এই মাস ছেলের টাকাই ভরসা। ব্যবসাপাতি ভাল চলছে না। পশ্চিম পাকিস্তানীর সুপারীর চালান নিচ্ছে না। দেশে কেমন যেন এলোমেলো ভাব। কিছু একটা হবে যেন। কি হবে তার কিছুটা টের পান বেপারী। চায়ের দোকানে বসে আব্বাস স্যার আজকাল প্রায়ই কয়Ñ‘দেশে যুদ্ধ লাগবো’। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা পাইব। আশ্চর্য! বাংলা স্যারের কবিতা মাঝে মধ্যে নিশি বাপ-মাকে শোনায়। নতুন একটা দেশ নাকি হবে। সেই দেশকে নিয়ে লেখা কবিতা। পদ্যের ভাষা শৈলিতে কাদের আলীর দেহ কেঁপে ওঠে। শুধু কুলসুমা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। দেখতে দেখতে মার্চ মাস আসে। দু’একদিন না যেতেই শোনেন দেশ স্বাধীন হবে। পাকিদের অত্যাচারের দিন শেষ। শেখ মুজিব নাকি ভাষণ দেবেন ঢাকার রেসকোর্সে। চায়ের দোকানে সেদিন আব্বাস স্যারকে দেখা যায় না। তিনি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে রেসকোর্সে গেছেন। আব্বাস স্যার যখন ফিরে এলেন তখন আর গ্রামের চায়ের দোকান খোলা নেই। তারপর আরও কয়েকটা দিন কেটে যায়। নানা দিক থেকে উড়ো খবর আসে। সবাই আতঙ্কিত। মিলিটারির ভয়ে বন্ধ আছে গ্রামের দোকানপাট। প্রতিদিনই উড়া উড়া খবর আসেÑ পাকিরা পুলিশ লাইন জ্বালিয়ে দিয়েছে, অমুক নেতা শহীদ হয়েছেন, লোক মরছে মৌচাকের মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে, হাজারে হাজারে। কাদের আলী আগের চেয়ে চুপচাপ থাকেন। মাঝে মধ্যে ঘর থেকে গানের মিহি সুরের সঙ্গে হারমোনিয়ামের মাধুরী সুর ভেসে আসে। আব্বাস স্যার নিশিকে গান শিখান। নজরুলের গান। কবিতা। কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে কর করবে লোপাট...। গান শুনে কাদের আলীর হার্টবিট বেড়ে যায়। পশমগুলো কাটা দিয়ে ওঠে। হাত মুঠিবদ্ধ হয়। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে কখনও যে তিনিও গাইতে শুরু করেন তা তিনি টের পান না। আশ্চর্য! এপ্রিলের দিকে আব্বাস স্যার খাঁ বাড়িতে আর আসেন না। নিশি একা একাই গায়। সব নতুন নতুন গান। কতগুলো আগে শুনেছেন- কতগুলো শোনেন। তবে নিশির গলায় সব গানই ভাল লাগে। গ্রামের কেউ কেউ কানাকানি করে- কথা বাতাসে ভাসিয়ে দেয়Ñ ‘বাংলা স্যার মুক্তিবাহিনীতে গেছে’। ব্যাপারটা কাদের আলীর জানতে দেরি হয় না। খবরটায় তার মন খুশি খুশি হয়ে উঠে। ছোট্ট করে বলেন, জয় বাংলা। অনেকদিন পর তিনি নিশিকে ডাকেনÑ ‘আম্মাজান’ কই গেলেন। একটু বারান্দায় আসেন। পানি নিয়া আইসেন এক গ্লাস। নিশি এসে বাপের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। বসে না। অদ্ভুত দুর্দান্ত সেই ছেলেবেলা থেকেই। কাদের আলী মেয়েকে কাছে ডাকেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেনÑ -আব্বাস স্যার যুদ্ধে গেছে জানিস? -জানি! -তুই খুশি হস নাই। তোর স্যার দেশের কামে গেছে। -হইছি। -তোর কি মনে হয় না তোর আব্বা কেন মুক্তিযুদ্ধে যায় না? -হয়। তয় আপনি