ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেখে গেলেন চীনা পাঁচ সাবেক রাষ্ট্রদূত

পদ্মায় বিরামহীন কর্মযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

পদ্মায় বিরামহীন কর্মযজ্ঞ

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ॥ পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ চলছে এখন বিরামহীন। কনকনে শীতেও ঘাম ঝরছে কর্মীদের। পদ্মা শান্ত থাকায় কাজের গতি বেড়েছে কয়েক গুণ। ইতোমধ্যেই মূল পিলারের তিনটি পাইল স্থাপন হয়েগেছে। এখন ড্রাইভ চলছে আরও দুটি পাইল স্থাপনে। আর নদী শাসনে এখন মাওয়া প্রান্তে হরদম ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। ইতোমধ্যেই মূল সেতুর ২০ শতাংশ, নদী শাসনে ১৫ শতাংশ, এ্যাপ্রোচ সড়কের ৬০ শতাংশসহ সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজের তদারকিও হচ্ছে যথাযথ। এদিকে পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ নিজের চোখে দেখতে আসেন বাংলাদেশের চীনা সাবেক পাঁচ রাষ্ট্রদূত। সঙ্গে ছিলেন এক চীনা গবেষক। সোমবার টিমটি মাওয়ায় প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এবং কাজের খুটিনাটি খোঁজ খবর করেন। এই দলে ছিলেন বাংলাদেশের চীনা সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়াং চুং গুই হু জিয়ান ওয়েন, চাই শি, ঝেং জিন দিয়ান, কিংদিয়ান ও সিপিআইএফএর গবেষক ডু মিন। টানা চার ঘণ্টা তারা মাওয়ায় অবস্থান করেন। তারা পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে অভিভূত হন। কাজের অগ্রতিতে দলটি সন্তোষ প্রকাশ করে। সাবেক এই রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই সেতুর কাজ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যখন তারা এদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই তুলনায় আর্থ-সামাজিক চিত্রের তফাত চোখে পরার মতো। উন্নত অবকাঠামো, অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার এবং মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছয় সদস্যে এই দলটি বিআইআইএসএসের (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ) আমন্ত্রণে রবিবার বাংলাদেশে আসেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তাদের এই সফরের অন্যতম আগ্রহ ছিল পদ্ম সেতু। তাই বাংলাদেশে আসার পরদিনই এসেছেন পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায়। পদ্মা সেতুর কাজ এখন চলছে এক রকম উড়ন্ত গতিতে। নদী, তীর এবং আশাপাশ সব জায়গাই কর্মব্যস্ততা। ভারি ভারি নির্মাণ যন্ত্রে ছেড়ে গেছে। সবখানেই কাজ আর কাজ। এই পদ্মা সেতুতে ২০ হাজার কর্মী এখন কাজ করছে। ইতোমধ্যেই দেশী-বিদেশী এক্সপার্ট প্যানেল ঘুরে গেছেন প্রকল্প এলাকা তাদের রিপোর্র্ট সন্তোষজনক। মাওয়া প্রান্তের নদী শাসনের কাজ আগামী মে মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে প্রায় ৩৩ লাখ ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে পার বাঁধাই করা হবে। গত কয়েক দিনে ২০ হাজার জিও ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে। এক মিলিয়ন কিউবিক মিটার বালু অপসারণ করা হচ্ছে। এই বালুগুলো মাঝের চরে ফেলা হচ্ছে। এখানে প্রাণীর জীন বৈচিত্র্য নিয়ে বিশ্বমানের জাদুঘর করার পরিকল্পনা রয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি থেকে এই ড্রেজিং শুরু হয়েছে। জার্মানির তৈরি ২ হাজার ৪শ’ কিলো জুল ক্ষমতার হ্যামারের হাতুড়ি বাড়ি দিয়ে মূল পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। পদ্মার মাওয়া প্রান্তে সাত নম্বর পিলার এবং ছয় নম্বর পিলারে চলছে এই মূল পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সাত নম্বর পিলারে দুটি এবং ছয় নম্বর পিলারে একটি মোট তিনটি পাইল স্থাপন হয়েছে। এখন ছয় ও সাত নম্বর পিলারে একটি করে পাইল স্থাপনের কাজ চলছে। সার্ভিস পাইল স্থাপনে প্রচ- শব্দ হয়। পাইলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হবে সেতুর ¯প্যান (পিলার)। পিলারের ওপর বসবে সেতুর সø্যাব ও ট্রাস। চীনে সø্যাব ও ট্রাস বানানোর কাজ চলছে। পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে সø্যাব ও ট্রাসজুড়ে দেয়া হবে। তাই প্রথমেই সেতুর ৪২টি পিলার তৈরি করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আব্দুল আউয়াল ও জাপান থেকে ইসিহারা, কানাডার অস্টেন ফিল্ট ও নেদারল্যান্ডসের কারবাজাল এবং বাংলাদেশী জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ বাংলাদেশের পাঁচ মোট নয় জনের এক্সপার্ট প্যানেল সম্প্রতি ঘুরে গেছেন প্রকল্প এলাকা। দেশী-বিদেশী নয় সদস্যের এই টিম বৈঠকও করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এই টিমের অবজারভেশন অনুযায়ী কাজ চলছে। দেশী-বিদেশী প্রায় ২০ হাজার কর্মীর নিরন্তর কাজ করছেন। ২০ হাজারের ১৮ হাজার বাংলাদেশী। আর দু’ হাজার বিদেশী। এই ২০ হাজারের বাইরে নিরাপত্তায় দু’পারে রয়েছে ২ হাজার সেনা সদস্য। এ ছাড়া পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন তো রয়েছেই। সকলের মধ্যেই নতুন উদ্দীপনা কাজ করছে। জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল জানান, সকলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ এখানে যারা কাজ করছেন তারা সকলেই মহাকালের এক ইতিহাস হচ্ছেন। তাই বিশেষ পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। স্থানীয় সাংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসী নির্দেশনায় সেতুর কাজ উড়ন্ত গতি পেয়েছে। সেতুর কাজ যতই এগুচ্ছে এলাকার চিত্রও ততই পাল্টে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার তিনি প্রকল্প এলাকায় ঘুরে বলেন, মাওয়ার পরিবর্তনটা এতই সাফল্যের যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ওয়েল্ডিংয়ের আলোর ঝলকানি আর ভারি যন্ত্রপাতির শব্দে মুখরিত পদ্মাপাড়। ইতোমধ্যেই সচিব সভা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পস্থলে। এরই মধ্যে সরকারের প্রতিটি বিভাগকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লবসহ সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই প্রকল্প অনেক বড় অবদান রাখার জন্যই সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সরব রয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ পর্যবেক্ষণে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রোনের সাহায্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি। ঠিকাদারের নিজস্ব উদ্যোগ ও খরচে মাওয়া সাইট অফিস থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয় কাজের অগ্রগতি। এ জন্য ড্রোনের সাহায্যে তদারকি করা হয়। যদিও এখন ড্রোন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে না। এতে বসানো হয়েছে হাই রেজ্যুলেশন ক্যামেরা, যা দিয়ে নির্মাণকাজের স্থির ও ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করা যায়। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় এবং কারিগরি সহায়তায় কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজড ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে এখানে। এ ব্রিগেডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক জানান, দেশের সর্ববৃহৎ এই কমযজ্ঞে অংশ নিতে পেরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গর্ববোধ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পকে ইউটার্ন প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। এই সেতুটি বহুমুখী এ কারণে যে, এর ওপরের অংশ দিয়ে বাস-ট্রাক ইত্যাদি যানবাহন যেমন প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে পারাপার হতে পারবে, একই সঙ্গে এর নিচের অংশ দিয়ে চলাচল করবে দ্রুতগামী ট্রেন। সেই সঙ্গে এই সেতুকে অবলম্বন করে নেয়া হবে গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবার, টেলিফোন ও বিদ্যুত সংযোগ। চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। এত বড় স্প্যানের সেতু বাংলাদেশের কোন নদীর ওপর দিয়ে ইতোপূর্বে করা হয়নি। স্প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাসফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিয়ার (পিলার), যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬টি পাইল। নদীর মাঝখানের অংশে এই পাইলগুলো হবে স্টিলের তৈরি এবং পাড়ের কাছে হবে রিইনফোর্সড কংক্রিটের তৈরি। পাইলগুলোর ব্যাস ৩ মিটার এবং দৈর্ঘ্য নদীর তলদেশ ভেদ করে স্থানভেদে ১০১ মিটার থেকে ১১৭ মিটার পর্যন্ত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর আগে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। মঙ্গলবার একনেক সভায় সংশোধিত আকারে প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর কারণে মংলা বন্দর ছাড়াও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জনপদে এখন অগ্রগতির নানা পরিকল্পনা চলছে।
×