স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত বছরের পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের বরণ অনুষ্ঠানে টিএসসিতে নারী নিপীড়নের বহুল আলোচিত ঘটনায় কামাল নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় প্রথমবারের মতো কোন আসামি গ্রেফতার হলো। তাকে ২ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। গ্রেফতারকৃত কামাল নারীদের যৌন নিপীড়নের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি নারী লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন ডিবির কর্মকর্তাদের কাছে। নারী নিপীড়নের ঘটনায় শনাক্ত হওয়া অপর ৭ জনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
বুধবার রাত তিনটায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর চকবাজার থানাধীন খাজির দেওয়ান এলাকার ৭৭ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের একটি দল। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় কামালকে (৩৫)। তাকে রাতেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, ডিবির উপ-পরিদর্শক দীপক কুমার দাশ যৌন নির্যাতনের ওই ঘটনায় বৃহস্পতিবার কামালকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদ ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ডিবির দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জনকণ্ঠকে জানান, কামাল গত বছর পহেলা বৈশাখের বাংলা নববর্ষের বরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কয়েক নারীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অন্যতম আসামি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কামাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছে। যদিও কামালের দাবি সে নারীকে যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত নন। নিপীড়নকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া অপর আসামিদের কামাল চেনে না বলেও দাবি করেছে।
ডিবি পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কামাল খাজির দেওয়ান এলাকায় সপরিবারে বসবাস করে। সে মূলত কাঁচামাল ব্যবসায়ী। পড়াশোনা তেমন করেনি। গ্রেফতারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নারী নিপীড়নের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে সে বিষয়টি অস্বীকার করে। পরে তাকে ঘটনাস্থলের ভিডিও চিত্র ও স্থিরচিত্র দেখানো হয়। এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করে। তবে নারী নিপীড়নের সঙ্গে সে জড়িত নয় বলে দাবি করেছে। নিপীড়নকারী অন্য সাত জনের ছবিও দেখানো হয়েছে তাকে। ছবি দেখে তাদের চিনে না বলে দাবি করেছে কামাল। এমনকি শনাক্ত হওয়া অপর সাত জনের সঙ্গে তার কোন সর্ম্পক নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।
কামালের দাবি, ঘটনার দিন সে একাই কৌতূহল বাসা থেকে বেরিয়ে টিএসসিতে যায়। সেখানেই কাকতালীয়ভাবে ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাস্থলে সেদিন কি হয়েছিল, সে সম্পর্কে কামাল মুখ খোলেনি। ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এ সংক্রান্ত মামলা হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে ৮ জনকে শনাক্ত হয়। শনাক্ত হওয়াদের ছবিও প্রকাশ হয়। সন্দেহভাজনদের ধরিয়ে দিতে পুলিশের তরফ থেকে লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। সেখানে কামালের ছবিও ছিল। কামাল বলেছে, ছবি প্রকাশের পর সে দাড়ি কেটে বেশভূষা পাল্টে আত্মগোপনে চলে যায়।
ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কামাল আত্মগোপনে গেলেও মামলার খোঁজখবর রাখত। নারী নির্যাতন মামলায় ২ মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। পুলিশের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে জানানো হয়। আসামিরা ভবিষ্যতে গ্রেফতার হলে সম্পূরক চার্জশীট দাখিলের অনুমতি দেয় আদালত। দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় আসামি কামাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভেবে আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আশা শুরু করে। তবে সে আর আগের মতো দাড়ি রাখেনি। বেশভূষাতেও নিয়মিত পরিবর্তন আনত। কামাল নতুন রূপ ধারণ করে। কামাল ব্যবসায়ও পরিবর্তন আনে। কাঁচামালের ব্যবসার পরিবর্তে এলাকায় টং দোকান খুলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচা-বিক্রি শুরু করে।
গত বছরের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের বরণ অনুষ্ঠানে নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। এ সংক্রান্ত মামলাটি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তকালে ভিডিও ফুটেজ দেখে নিপীড়নকারী হিসেবে ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়। কিন্ত কোন আসামি গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ওই ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পুলিশের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচীও পালিত হয়। এসব কর্মসূচী পালনের সময় পুলিশের সঙ্গে কর্মসূচী পালনকারীদের দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনাও ঘটে।
শেষ পর্যন্ত আসামি গ্রেফতার ছাড়াই গত বছরের ২২ ডিসেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েক নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। ভিড়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ একদল নারী লাঞ্ছনাকারী ঘটনাস্থলে কয়েক নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। নারী লাঞ্ছনাকারীরা ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন নারীর শাড়ি ধরে টান দেয়। তদন্তকালে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চিহ্নিত আটজনের নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। তবে ভবিষ্যতে কোন তথ্য উদ্ঘাটিত হলে মামলাটি পুনর্জীবিত করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় এক আসামি গ্রেফতার হওয়ায় মামলাটি নতুন করে তদন্ত শুরু হলো।