মুক্তিবাহিনী হইবেন। -কেমনি বুঝলি? -আপনি যুদ্ধে যান আব্বা। -হু। যামু মা। যামু। -তুই কান্দস ক্যান? কান্দনের কিছু আছে? -না আব্বা। আমি কই কান্দি। আব্বা তুমি কানতাসো। কাদের আলী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। তার কান্না থামে না। কুলসুমা পানি নিয়ে এসে দেখেন বাপ-বেটি ছেলেমানুষের মতো হু হু করে কাঁদছে। কাদের আলী যুদ্ধে গেছেন পরদিনই খবরটি বাতাসের আগে লোকমুখে ছড়ায়। কুলসুমা সেই রাতেই মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন নওগাঁয়ে বাপের বাড়ি। আজ দুই দিন হলো নিশি তার কাছে নাই। সেও যুদ্ধে গেছে। নিশির যুদ্ধটা অন্যরকম। সে গেছে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। বেতার কেন্দ্রে সে যোদ্ধাদের পক্ষে গান গায়। বাংলা স্যার গত পরশু হুট করেই এসেছিল নওগাঁও। তিনিই বলেছিলেন স্বাধীন দেশের জন্য গাইবি তুই মা। পারবি না? নিশি মাথা নেড়ে বলেছিল পারব স্যার। সেই ‘পারব স্যার’ বলার ভেতর এতো দৃঢ় অভিব্যক্তি ছিল তা টলাতে পারেননি কুলসুম। নিজের কিশোরী মেয়ের কাছে পরাজিত হতে হয় শেষ পর্যন্ত। যাবার বেলায় হারমোনিয়ামটি ছিল বাংলা স্যারের মাথায়। একটা পুটলি হাতে দাঁড়িয়ে বিদায় চাইছিল নিশি। যাই মা। এতটুকুই বলেছিল। সে একবারও কাঁদেনি। তার মুখ ছিল উজ্জ্বল। যেন এই তো এখনই সূর্য উঠবে। সেদিন মেয়েকে নিজের চোখে বেশ বড় ঠেকেছিল কুলসুমার। গত দু’দিনে নিশির জন্য মন কতবার গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছে। কত আশঙ্কা মনে জাগে কুলসুমার। মেয়ে যদি আর না ফেরে? আর কাদের আলী? আর ভাবতে পারে না। মনটা চুরমার হয়ে যায়। খবর আসে। তার স্বামীর ভিটায় আগুন দিয়েছে ইউসুফ গাজীরা। তারা নতুন একটা দল খুলছেÑ ‘শান্তি বাহিনী’। রাতে মেয়ে-স্বামীর চিন্তায় ঘুম আসে না কুলসুমার। ঘরে অসুস্থ বাব মনু শেখ। ক’মাস ধরেই বিছানায় শোয়া। তিনি ক্ষীণকণ্ঠে ডাকেন। মেয়েকে সান্ত¡না দেন। কিন্তু মেয়ের মন মানতে চায় না যেন। তারপরও দিন কেটে যায়। চার. আজ মনটা খুশি খুশি লাগে কুলসুমার। সরদার বাড়ির লোকমান সরদার গোপনে কোথায় থেকে যেন একখান রেডিও জুটিয়েছে। দুই দুই করে চার ব্যাটারির। মুক্তিযুদ্ধের খবরা খবর শোনায় সে রেডিও। মাঝে মাঝে দেশের গান হয়। সকালে রেডিওতে গাওয়া গায়িকার গান শুনে কুলসুমার বুকটা ভরে যায়। আহা! কি গলা। কি গান! কারার ঐ লৌহ কপাট...। নিশি! মা আমার! খুশিতে তার কণ্ঠে চিৎকার বেরোয়। আশপাশের লোকজন অবাক হয়। ভাবে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল কিনা? নিশি গান গাইছে কালুরঘাটে। ব্যাপারটা লোকজনকে বুঝাতে ব্যাপক সময় লাগে কুলসুমার। ডিসেম্বর মাস চলে আসে। মনে কিছুটা বল পান কুলসুমা। পাকবাহিনী নাকি মরে সাফ। কাদের আলী যুদ্ধে গেছেন সাত-আট মাস হয়ে গেছে। তিনি কেমন আছে তার কোন খবর জানেন না কুলসুমা। আশায় থাকেন কাদের আলী ফিরবেন। স্বভাবসুলভভাবে