ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দর যত বিষাক্ত ফুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

সুন্দর যত বিষাক্ত ফুল

মঙ্কসহুড ২০১৪ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান যুক্তরাজ্যের এক মালি। তার মৃত্যুর রহস্য এখনও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে, একটি বিষাক্ত ফুলের সংস্পর্শে আসার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছিল। ওটি ছিল এ্যাকোনিটাম জাতের গুল্ম, যা মঙ্কসহুড বা সন্ন্যাসীর আচ্ছাদন নামেই বেশি পরিচিত। এর আরও বেশকিছু বাহারি নাম রয়েছে যেমনÑ উলফস বেইন, লেপার্ডস বেইন, মাউস বেইন, ওমেন্স বেইন, ডেভিলস হেলমেট, ব্লু রকেট ও কুইন অব পয়জন। বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত উদ্ভিদ হচ্ছে এই এ্যাকোনিটাম। এর মোট আড়াই শ’ প্রজাতি রয়েছে। এ গাছের শিকড় থেকে ফুল সবই বিষাক্ত। তবে শিকড়েই রয়েছে বেশি বিষ। এর সান্নিধ্যে গেলেই প্রাণীরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এর বিষ ছড়ায় ত্বকের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। আর কোনভাবে এটি পেটে গেলে আর রক্ষা নেই। শুরু হবে বমি ও পাতলা পায়খানা। এ ফুলগাছটি এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা নীল রঙের ফুলগুলো দেখতে অনেকটা হেলমেটের মতো। এজন্যই এর নাম শয়তানের হেলমেট। পাহাড়ী অঞ্চলে এ গাছগুলো বেশি দেখা যায়। ওয়াটার হেমলক ২০১০ সালে লন্ডনে প্রেমিকাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন লাখভির কাউর সিং। তিনি তার সাবেক প্রেমিকা লাখভিন্দর চিমাকে কোন বন্দুক বা ছুরি দিয়ে খুন করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিষাক্ত ওয়াটার হেমলক। তিনি খাবারের সঙ্গে গাছের শিকড় রান্না করে চিমাকে খাইয়েছিলেন। এরপর থেকে তার নাম হয় ‘কারি কিলার’। বিষাক্ত হেমলকের আরেক নাম ইন্ডিয়ান একোনাইট। হেমলক ফুল দেখতে অনেকটা সাদা বা সবুজ ছাতার মতো। ভারতে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে ও পশ্চিমবঙ্গে এর দেখা মেলে। তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতেই বেশি দেখা যায়। এই গাছ এক মিটার লম্বা ও আধা মিটার চওড়া হয়ে থাকে। সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। এর বিষ পেটে যাওয়ার ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো পেটব্যথা ও বমি। সঙ্গে প্রচণ্ড কাঁপুনি। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে মরণ ডেকে আনবে এই সুন্দর ওয়াটার হেমলক ফুলটি। তবে সবচেয়ে বিষাক্ত অংশ হচ্ছে এ ফুলগাছটির শিকড়। ফুলটিতে সিকোটক্সিন নামে এক ধরনের বিষ থাকে, যা মারাত্মক হৃদরোগের কারণ হতে পারে। বেলাডোনা বেলাডোনার আরেক নাম ভয়াবহ রাতের ছায়া। যদিও পুরনো নাম এ্যাট্রোপা (অঃৎড়ঢ়ধ)। গ্রীক দেবী এ্যাট্রোপাসের নামানুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। পরে এর নাম হয় বেলাডোনা, যার অর্থ ‘সুন্দরী নারী’। মধ্যযুগে নারীদের চোখের মণি বড় ও আকর্ষণীয় করতে এই ফুলের রস আইড্রপ হিসেবে ব্যবহার হতো। সেজন্য এর নাম সুন্দরী নারী। এই গাছ দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ঘণ্টার আকৃতির ফুলগুলো বেগুনী, লাল, সাদা, গোলাপী রঙের হয়ে থাকে। সোলানাসিয়া (ঝড়ষধহধপবধব) গোত্রের এ উদ্ভিদটি ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া এবং কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়। ফুলটিতে থাকা ট্রপেন এ্যালকলাইডিস নামে বিষের কারণে মাথাব্যথা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি ইত্যাদি সমস্যা হয়। রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় কেউ কেউ না বুঝে এ ফুলটি প্রসাধনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করতেন। বিষাক্ত হলেও সেই প্রাচীণকাল থেকেই ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রীতে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধ্যযুগে শল্যচিকিৎসকরা রোগীদের অজ্ঞান করার সময় এ্যানেসথেটিক হিসেবে এটি ব্যবহার করতেন। প্রাচীন রোমে বিষ হিসেবে এ ফুল ব্যবহার করা হতো। রটনা রয়েছে- রোমান সম্রাট অগাস্টাস ও তার স্ত্রী ক্লডিয়াসকে এই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। অটাম ক্রোকাস অটাম ক্রোকাসের আরেক নাম ন্যাকেড লেডি বা নগ্ন নারী। সাধারণত শরতকালেই এ ফুল ফোটে। গাছের পাতাগুলো মরে যাওয়ার বহুদিন পর সেখান থেকে এই ফুল ফোটে বলে এর নাম ‘ন্যাকেড ওমেন’ বা ‘নগ্ন নারী’। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ ফুল দেখা যায়। রূপসী এই ফুলের বিষে প্রথমে শুরু হয় কাঁপুনি। তারপর রক্তচাপ কমতে শুরু করে। অবশেষে হৃদস্পন্দন থেমে মৃত্যু। এ কারণেই চোখ ধাঁধানো বর্ণিল এ ফুলটি পরিচিত ‘রূপসী মৃত্যুফুল’ নামে। এ ফুলটির কিছু উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি হলেও ফুলটি খেলে তা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তি ও অটাম ক্রোকাসের বিষ পেটে যাওয়া ব্যক্তির লক্ষণগুলো একই। রডোডেনড্রন রডোডেনড্রন গাছের ১০২৪টি জাত রয়েছে। এটি এশিয়ার গাছ। তবে উত্তর আমেরিকার এ্যাপালাচিয়ান পার্বত্যাঞ্চলেও এর দেখা মিলবে। এটি নেপালের জাতীয় ফুল। শীতের শেষদিকে এ ফুল ফুটতে শুরু করে। গ্রীষ্মের শুরুতেও গাছ ভরে থাকে বর্ণিল ফুলে। আকর্ষণীয় এই ফুলগাছের পাতা কল্পনাতীত বিষাক্ত। এই গাছের পাতা মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ পুড়ে যাবে, লালা ঝরতে আরম্ভ করবে। সঙ্গে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এবং চূড়ান্ত বিপর্যয় হিসেবে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়তে থাকবে। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে না পারলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে। অলিয়েন্ডার বা করবী আমাদের অতিপরিচিত করবী ফুলটিও কিন্তু কম বিষাক্ত নয়। এর ইংরেজী নাম অলিয়েন্ডার। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফুলগাছ দেখা যায়। এর আদি নিবাস মরক্কোর প্রাচীন শহর ভলুবিলিসে। বিশ্বে নানা রং ও নানা আকারের অলিয়েন্ডার রয়েছে। করবী ফুলের পুরো গাছটাই মারাত্মক বিষাক্ত। এর মাত্র একটি পাতা খেলেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। দক্ষিণ ভারতের প্রচুর মানুষের আত্মহত্যার সঙ্গে এ ফুলটির নাম জড়িয়ে আছে। ড্যাফোডিল ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মজেছিলেন বসন্তের ফুল ড্যাফোডিলে। হলুদ রঙের টিউলিপ জাতের ফুলটি তার এতই পছন্দ হয়েছিল যে, আস্ত একখানা কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন। এর আরেক নাম নার্সিসাস। সুন্দর এ ফুলটির গোটা গাছটিই বিষে পূর্ণ। এটি পেটে গেলে প্রথমে ঝিমানি ভাব দেখা দেবে। সঙ্গে প্রচণ্ড পেটব্যাথা, বমি ও পাতলা পায়খানা। বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা গেলেও উত্তর আমেরিকায় এটি বেশি দেখা যায়। ছয় পাপড়ির এ ফুলটি সাধারণত হলুদ ও সাদা রঙের হয়ে থাকে। তবে কমলা বা গোলাপী ড্যাফোডিলও দেখা যায়। এই ফুল দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনে। এর সিবলি অংশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘ক্যামেলিয়া