ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ

জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলাম স্যারকে আমি দেখেছি

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলাম স্যারকে আমি দেখেছি

জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নূরুল ইসলাম স্যারকে খুব মনে পড়ছে। দেখতে দেখতে দুইটি বছর অতিক্রান্ত হলো। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নূরুল ইসলাম স্যার ছিলেন একজন যুগদ্রষ্টা, যুগস্রষ্টা। প্রচুর প্রাণশক্তি আর ব্যাপক কর্মস্পৃৃহায় পরিপূর্ণ এই মানুষটি সারাজীবন যে কাজে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত সব্যসাচী; যেমন ছিলেন প্রথিতযশা চিকিৎসক, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও চৌকস গবেষক, তেমনি ছিলেন সচেতন সমাজকর্মী ও সুদক্ষ প্রশাসক। আমাদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যখাতে স্যারের অবদান অপরিসীম। অগণিত রোগাক্রান্তকে সেবা দেয়ার পাশাপাশি তিনি শিক্ষক হিসেবে তৈরি করেছেন অসংখ্য মেধাবী ও সফল চিকিৎসক। তার হাত ধরেই পরবর্তী প্রজন্মের নামী-দামী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের পথচলা শুরু করেছিলেন। শুধু জ্ঞানের আলো আর অভিজ্ঞতার ঝুলিই নয়, স্যারের কাছ থেকে তারা পেয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতা আর বিজ্ঞানমনস্কতার নির্দেশনা, সেইসঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে মানবতা আর সমাজসচেতনতার দীক্ষা। ছাত্রদের পড়ানোর পাশাপাশি তিনি তাদের সুবিধার্থে ইংরেজীতে পাঠ্যবই রচনা করেছেন। আবার সাধারণ মানুষের জন্য বাংলা ভাষায় সহজ করে বই লিখেছেন। তিনি চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা করেছেন প্রচুর। তার অনেক গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক ও খ্যাতিমান অনেক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ইসলাম স্যারের মূল অবদান আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একেবারে ভিত্তিমূলে। এদেশের স্বাস্থ্য সেবাদানের অবকাঠামো গড়ে তোলা, নীতি নির্ধারণ আর চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার একেবারে গোড়াতেই ছিল তার ভূমিকা। বলা চলে তার সেসব উদ্যোগ আর কাজের উপরই আজকের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে পিজি হাসপাতাল। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন এ্যান্ড রিসার্চ, যা জনপ্রিয় হয় পিজি হাসপাতাল নামে, তার প্রতিষ্ঠার পেছনে ইসলাম স্যারের অবদান অনস্বীকার্য। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে মেধা ও শ্রম দিয়ে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছিলেন। সেই সময় এই দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার কোন সুযোগ ছিল না। তিনিই প্রথম পিজি হাসপাতালের মাধ্যমে এফসিপিএসসহ অন্যান্য পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেরা ছাত্রছাত্রীরা এখানে উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন, করতেন বিশ্বমানের গবেষণা। কালের পরিক্রমায় পিজি হাসপাতাল আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নামে চিকিৎসাসেবা আর গবেষণার অন্যতম শীর্ষস্থান হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। বলা চলে এদেশে এই পর্যায়ে চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণার পথিকৃৎ তিনিই। তিনি সেদিন শুরু করতে পেরেছিলেন বলেই আজ আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। শুধু চিকিৎসাসেবা, গবেষণা আর একাডেমিক শিক্ষাদানই নয়, তিনি সমাজসচেতনতা আর চিকিৎসক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতীকও। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তিনি শুধু অবহিতই ছিলেন না, একজন সচেতন চিকিৎসক হিসেবে সাধারণ মানুষকে এই বিষয়ে জানানোর প্রয়োজনীয়তাও তিনি উপলব্ধি করেন। ধূমপানের বিরুদ্ধে সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রেরণা থেকে তিনি ‘আধূনিক’ (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) নামক জনপ্রিয় ধূমপানবিরোধী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এক অর্থে এদেশে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ের শুরুতেও তাই তার নামই চলে আসে। স্যারের আরেকটি অবিস্মরণীয় কাজ ১৯৮২ সালে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা। সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবাকে সহজলভ্য করা আর অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার রোধ করাই ছিল