ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মেধা নম্রতা

পারিবারিক আশ্রয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

পারিবারিক আশ্রয়

মনোবিজ্ঞানীদের মতে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশু অনেক কিছু অনুভব করতে পারে। মায়ের শরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণেই মাকে মাধ্যম করে শিশু বুঝে নেয় এসব। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই খুব সংবেদনশীল। ভূমিষ্ঠ শিশু আরও বেশি সংবেদনশীল অনুভূতির অধিকারী হয়ে থাকে। প্রতিটি শব্দ, স্পর্শ, দৃশ্য নবজাতক শিশুরা তীব্রভাবে গেঁথে নেয় তাদের মনোজগতের সঙ্গে। যে কারণে খুব আশ্চর্য শুনতে লাগলেও একজন নবজাতক তীক্ষè ঘ্রাণশক্তির মাধ্যমে যেভাবে তার মাকে চিনে নেয় তেমনি সে আশপাশের সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে। যত বেশি বেড়ে উঠতে থাকে শিশুরা তত বেশি বিশ্লেষণধর্মী হয়ে উঠে। প্রতিটি শিশুর কাছে তাই তার বেড়ে উঠার সময়কালটি অত্যন্ত ‘প্রাইম ক্লু’ হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তির জীবনে পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির চারপাশে ঘটমান প্রতিটি বিষয়ের ঘটনা অণু-পরমাণু হয়ে ব্যক্তির জীবনে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য ভূমিকা রাখে। একটি নিষ্পাপ শিশু জন্মের পরে ভাল পরিবেশ পেলে ভাল হয়ে উঠে। কিন্তু যখন কোন শিশু তার বেড়ে উঠা যাপিত পরিবেশে ঝগড়া, দ্বন্দ্ব সংঘাত, সন্দেহ, হিংসা ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা দেখে তখন তার মনোজগতে গেঁড়ে বসে বিভিন্ন খারাপ প্রভাব। হয় সে নিজেও এ রকম একজন হয়ে উঠে, নতুবা তার মনের গহীনে আপনজনদের বিরুদ্ধে জমে উঠে ঘুণা। অনেক সময় পরিত্রাণের উপায়ে শিশুটি খুঁজে নেয় কল্পনার জগত। যা তাকে অনেক সময় অবাস্তববাদীতে পরিণত করে। আবার অনেক সময় শিশুটি খারাপ পথে চলতে শুরু করে। এসব ক্ষেত্রে পরিণতি হয় অপরাধ জগতের। অনিশ্চয়তা ঘিরে থাকে এই সব শিশুদের সারাক্ষণ। আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাদের মন হয় বিক্ষুব্ধ, ভয়গ্রস্ত। বিশ্বাস করার মতো কাউকে তারা খুঁজে পায় না। নিজেদের যে কোন ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা হতাশা হোক না কেন কোন কথা বলার জন্য আপনজনদের কাছেও পায় না। বাবা-মা নিজেদের স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতা নিয়ে এতবেশি ব্যস্ত থাকে যে, শিশুর দিকে খেয়াল দিতে পারে না। অথচ স্বামী-স্ত্রী বা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ নারী বিয়ের পরে প্রথমেই চিন্তা করে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে। অর্থাৎ সন্তানের জন্য স্নেহ মায়া মমতার নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করতে পারলেই তবে তারা সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন বলে বিষেশজ্ঞরা ধারণা রাখেন। বাস্তবে তারা সন্তান জন্ম দেয় ঠিকই কিন্তু সন্তানের জন্য তারা তাদের নিজেদের অবস্থা ছাড়তে রাজি নয়। ফলে মা-বাবার ভেতর ভালবাসাহীন সম্পর্কে শিশুরা তাদের জন্মগ্রহণকেই অভিশাপ হিসেবে মনে করে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। জন্মদাতা মা-বাবার কাছে অনাদর, অমনোযোগ, তাচ্ছিল্য যে কোন সময় বাবা বা মা তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে এই ভয়ার্ত ভাবনায় শিশুর ব্যক্তি মনোজগতে এক গভীর জটিলতা তৈরি করে। আমাদের শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। কিন্তু শিশুরে যদি পরিবারের ভেতরে নিজের মা-বাবার কাছেই বিশ্বাস, নিরাপত্তা, আশ্রয় না পায় তবে এ রকম অসহায় ত্রাসগ্রস্ত নিরাপত্তাহীন শিশুরা আগামীর ভবিষ্যত হিসেবে সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য কি সুফল বা কল্যাণ বয়ে আনবে? বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শিশু অপরাধীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে, সচ্ছল ধনী এবং গরিব পরিবারের শিশুদের অপরাধের ধরন, উদ্দেশ্য কিন্তু অনেক সময় সাদৃশ্যপূর্ণ আবার কিছু ক্ষেত্রে আলাদা রকমের। অতিরিক্ত সচ্ছলতায় ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা একেবারেই ভোগবাদী হয়ে উঠেছে। তারা ইচ্ছামতো টাকা