বলবেন চুন ছাড়া এক খিলি পান দিও বউ। সুপারীটা বাড়ায়ে দিও। জর্দা দিমু একটু? দাও। কাদের আলীর পথ তবু যেন ফুরায় না। আগে যাও মাঝে মাঝে চিঠি আসত। গত ক’মাস তাও আসে না। তার কপালে যে এমন লিখা থাকবে তা কি ধারণা করতে পেরেছিল কুলসুমা? অবশেষে দেশে নতুন পতাকা উড়ে। দেশ বদল হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নামও বদলে যায়। হয় ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীনতা আসে। কুলসুমা শোনে ত্রিশ লাখ নাকি শহীদ হইছে। সে দলে কি কাদের আলী-নিশির নাম নেই? থাকলে কি হবে? আর ঐ যে কবিতা লিখতো আব্বাস স্যার-তার কি হলো? কোথাও ভাবনা জগতে ঠাঁই পায় না কুলসুমা। যোদ্ধারা ঘরে ফিরতে শুরু করে। মিজি বাড়ির হাসেম মিজি ফিরেছে সকালে। সে কোন খোঁজ জানে না কাদের আলীদের। সন্ধ্যা হয়ে আসে। কুলসুমা অজু করে। তখনই পুকুরের ঐ পার দিয়ে এক মহিলাকে মাথায় পুটলি নিয়ে আসতে দেখা যায়। পুটলি কোন কারণে চারকোনা হয়ে আছে। কাছে আসতেই মহিলাকে চিনতে পারে কুলসুমা। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো পরিচিত উল্লাস বের হয় না। মাথা থেকে পুটলি নামিয়ে রেখে মহিলাই প্রথম কথা বলেÑআব্বাস স্যার নাই মা। পাঁচদিন আগেই মারা গেছেন। মেয়েকে তকক্ষণে জড়িয়ে ধরেন কুলসুমা। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। চারদিকে ভিড় জমতে থাকে। সেদিকে খেয়াল নেই নিশির। সে তার আব্বার কথা ভাবে। কাদের আলী কোথায় আছেন জানে নিশি। পরে এক সময় বলা যাবে মাকে। ভিড় ঠেলে কুলসুমাকে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সে। ভিড় পিছু লেগেই থাকে। মাথায় করে আনা বস্তুটার কথা মনে থাকে না ওদের। সাধন চোর অগোচরে কখন যে পুটলিটা নিয়ে চম্পট দেয় তা কেউ টের পায় না। গিট খুলে সাধন হতাশ হয়। একটা হারমোনিয়াম। এটা দিয়ে কি করবে সে? সে ভেবেছিল স্বর্ণ-টর্ণ হবে। ব্যথতায় হারমোনিয়ামটা ছুড়ে দেয় পার্শ্ববর্তী খালে। অল্প পানি। কাদার ভেতর হারমোনিয়ামটা গেঁথে থাকে। রাস্তা থেকে দেখা যায়। সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই সাধনের। অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে যায় সে। দিন পনের পরে একটা লোক সে পথে আসে। লোকটার বাম হাতের কনি পর্যন্ত কাটা। ধীরে ধীরে সামনের বাড়িটার দিকে দৃষ্টি রেখে এগোয় লোকটা। মুখে যন্ত্রণার ছাপ গোপন হায় না। দরদর ঘামে। খালের ভেতর হারমোনিয়ামটা অর্ধ ডুবন্ত দেখে থমকে দাঁড়ায়। এই যন্ত্রটা চিনে সে। জিনিসটার জন্য মায়া লাগে তার। খাল থেকে তুলে আনার অবস্থা তার নেই। মনের ভেতর ছোট্ট একটা মুখ ভেসে উঠে। বেনী করা চুল, কোমল মুখ। ছবিটি তার মেয়ের। সঙ্গে আরেকটি মুখ দেখা যায়, একটু বয়স্ক। চিন্তা আর প্রতীক্ষার ছাপ চেহারায়। লোকটা আর দাঁড়ায় না। আগের চেয়ে জোর গতিতে তিনি পথ এগুন। মনে পড়ে এমন একটা হারমোনিয়াম মাঝ রাতে কিনেছিলেন তিনি।
×