ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাজারে চালু ১৩শ’ আইটেমের ২৫ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ

মাত্র দু’শ’ ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রশাসন

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

মাত্র দু’শ’ ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রশাসন

নিখিল মানখিন ॥ মাত্র দুই শতাধিক অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার রয়েছে ওষুধ প্রশাসনের। বর্তমানে দেশে প্রায় এক হাজার ৩শ’ আইটেমের ২৫ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ রয়েছে। এ সুযোগে এ দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অজুহাতে অব্যাহতভাবে ওষুধের দাম নির্ধারণ ও ইচ্ছামতো বৃদ্ধি করে চলেছে। উৎপাদিত বেশিরভাগ ওষুধই রয়ে যাচ্ছে তদারকির বাইরে। নামে-বেনামে দেশে প্রবেশ করছে অনুমোদনহীন অনেক বিদেশী ওষুধ। দরকষাকষি করেই সেগুলোর দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। এতে ঝুঁকির মধ্যে রয়ে যাচ্ছে জনস্বাস্থ্য। আর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশের চিত্র উল্টো। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানুষের অত্যাবশ্যক ওষুধগুলোর একটি তালিকা তৈরি ও তা কার্যকর করাতে বেশ আন্তরিক থাকে। মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক চাপ ও কোম্পানিগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ওষুধগুলোকেই অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় রাখা হচ্ছে, যার অধিকাংশই শুধুমাত্র তালিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। অথচ গবেষণার মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের জন্য অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা থাকা খুবই জরুরী। একই সঙ্গে ওই তালিকায় ওষুধের পরিমাণও বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য কোন কারণে যাতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় কোন ওষুধের নাম অন্তর্ভুক্ত না হয় সেদিকেও গুরুত্বারোপ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সূত্র জানায়, এ দেশে ১৯৮২ সালে প্রথমে জাতীয় ওষুধনীতি ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি হয়। তখন অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হিসেবে নির্ধারণ করা হয় ১৫০ আইটেমের ওষুধকে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে মাত্র ১১৭ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়। পাশাপাশি সরকার ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি সংশোধন করে জাতীয় ওষুধনীতি-২০০৫ প্রণয়ন করে। কিন্তু ওই নীতিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের কোন তালিকা রাখা হয়নি। তাছাড়া ২০০৮ সালে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হিসেবে ২৫৬ ওষুধকে নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানামুখী চাপ এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ওই তালিকায় ওষুধ রাখা হয় মাত্র ২০৯, যার অধিকাংশই এখন অকার্যকর। যদিও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এখনও আগের নির্ধারিত ১১৭ আইটেমের ওষুধকেই তদারকি করছে, যার বেশিরভাগই অকার্যকর। তাছাড়া অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রাখা ওষুধগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে তালিকা করা হয়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবেই ওই তালিকায় অনেক ওষুধের নাম চলে এসেছে। সূত্র আরও জানায়, ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচিবের সভাপতিত্বে ১৬ সদস্যের একটি মূল্য নির্ধারণ কমিটি রয়েছে। তাতে ওষুধ শিল্প সমিতি ও কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আছেন। তবে আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে অত্যাবশ্যকীয় তালিকার ওষুধের বাইরে অন্য ওষুধের দাম নির্ধারণে ওই কমিটির কোন এখতিয়ার নেই। বরং বাকি ওষুধগুলোর দামের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত দামই কমিটি অনুমোদন করে থাকে। এর বাইরে ওই কমিটির আর কোন ক্ষমতা নেই। ফলে দাম প্রস্তাবের স্বাধীনতার সুযোগে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম নানা অজুহাতে বাড়িয়ে চলেছে। ১৯৯৪ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষ থেকে এখনও ১১৭ ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যদিও বর্তমান অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় ওষুধ রয়েছে ২০৯। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ব্যক্তিস্বার্থে ২০০৮ সালে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ৯২ ওষুধকে যুক্ত করা হয়েছে। এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধের মান ও দাম নির্ধারণে একটি যুগোপযোগী ওষুধনীতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে অনেকদিন ধরেই তা মন্ত্রণালয়ে পড়ে রয়েছে। ওই নীতি অনুমোদিত হলে ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ করা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষে সহজ হবে। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোকেই অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু এ দেশে বেশি বিক্রীত ওষুধকেই ওই তালিকায় রাখা হয়েছে। তবে নতুন ওষুধনীতিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে ওষুধ শিল্প মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প এখন খুবই ভাল অবস্থানে রয়েছে। কাজেই অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকার দিকে নয়, বরং উৎপাদিত ওষুধের গুণগতমানের দিকেই কোম্পানিগুলোর বেশি নজর দেয়া উচিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে জানান, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে নীতিমালা বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা তৈরির ক্ষমতা অধিদফতরের নেই। এ তালিকা বাড়ানোর ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের। অধিদফতর শুধুমাত্র সরকারী নীতিমালা বাস্তবায়ন করে থাকে। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে ২৭৫ এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করে। এছাড়া দেশের ২৬৬ ইউনানী, ২০৫ আয়ূুর্বেদিক, ৭৯ হোমিওপ্যাথিক ও ৩২ হার্বাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। দেশে এক লাখ ১৫ হাজার ৪৩৯ লাইসেন্সধারী ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, বিধিমোতাবেক এসব ওষুধ প্রস্তুতকারী ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর পালন করে থাকে। তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেÑ ওষুধ উৎপাদন কারখানার নতুন প্রকল্প মূল্যায়ন, ওষুধ প্রস্তুতের জন্য লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, খুচরা ও পাইকারি ওষুধ বিক্রির লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, ওষুধের রেজিস্ট্রেশন প্রদান ও নবায়ন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য সনদ প্রদান, ওষুধের কাঁচামাল ও মোড়কসামগ্রী আমদানির জন্য ব্লকলিস্ট অনুমোদন, ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে ইন্ডেন্ট অনুমোদন, আমদনিকৃত তৈরি ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামালের ছাড়পত্র প্রদান, ওষুধ রফতানির জন্য লাইসেন্স, সার্টিফিকেট অব ফার্মাসিউটিক্যালস্ প্রোডাক্ট (সিপিপি), ফ্রি সেল সার্টিফিকেট (এফএসসি) ও গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) সার্টিফিকেট প্রদান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব কার্যক্রম সম্পাদনে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ব্যর্থতার চিত্রই বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে।
×