খরচ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত বিশ্বের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আরাম আয়েস ভোগ করছে। এসব ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা কিন্তু জানে তাদের অভিভাবক বাবা-মা এই যে প্রাচুর্য অর্জন করেছে তা সম্পূর্ণ নৈতিকতাপূর্ণ নয়। অর্থাৎ তাদের চোখে বাবা-মা সম্পর্কে নৈতিক যে শ্রদ্ধার জায়গাটি অন্তরে লালন করা দরকার তাদের অন্তরে তা থাকছে না। বরং তারা আদর্শহীন নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া বাবা-মার পরিশ্রমকে ‘ওয়েল ডান বাডি’ হিসেবে প্রশংসা করছে। তারা জানে যে ভোগ-বিলাসের এই অর্থ উপার্জন করতে যতই অন্যায় করুক না কেন এই সম্পদ তাদের। ফলে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় গড়ে উঠছে দারিদ্র্য একশ্রেণী ভোগবাদী সন্তান। তারা দারিদ্র্যের সংজ্ঞা না বুঝে বলে উঠে, ‘গরিবরা ভাত খেতে না পাক তারা তো পোলাউ খেতে পারে।’ মদ, নারী, নেশা, অধিক বিবাহ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সাদা ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা, রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা, নিজেকে ক্ষমতাশালী করতে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে আঁতাত বা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলাতে এই ধনীক শ্রেণী অত্যন্ত লজ্জাহীন এবং অম্নান মানসিকতার। ফলে এরাই যখন গণমাধ্যমে বড় বড় আদর্শের কথা বলে তখন সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত অসচ্ছল গরিব শিশুদের ভেতর বিরূপপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নেয়। আবার কখনও বা এদের সমপর্যায়ে ঊঠার জন্য নানাবিধ দুষ্কর্ম করতে উৎসাহী হয়। ফলে অপরাধ বাড়ে বৈ কমে না। ধন বৈষম্যের শিকার শিশুদের যথেচ্ছ ভোগের ইচ্ছা সুপ্ত থাকে। তারা ব্যক্তি জীবনে শিশুকালেই বুঝে যায় অর্থ হচ্ছে ধনী-গরিব বিভাজনের মাপকাঠি। আর অর্থ উপার্জনে নৈতিকতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা। অথচ শিশুদের জন্য প্রয়োজন ভালবাসা। কেবল দামী খেলনা বা দামী রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে ভালবাসা প্রকাশ করা নয়। তাদের মনোজগতে বাবা-মার বুনে দিতে হবে নিরাপত্তার নৈতিক বৃক্ষ। যে বাবা-মা মাতাল হয়, যথেচ্ছ জীবনযাপন করে তাদের শিশুরা তো এই শিক্ষাই গ্রহণ করবে। অন্যায়কারী অসৎ বাবা-মার সন্তান চেষ্টা করলেও ন্যায়বান সৎ হতে পারে না পরিবেশের কারণে। ধনী বা গরিব অথবা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত যে কোন বাব-মা তাদের শিশুদের জন্য সততা, নিরাপত্তা এবং অপার ভালবাসার আশ্রয় হয়ে উঠলে সেই সমাজ তথা রাষ্ট্র একটি সুখী ভবিষ্যত প্রজন্ম পেতে পারে। বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে শিশু মনস্তত্ত্ব জটিল হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ধনী, মধ্যবিত্ত এবং গরিব পরিবারের শিশু কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার পাশাপাশি আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। তাই বাবা-মা এবং পরিবারের সকলের নিজেদের শিশু সন্তানের মনোজগতের প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত বিষয় তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, মান-অভিমান, রাগ-ব্যর্থতা সফলতা ভাললাগা না লাগার সঙ্গে নিজেদের আচার-আচরণ, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রয়োজন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও ব্যাপক হারে সচেতন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে কয়েকটি শিশুকিশোর অপরাধ এই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করছে সামাজিক বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা এবং মনস্তাত্ত্বিকরা। শিশুর পাশ থেকে যদি তাদের জন্মদাতা ধাত্রী সরে যায় বা একেবারেই নীতি বিবর্জিত জীবনযাপন করে তবে সন্তানের জন্য আশ্রয়ের কোন জায়গা থাকে না। তারা উন্মুল জীবনে নিজেদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে কেবল ভেসে যায়। আর ভেসে যাওয়া জীবনে সবাই যে বেঁচে থাকার তীর খুঁজে তা নয়। অনেকেই বাবা-মার খুনী ঐশী বা সিলেটের ইভটিজার রাহুলের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
×