ওষুধনীতির লক্ষ্য, যা পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি অর্জিত হয়েছে। আর এরই প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ আমাদের দেশের ওষুধ শিল্প আজ স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, আমাদের ওষুধসামগ্রী আজ সুনামের সঙ্গে বহির্বিশ্বে রফতানি হচ্ছে। ওষুধনীতির অন্যতম প্রবক্তা ইসলাম স্যার চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেও সকল নৈতিকতা মেনে চলতেন। তিনি কখনই অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখতেন না, যথাসম্ভব কম ওষুধ লিখতেন, এমনকি কখনও কখনও লিখে দিতেন যে, কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই। এছাড়া বিভিন্ন রকমের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিচক্ষণ। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া অযথা রোগীকে কোন পরীক্ষা করাতেন না। তিনি প্রায়ই প্রশ্ন রাখতেন, ‘কেন এত অপ্রয়োজনীয় টেস্ট,’ যা অনেক রোগীর জন্য এক বোঝাস্বরূপ। আজন্ম কর্মঠ ইসলাম স্যার অবসরের পরেও নিজেকে কাজেই নিয়োজিত রেখেছিলেন। নতুন নতুন সৃষ্টি আর নতুন নতুন গড়ে তোলাই ছিল তার নেশা। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি), যা আমাদের দেশে বেসরকারী পর্যায়ে মেডিক্যালসহ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামে গড়ে তোলার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল। চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে তিনি নিজ গ্রামকে এবং চট্টগ্রামকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, চট্টগ্রামে কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন। অন্যদিকে সবকিছুকে রাজধানীকেন্দ্রিক না করে, সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে ঢাকার বাইরে উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতেন। কীর্তিমান এই পুরুষ তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রায় ৩২টি গুরুত্বপূর্ণ দেশী-বিদেশী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক (১৯৬৩), সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পদক (১৯৭০), বিজ্ঞান লেখক পুরস্কার (১৯৮২), ফজলুল হক মেমোরিয়াল পুরস্কার (১৯৮৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০৩) ইত্যাদি। ধূমপানবিরোধী কর্মকা-ের স্বীকৃতিস্বরূপ পরপর ৩ বছর তিনি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানী আর মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীই ছিলেন না, প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ আদর্শ মুসলিম। যেমন ছিলেন কঠোর প্রশাসক, কোনরূপ অন্যায় বিচ্যুতি সহ্য করতেন না, তেমনি ছিলেন পিতৃসম অভিভাবক, অধীনস্থ সবাইকে তিনি নিজের ছায়ায় রাখতেন। দেখা যেত, কাজে ফাঁকি দেয়ায় বকা-ঝকা করতেন, আবার পরক্ষণেই তাকে পরম মমতায় কাছে টেনে বুঝিয়ে দিতেন। তাকে প্রায়ই বলতে শুনেছি ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে।’ ছাত্রদের প্রতি ছিল তার অপরিসীম স্নেহ, মমতা, ভালবাসা। তিনি শুধু নির্দেশই দিতেন না, নিজে তা করে দেখিয়ে দিতেন, দৃষ্টান্ত রাখতেন। তার মধ্যে আরেকটি অনুকরণীয় গুণ ছিল, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর সময় সচেতনতা। তিনি নিজে সময় মতো অফিসে আসতেন এবং সবাইকে তা করার নির্দেশ দিতেন। আমি নিজে স্যারের একজন ছাত্র ছিলাম, যা আমার পরম সৌভাগ্য ও গর্বের। তার শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের সকলের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত আমার দুইটি বই, যা আন্তর্জাতিক প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে, তা স্যার বেঁচে থাকতেই আমি তার নামে উৎসর্গ করতে পেরে নিজেকে সম্মানিত ও গর্বিত বোধ করছি। নূরুল ইসলাম স্যার সত্যিকারের একজন আলোকিত, আদর্শ মানুষ। আমাদের চিকিৎসা খাত, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি ওষুধ শিল্প বিকাশে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, জাতি তা চিরদিন শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে। তিনি ক্ষণজন্মা পুরুষ, বেঁচে থাকবেন তার কর্ম ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের চিকিৎসকগণ তার আদর্শ ও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চিকিৎসা পেশার উন্নয়নে এবং রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রেখে তার আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই হোক আমাদের কাম্য। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×