হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ ভূমিকম্পসহ যেকোন দুর্যোগের হাত থেকে নগরাঞ্চলের ভবন সুরক্ষায় সহায়তা দিচ্ছে জাপান। সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এর মাধ্যমে রাজধানীর দশটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনীয় করা হবে। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৫৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৯৭ কোটি ৩১ লাখ এবং জাপানী সহায়তা থেকে ৪৭৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে সরকারী অনেক ভবন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো রেট্রোফিটিং-এর মাধ্যমে ভূমিকম্পসহনীয় করে গড়ে তোলা যায়, যা পুনঃনির্মাণ করলে ব্যয় ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণের চেয়ে অনেক কম। এ বিবেচনায় সরকারী জনগুরুত্বপূর্ণ ভবনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনগুলোকে এ প্রকল্পের আওতায় রেট্রোফিটিং করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য এস এম গোলাম ফারুক পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে জানান, জাইকার অর্থায়নে এ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট দশটি ফায়ার স্টেশন রেট্রোফিটিং করা হবে। এতে ফায়ার সার্ভিসের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং স্টেশনগুলোর ভূমিকম্প সহনীয় সক্ষমতা বাড়বে। এসব বিবেচনায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির আগামী সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।
কম্পোন্টে-টু এর আওতায় রাজধানী ও এর আশপাশে যেসব ফায়ার স্টেশন রেট্রোফিটিং করা হবে সেগুলো হচ্ছে, মিরপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতর, ডেমরা ফায়ার স্টেশন, খিলগাঁও ফায়ার স্টেশন, কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশন, লালবাগ স্টেশন, তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন, সাভার ফায়ার স্টেশন, বারিধারা ফায়ার স্টেশন, কেরানীগঞ্জ ফায়ার স্টেশন এবং ধামরাই ফায়ার স্টেশন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০০৬ সালে এটি আইনগত ভিত্তি পায়। বর্তমানে এটি হালনাগাদের কাজ চলছে। কিন্তু এ কোড কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট কৌশল এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য এ বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভবন নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন জরুরী।
বাংলাদেশ সরকার জাইকার সহযোগিতায় প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান সহজ শর্তের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ভবনের সুরক্ষা উন্নয়নের কাজ করছে। এ লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রজেক্ট ফর ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অন ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসিস্টেন টেকনিক অব কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড রেট্রোফিটিং ফর পাবলিক বিল্ডিং এবং রেডিমেট গার্মেন্টস সেক্টর সেফ ওয়ার্কিং এনভায়রমেন্ট প্রোগ্রাম। এসব কর্মসূচীর মাধ্যমে ভবনের সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগত মানদ-, বেসরকারী ভবনের সুরক্ষা কার্যক্রমে অর্থায়ন পদ্ধতির উন্নয়ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাইলট রেট্রোফিটিং বিষয়গুলো অর্জন করা সম্ভব হবে। এসবের পাশাপাশি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন, তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে প্রাধিকারভিত্তিক ঋণ প্রদান করা এবং ভবন সুরক্ষার জন্য দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে।
ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবন (বিশেষভাবে বেসরকারী ভবন-যেমন বস্ত্র কারখানা এবং সরকারী ভবন যেমনÑ সরকারী দফতর, ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল স্কুল ইত্যাদি) নির্মাণে আরবান বিল্ডিং সেফটি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৮৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রকল্পে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেসরকারী ভবনসমূহ রেট্রোফিটিং-এর সংস্থান ছিল। এজন্য বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল ২৬৮ কোটি ১১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এ অর্থ ও কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এ অংশটি কম্টোনেন্ট-১ এ যুক্ত হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনর্গঠিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে ৫৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এর আগে বলেছেন, আমি প্রাকৃতিক মৃত্যু দেখতে চাই। কারও জন্য অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে চাই না, সবাই চায় প্রাকৃতিকভাবেই তার মৃত্যু হোক। এজন্য আমরা আর একটি রানাপ্লাজা দেখতে চাই না। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই, আর ভুল করতে চাই না। মন্ত্রী বলেন, সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে জমির ম্যাপিং করতে হবে। তারপর কোন এলাকায় কেমন বিল্ডিং করা যাবে তা ঠিক করে দিতে হবে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই দুর্যোগ মোকাবেলা করা না গেলেও আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি করে ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে পারি। এজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারীভাবে গ্রামে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত জমির জোনিং করা প্রয়োজন। কেননা মানুষ মনে করে নিজের টাকায় বিল্ডিং বানাচ্ছি কার কি আসে যায়। এ ধারণা বদলাতে হবে। তিনি বলেন, সরকার উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু সচেতনতা তৈরিতে সহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের সিডিএমপি মতে, ঢাকা বিভাগের মধুপুর ফল্টে যদি সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকা শহরের ৮৬ হাজার আধুনিক বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ৭২ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হবে। যদি ভূমিকম্পটি রাত দু টার সময় হয় তাহলে মারা যাবে ৮৮ হাজার মানুষ আর যদি দুপুর দুইটায় হয় তাহলে মারা যাবে ৬১ হাজার মানুষ। চট্টগ্রাম বিভাগের প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-এক এ যদি আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে শহরের ২৫ হাজার বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এক লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হয়ে যাবে। ভূমিকম্পটি যদি রাত দুটার সময় হয় তাহলে মারা যাবে ৯৫ হাজার মানুষ আর দুপুর দুুটার দিকে হলে মারা যাবে ৭৩ হাজার মানুষ। সিলেট বিভাগের ডাউকি ফল্টে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শহরের ১৬ হাজার বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ২৫ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হবে। ভূমিকম্পটি যদি রাত দুটার সময় হয় তাহলে মারা যাবে ১০ হাজার মানুষ আর দুপুর দুটায় হলে মারা যাবে প্রায় ছয় হাজার মানুষ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যৌথভাবে দুর্যোগের হাত থেকে ৩ শহর (ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট) রক্ষায় সহযোগিতা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এর অংশ হিসেবে নেয়া হচ্ছে বিল্ডিং সেফটি প্রজেক্ট (ইউবিএসপি)।