ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাকালুকি হাওড়

পরিযায়ী পাখির অবাধ ওড়াউড়ি- যেন মর্ত্যে স্বর্গোদ্যান

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

পরিযায়ী পাখির অবাধ ওড়াউড়ি- যেন মর্ত্যে স্বর্গোদ্যান

সালাম মশরুর ॥ শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে অতিথি পাখিরাও সারি বেঁধে এখানে আসতে শুরু করে। শীতপ্রধান অঞ্চল বিশেষ করে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এরা আমাদের দেশে আসে। এই পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যস্থল বৃহত্তর সিলেটের হাকালুকি হাওড়। এসব পরিযায়ী পাখির আগমনে হাকালুকি যেন পরিণত হয় মর্ত্যরে স্বর্গোদ্যানে। এদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ আর অবাধ ওড়াউড়িতে এক অনির্বচনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয় গোটা হাওড় এলাকায়। এই অপার সৌন্দর্যের এই লীলা নিকেতন দেখতে এখানে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষরা। এ সময়টায় এখানে পর্যটকদের পদচারণাও বেড়ে যায়। শীত মৌসুমে এশিয়ার উত্তরাংশের সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ২৫ প্রজাতির হাঁস এবং জলচর পাখি হাওড় এলাকায় ভ্রমণে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আমাদের প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখি। হাওড়ে পরিযায়ী হাঁসের মধ্যে রয়েছে রাজসরালী, গরাদমাথা রাজহাঁস, চখাচখী, ধলাবেলে হাঁস, গাডোয়াল, ইউরেসীয় সিথীহাঁস, টিকীহাঁস, পাতিহাঁস প্রভৃতি আরও অসংখ্য প্রজাতির হাঁস। দেশী প্রজাতির হাঁসের মধ্যে রয়েছে বেগুনি কালেম, পানমুরসী, পাতিকুট, ডাহুক, ইউরেসীয় মুরগি চ্যাগা, রাঙ্গাচ্যাগা, জলাপিপি, ময়ূরলেজা পিপি, পাতি জিরিয়া, হাট্টিটি, ভুবনচিল, শঙ্খচিল, কুড়াল ঈগল, বড়খোঁপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, খয়রা বক, সাদা বক প্রভৃতি নানা নামে অসংখ্য পাখি। এসব হলো গতানুগতিক হিসাব। এদিকে, দেশের বৃহত্তম হাওড় হাকালুকিতে এ বছর অতিথি পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওড়ে এবার ৫৬ প্রজাতির ৩৪ হাজার ২৬৪টি জলচর পাখির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের দুই দিনের জলচর পাখিশুমারি শেষে ক্লাবের চেয়ারম্যান ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক এ তথ্য জানান। ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি দুই দিনে এই হাওড়ের ৪২টি বিলে জলচর পাখি গণনা করা হয়। গত বছর শুমারিকালে এই হাওড়ে মাত্র ২১ হাজার ৬৩১টি পাখি দেখা গিয়েছিল। এ হিসেবে এ বছর হাকালুকিতে ১২ হাজার ৬৩৩টি জলচর পাখি বেশি এসেছে। বার্ডক্লাবের সদস্য এবং দেশী-বিদেশী পাখি বিশেষজ্ঞগণ দুই দিনের এই পাখি শুমারিতে অংশগ্রহণ করেন। সূত্রে জানা গেছে, পাখি গণনার জন্য পুরো হাকালুকি হাওড়কে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দিন মাইজগাঁও যুধিষ্টিপুর ও বড়লেখার হাল্লা পথে এবং শেষের দিন ঘিলাছড়ার কালনীগড় ও বড়লেখার কাংলী পথে যেসব বিল রয়েছে সেগুলোতে শুমারি করা হয়। এর আগে ২৪ জানুয়ারি ৬ দিনব্যাপী পাখির পায়ে রিং লাগানো (রিংগিং ক্যাম্প) শেষ হয়েছে। চলতি বছর অতীতের রিং লাগানো ৩০টি পাখি হাকালুকিতে ফিরে এসেছে বলে জানান রিংগিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী পাখি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে পাখি শুমারি শুরু হওয়ার আগে হাকালুকি হাওড়ে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী পরিযায়ী পাখিদের পায়ে রিং লাগানো হয়। এবার ১৫ প্রজাতির সাড়ে ৩শ’ পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং লাগানো হয়। বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৩৩ প্রজাতির ৩৭০টি পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং লাগানো হয়েছিল। বিদায়ী বছরের রিং লাগানো ৩০টি পাখি চলতি বছর হাকালুকি হাওড়ে ফিরে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মূলত ২০১০ সাল থেকে পাখির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং লাগোনো হয়ে আসছে। ফিরে আসা পাখিগুলো রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল ঘুরে আবার হাকালুকিতে ফিরে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। দেশের যেসব স্থানে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে হাকালুকি হাওড় তাদের অন্যতম। দুই দিনব্যাপী পাখি শুমারিতে আর্থিক সহায়তা করছে ইউএসএআইডির ক্রেল প্রকল্প। এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও হাকালুকি হাওড়ে অবাধে অতিথি পাখি নিধন হচ্ছে। পাখি শিকারীরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ও জাল ফেলে কৌশলে পাখি ধরা অব্যাহত রেখেছে। বিষটোপ দিয়েও পাখি শিকার করা হচ্ছে। গরু চরানোর নামে ছদ্মবেশে দিনের বেলা শিকারীরা হাওড়ে গিয়ে পাখি ধরার ফাঁদ পেতে আসে। বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রেখে দেয়ায় পাখি মারা যাচ্ছে। এছাড়া, হাওড়ের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তার মধ্যে রয়েছে- আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং ও কৈসহ আরও নানা প্রজাতির। শীতকালই হাকালুকি হাওড় ভ্রমণের সেরা সময়। কারণ এ সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী পাখিদের পাশাপাশি মানুষেরও ঢল নামে। তাই নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসটাই হাওড় ভ্রমণের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। জলজ উদ্ভিদ আর মাছ প্রেমীদের জন্যও এ সময়টা সেরা। এ সময়ে এই হাওড় থেকে প্রচুর মাছও ধরা হয়। তাই এ সময় এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ১৮.১১৫ হেক্টর জমি নিয়ে হাকালুকি হাওড়ের অবস্থান। বর্ষা এবং শীত দুটি মৌসুমেই বিশাল এই হাওড় অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মতো এখানেও প্রকৃতির উপচেপড়া রূপ হাত ছানি দিয়ে ডাকে। হাওড়ের বিস্তৃত দিগন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। চারধারে চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিছুটা উঁচুভূমি বিলের পানিতে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্যের। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওড়ের জলরাশি জুড়ে সূর্য কিরণের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। জীববৈচিত্র্য ॥ হাওড়ে বিলগুলোতে প্রায় সারাবছর পানি থাকে। হাওড়ের জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী ও পানাই নদী। এই বিলগুলো মৎস্য সম্পদের আধার। বছরে প্রায় ২৫ শ’ টন মাছ উৎপাদন হয়। তবে যথেচ্ছভাবে মাছ ধরার কারণে দেশী জাতের রানী, তুরাল, রাঁচি, বাতাসি, গলদাচিংড়ি, বাঘমাছ, চিতল ইত্যাদি মাছ আর এখন হাওড়ে পাওয়া যায় না। হাওড়ে শীতকালে আগমন ঘটে অতিথি জলচর পাখির। গত শীত মৌসুমে ৪৮ প্রজাতির প্রায় ১ লাখ পাখি এসেছিল। এসব অতিথি পাখির মধ্যে ভূতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, বালি হাঁস, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, রাজ সরালি, পান ভুলানি, কাস্তেচড়া, পানকৌড়ি. বেগুনী কালিম, মেটেমাথা টিটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই হাকালুকি হাওড়ে আছে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি। সঙ্কটাপন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ॥ মৌলভীবাজার জেলায় ৭৫ ভাগ এবং সিলেট জেলায় ২৫ ভাগ জায়গা নিয়ে অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ মিঠা পানির হাওড় হাকালুকি। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই হাকালুকি হাওড়ের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওড় থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, প্রাণী এবং উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাকালুকি হাওড়কে অদূর ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ সরকারী হিসাব মতে ১ হাজার ২০৩ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ ছিল হাকালুকি হাওড়ে। প্রতিদিন ৪ লক্ষাধিক মানুষের খাবার যোগান হতো এখান থেকে। সম্প্রতি সেভাবে জেলেদের জালে মাছ আসছে না। গোলাপগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভাদেশ্বর ও শরিফগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ভাটেরা, বরমচাল ও ভূকশিমইল, জুড়ীর পশ্চিম জুড়ী, জায়ফরনগর ও বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ, সুজানগর, বর্ণী ও তালিমপুরের বৃহদাংশ জুড়ে এর অবস্থান। বিগত দিনের হিসাব অনুযায়ী এই হাওড়ে ১১২ প্রজাতির পরিযায়ী ও ৩০৫ প্রজাতির স্থানীয় পাখি ছিল। এদের মধ্যে বিরল প্রজাতির স্থানীয় পাখিও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য মদনটাক, প্যালাসেস ফিস, ঈগল ইত্যাদি। এই হাওড়ে রয়েছে ১২ প্রজাতির উভচর, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। যার বিরাট একটি অংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ বিড়াল, মেছোবাঘ, বাগডাশসহ আরও কয়েকটি। এখানকার নদীগুলোতে এখনও মাঝে মধ্যে শুশুকের দেখা পাওয়া যায়। জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সম্ভার এ হাওড় বিভিন্ন কারণে তার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স হারাচ্ছে।
×