হাউস’। বিচ এ্যাপল অত্যন্ত নিরীহদর্শন একটি গাছ; আর তার কপালেই জুটল কি-না গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের দেয়া ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক গাছ’-এর তকমা! এর আরেক নাম ম্যাঞ্চিনেল। মেক্সিকো উপসাগরের কাছে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এই বিষাক্ত গাছের দেখা মিলবে। এই গাছের শাখা-প্রশাখা, ফুল, পাতা এমনকি ফলে এক ধরনের বিষাক্ত রস নিঃসৃত হয়, যা কিনা ত্বকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোসকার সৃষ্টি করে। চোখে লাগলে যে কেউ অন্ধও হয়ে যেতে পারে। এমনকি বৃষ্টির দিনে এই গাছের নিচে আশ্রয় নেয়াও বারণ, কারণ বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এই রস শরীরে লেগে যেতে পারে। গোলাপী আর বেগুনী রঙের থোকা থোকা এই ফুলগুলো কিন্তু দেখতে দারুণ। আপনার মন কাড়তে এর জুড়ি নেই। বিচ এ্যাপল বা ‘ডেথ এ্যাপল’ ফলটি খেতে খানিকটা মিষ্টি এবং এর সুঘ্রাণ ক্ষুধা উদ্রেক করে। তবে একটি ছোট্ট কামড় আপনার মুখগহ্বর থেকে শুরু করে পাকস্থলী পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিতে যথেষ্ট। এই গাছ এতই বিপজ্জনক যে, একে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না। কারণ গাছের কাঠ পুড়ে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় সেটাও অন্ধ করে দিতে পারে। এই গাছের একমাত্র ব্যবহার হলো আসবাবপত্র তৈরিতে। এছাড়া ইতিহাস বলে, শিকারিরা এক সময় এই গাছের রস বিষ হিসেবে তীরের ফলায় ব্যবহার করত। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বর্ণিল শোভা উপভোগ করতে গিয়ে অনেক পর্যটকই না জেনে এই উদ্ভিদের বিষে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সাবান পানি দিয়ে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে ফেলতে হবে। আর পুড়ে গেলে বেশি করে পানি ঢেলে দিতে হয়। ক্ষতস্থান ফুলে গেলে এ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ প্রযোজ্য। ক্যাস্টর অয়েল আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য হাউস অব লার্কিং ডেথ’ বইটির কথা মনে আছে তো! এই রহস্য উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছিল এক বাক্স বিষাক্ত চকলেটকে কেন্দ্র করে। যে বিষ দিয়ে বানানো হয়েছিল চকোলেটগুলো তা ছিল ক্যাস্টর অয়েল। বাংলাদেশে এটি ভেন্নার তেল নামে পরিচিত। এটি সেবনে ধীরে ধীরে আপনি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বেন। রূপচর্চাসহ নানা কাজে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহারের চল রয়েছে। কিন্তু এটি একটি বিষাক্ত গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম রাইসিন। এক টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েলের বিজ গুঁড়া করে খেলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এই বিষ পেটে গেলে বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হবে। তবে চিকিৎসার জন্য আপনি যথেষ্ট সময় পাবেন-কমপক্ষে এক সপ্তাহ। অনেকটা মটর দানার মতো দেখতে বীজগুলো খয়েরি ও টকটকে লাল। লাল রঙের সুদৃশ্য দানা দিয়ে ব্রেসলেট বা মালা তৈরি করা হয়। ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ির তেল বাংলাদেশ ও ভারতে সৌন্দর্য চর্চায় বিশেষ করে কেশ পরিচর্যায় ব্যবহৃত হতো। এমনকি ২০১১ সালেও এটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন দোকানে এই তেল পাওয়া যেত। ১৯৭৮ সালে বুলগেরিয়ার ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী জর্জি মারকভকে এই ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
×