ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চালুর পরও ওয়াটার বাস সার্ভিস ফলপ্রসূ হয়নি এ কারণে

দায়ী সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব ॥ ঢাকার চারপাশে নৌপথ ব্যবহারে আগ্রহী নয় যাত্রীরা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

দায়ী সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব ॥ ঢাকার চারপাশে নৌপথ ব্যবহারে আগ্রহী নয় যাত্রীরা

শাহীন রহমান ॥ নদীর তীরবর্তী এলাকায় বাস টার্মিনাল বা রেলস্টেশন না থাকায় যাত্রী পরিবহনে ঢাকার চারদিকে নৌপথ সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সমন্বিত পরিকল্পার অভাবই মূলত এর জন্য দায়ী। তারা বলেন, নৌপথ সুষমভাবে ব্যবহার করতে হলে নৌপথের সঙ্গে সড়ক পথের নিবিড় সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঢাকার চারদিকে নৌপথ ব্যবহারের জন্য যত ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করা হয়েছে তার একটির সঙ্গেও রাজধানীর অভ্যন্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। ফলে লোকজন সময় ও শ্রম ও নিরাপত্তা বিবেচনায় নৌপথ ব্যবহারের আগ্রহী হচ্ছে না। তাদের মতে, সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নৌপথ চালু করা গেলে শহরের ভেতরে চলাচলে যাত্রী চাপ কমে আসবে। যানজট নিরসনেও ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদের মতে, ঢাকা শহরের চারদিকে ১১০ কিলোমিটার নদী এলাকা নদীবন্দর হিসেবে বিবেচিত। বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে নদীবন্দর পরিচালিত হয়ে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একাধিকার নৌপথে যাত্রী পরিবহনের জন্য ওয়াটার বাস চালু করা হলেও তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বরাবরই যাত্রী টানতে ব্যর্থ হয়েছে এই ওয়াটার বাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সদরঘাট ব্যতীত শহরের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে নৌপথের ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। এছাড়াও নদীর তীর থেকে শহরের দূরত্ব অধিক হওয়ার কারণে যাত্রীরা সাধারণত এ পথ ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন না। আবার তৈরি করা হয়নি নদীর তীরবর্তীতে বাস টার্মিনাল বা কোন রেলস্টেশন। তারা বলছেন, সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ওয়াটার বাস সার্ভিস চারদিকে নদী ছাড়াও রামপুরা খালের মাধ্যমে শহরের অভ্যন্তরে ও টঙ্গীর মধ্যে চালু করা যায় তাহলে ঢাকার যাত্রী পরিবহনে ওয়াটার বাস ভূমিকা রাখতে পারবে। অন্যথায় ঢাকার অভ্যন্তরের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা বিকল্প পরিবহনের সম্ভাবনা স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এর আগেও ১৯৮৮ সালের বন্যার পর টঙ্গীতে নদীবন্দর স্থাপন ও ঢাকার খালগুলো উন্নয়নের প্রস্তাব পেশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় নদীগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে নদী-খাল, দখল ও ভরাট হয়ে যায়। তারা বলেন, ঢাকার চারপাশের নৌপথকে কার্যকর করতে হলে পূর্বাঞ্চলের ১৫টি খালের প্রশস্ততা গভীরতা ও নাব্য বৃদ্ধি করে এর সঙ্গে বাঁধ ও সড়ক সংযোগ করতে হবে। ঢাকার উত্তরাঞ্চলে নদীর ওপর কম উচ্চতার ব্রিজগুলো নৌপথের উপযোগী করে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে সরু তুরাগ ও বালু নদী ১শ’ মিটার প্রশস্ত করে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও সরকারের প্রস্তাবিত নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, বেরাইদ ওয়াটার বাসের রুট পরিবর্তন করে মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-রামপুরায়-টঙ্গী আন্তঃশহর ও আন্তঃজেলার মধ্যে নৌপরিবহনের মাধ্যমে শহরের অভ্যন্তরে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। টঙ্গী নদীবন্দরের সঙ্গে সুপ্রশস্ত সংযোগ সড়ক স্থাপন করে ঢাকা শহরের চারদিকে পার্কিং, ট্রানজিট সমন্বয়ে পরিকল্পিত নদীবন্দর স্থাপন করা গেলে নৌপথের কার্যকরী ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য আশুলিয়া থেকে উজানের দিকে তুরাগ নদীর নাব্য বৃদ্ধি করে কোনাবাড়ী ও কালিয়াকৈর এবং সাভার নয়ারহাট ও ঘোড়াশালে নদীবন্দর স্থাপন করে নৌপরিবহনকে ব্যবস্থাকে ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রস্থলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের মতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এই তিনটি সিটি কর্পোরেশন সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঢাকার পরিধির দক্ষিণে রয়েছে ধলেশ^রী নদী। উত্তর ও পশ্চিমে ধলেশ^রী ও বংশী নদী এবং পূর্বে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মিলে আয়তন রয়েছে ১ হাজার ৫২০ বর্গকিলেমিটার। তবে মূল ঢাকা