ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিআইয়ের মতে এবারও দুর্নীতি বেড়েছে বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

টিআইয়ের মতে এবারও দুর্নীতি বেড়েছে বাংলাদেশে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় দুর্নীতি কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ২০১৫ সালের সারাবিশ্বের দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) অনুযায়ী বিশ্বের ১৬৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উর্ধক্রম অনুযায়ী ১৩৯তম এবং নিম্নক্রমে ১৩ তম। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম, আর ২০১৩ সালে ছিল ১৬তম এবং ২০১২ সালে ছিল ১৩তম স্থানে। বুধবার রাজধানীর ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক সংবাদ সম্মেলনে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। রিপোর্টে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দুর্নীতির পরিমাণ বাড়ায় উদ্বেগ জানানো হয়। বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই)-২০১৫ এর প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। সূচক অনুযায়ী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ যৌথভাবে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। সোমালিয়া পর পর আট বার এ তালিকায় দুর্নীতিতে প্রথম স্থানে উঠে আসে। আর সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে ডেনমার্ক। সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতির তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৫ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বৈশ্বিকভাবেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। ১৬৮টি দেশের মধ্যে ১১৪টি দেশ অর্থাৎ ৬৮ ভাগ দেশ ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৩টি দেশ সূচকের গড় স্কোর ৪৩ এর কম পেয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ৯২টি দেশের স্কোর বেড়েছিল, ২০১৫ সালে বেড়েছে ৬৫টি দেশের। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ৩৬টি দেশের তুলনায় ২০১৫ সালে ৪৯টি দেশের স্কোরে অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৪ সালের মতোই ২০১৫ সালেও ২৫ স্কোর পেয়ে তালিকায় এক ধাপ অবনতি হয়েছে। সূচক তৈরির জন্য ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির মাত্রা প্রকাশ করে। দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) সূচকের ০-১০০ এর স্কেলের মাধ্যমে দুর্নীতির এ মাত্রা বা হার প্রকাশ করে সংস্থাটি। সূচক অনুযায়ী ১০০ এর মধ্যে ৪৩ স্কোর বৈশ্বিক গড় স্কোর ধরা হয়। অর্থাৎ কোন দেশ ১০০ এর মধ্যে ৪৩ পেলে তা পাস নম্বর ধরা হয় বা ওই দেশের দুর্নীতির মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে। কিন্তু সিপিআই সূচক অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের স্কোর ২৫। অর্থাৎ বাংলাদেশ দুর্নীতির পরীক্ষায় পাস নম্বরও তুলতে পারেনি। টিআইবির মতে, দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশে ‘দুর্নীতির মাত্রা অধিক’। তাদের মতে, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীদের দুর্নীতিগ্রস্ত মনে হয়ে। বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে দুর্নীতিগ্রস্তই বলা যায় না। অনুষ্ঠানে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা এখনও গড় স্কোরের কাছেও যেতে পারিনি, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা ছিল তাতে করে স্কোর আরও বাড়তে পারত। কার্যকর ব্যবস্থার অভাবে গত বছর যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি। এ স্কোরে আমরা সন্তুষ্ট নই। অর্থাৎ ২০১৫ সালের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও উর্ধক্রম অনুযায়ী ৬ ধাপ এগিয়েছে; আর নিম্নক্রমে ১ ধাপ কমেছে। এ বছর একই স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তালিকার নিম্নক্রমে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে গিনি লাওস, কেনিয়া, পাপুয়া গিনি ও উগান্ডা। তবে দ্বিতীয় সিপিআই অনুযায়ী বাংলাদেশকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’ বলা যাবে না। বরং সূচকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুলনায় বাংলাদেশ ‘দুর্নীতির মাত্রা অধিক’ বলা যেতে পারে। জনাব ইফতেখার বলেন, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীদের দুর্নীতিগ্রস্ত মনে হয়ে। বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। তবে ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতি প্রশ্রয়কারীদের চিহ্নিত করে তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দেশে দুর্নীতি কমবে। তিনি বলেন, রিপোর্ট অনুযায়ী স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও অবস্থান এক ধাপ কমেছে। বাংলাদেশের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সংসদ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও কার্যকর করতে হবে। সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।দুর্নীতি রোধে যেসব নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ আছে সেগুলো কার্যকর করতে হবে। রাজনৈতিক যে সদিচ্ছা আছে সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। টিআইবির এ নির্বাহী পরিচালক জানান, উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে। যদিও বাস্তবে তা হয়েছে এজন্য যে, সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি, যারা সবসময় বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের এক ধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ তুলনায় ৩ ধাপ নিচে ও ২ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হলো না। প্রকৃতপক্ষে এই অবস্থানে আমরা সন্তুষ্ট নই। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬৮টি দেশের মধ্যে ০-১০০ স্কেলে মাত্র ৮ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথমে অবস্থান করছে। আর ৯১ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার প্রথমে রয়েছে ডেনমার্ক। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার মধ্যে ১১ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আফগানিস্তান, ১২ পয়েন্ট পেয়ে তৃতীয় সুদান, ১৫ পয়েন্ট পেয়ে চতুর্থ স্থানে দক্ষিণ সুদান ও ১৬ পয়েন্ট পেয়ে একই অবস্থানে রয়েছে এঙ্গোলা, ১৬ পয়েন্ট পেয়ে তালিকায় যৌথভাবে পঞ্চম হয়েছে লিবিয়া ও ইরাক। এ তালিকায় ২৫ পয়েন্ট পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ তম। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ৯১ স্কোর পেয়ে ১ম স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, ৯০ স্কোর পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড, ৮৯ স্কোর পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে নিউজিল্যান্ড, ৮৭ স্কোর পেয়ে চতুর্থ স্থানে নেদারল্যান্ডস এবং একই স্কোর পেয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৬৫ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হিসেবে অবস্থান করছে ভুটান আর ১১ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে অবস্থান করছে আফগানিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, ২৭ স্কোর পেয়ে তৃতীয় নেপাল, ৩০ স্কোর পেয়ে চতুর্থ পাকিস্তান, ৩৭ স্কোর পেয়ে পঞ্চম শ্রীলঙ্কা আর ৩৮ স্কোর পেয়ে ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে ভারত। সিপিআই সূচকে স্কেলের ০ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেশ বলে ধারণা করা হয়। অনুষ্ঠানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, একটি পত্রিকায় আজ আরেকটি জরিপের কথা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে- উন্নয়নের কারণে জনগণ গণতন্ত্রের দুঃখ ভুলে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের দুঃখ ভোলার নয়; গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়েও ভাবার অবকাশ আছে। কারণ গণতন্ত্র বাস্তবায়ন না হলে সাধারণ জনগণ উন্নয়নের সুফল পায় না। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, ও ড. সুমাইয়া খায়ের।
×