শহরের প্রশস্ততা কম হওয়ায় ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমের নদীগুলো বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হলেও ঢাকা মহানগরের পশ্চিম ও দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা ধলেশ^রী বংশী, উত্তরে তুরাগ, টঙ্গী খাল, পূর্বে বালু এবং শীতলক্ষ্যা এই সাতটি নদীর সঙ্গে ৫০টি খাল দ্বারা নিবিড় ও আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে ঢাকার নৌপরিবহন ব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল এক সময়। নদীকেন্দ্রিক ঢাকা শহরের পত্তন নদী হলেও সময়ের ব্যবধানে অপরিকল্পিত নগরায়নে ও শহরের সম্প্রসারণে নদী ও খালকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দ্বারাও নদী ও খাল বিচ্ছিন্ন হয়ে নৌপরিবহন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. গোলাম রহমান বলেন, বুড়িগঙ্গা তীরবর্তীতে ফতুল্লা, শ্যামপুর, সদরঘাট, সোয়ারীঘাট, খোলামুড়া এবং শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তীতে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠায় এখনও নৌপরিবহন সফলতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করছে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে যানজট হ্রাসে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এখনও যথেষ্ট অবদান রাখছে। যাত্রী পরিবহনের নৌপথের গুরুত্ব বিবেচনা না করায় এবং নৌপথ বাস্তবায়নে সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চারদিকের নৌপথকে কার্যকর করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় নৌপথকে শহরের কেন্দ্রস্থলের সঙ্গে সমন্বয় করে সড়ক, রেল ও নৌপরিবহনের মধ্যে আন্তঃনিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সংযোগের মাধ্যমে দ্রুত নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহারের জন্য নৌপরিবহনকে জনপ্রিয় করা সম্ভব। বিআইডব্লিউটিএর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফয়েল আহমেদ বলেন, সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা এবং মিরপুর ব্যতীত ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় নদীপথ ব্যবহারের উপযোগী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ঢাকার খালগুলোর সঙ্গে অভ্যন্তরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং নৌপথ ব্যবহার করে যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য উন্নয়ন করা হয়নি। এই বিচ্ছিন্ন সংযোগেই নৌপথে যাত্রী পরিবহনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার জনসংখ্যা প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ লাখ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। ১ফলে প্রতিনিয়তই মানুষ কর্মসংস্থানের খোঁজে ঢাকায় আসছে। ১৯৪৭ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ২.৯৫ লাখ। স্বাধীনতার পরপর ১০ লাখ থাকলেও বর্তমানে প্রায় ২ কোটি অতিক্রম করেছে। কিন্তু এই বর্ধিত জনসংখ্যার অন্যান্য সেক্টরের পাশাপাশি পরিবহন সেক্টরের ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ফলে যাত্রী পরিবহনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত যানজট বেড়েই চলছে। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টার অথচ অতিরিক্ত এই জনসংখ্যা বিবেচনায় না নিয়ে অপকিল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে রাস্তঘাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যার বৃদ্ধির হিসাবকে বিবেচনায় নিয়ে সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথে সমন্বয়ে পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে আজকের এই অবস্থায় পড়তে হতো না। জেমস রেনেলের এক প্রতিবেদনে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল বা রাজধানী ঢাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নৌপরিবহনকে পরিবহন ব্যবস্থায় বিশে^র অন্যতম ও সুবিধাজনক অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯১৭ ও ১৯৫৯ সালে ঢাকা মহানগর মহাপরিকল্পনায় পোস্তগোলা রেল সড়ক ও নৌপরিবহন সমন্বয়ে সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনায় নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা ও বাদামতলী থেকে স্টিমার ঘাট স্থানান্তরের প্রস্তাব থাকলেও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে গত কয়েক দশকে উন্নাসিকতা ও উপেক্ষা করায় তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। শহরের কেন্দ্রস্থ ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুর স্থানান্তর করা হয়। পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী না হয়ে খাল-নদী দখল, ভরাট করে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে নাগরিক সুবিধার অভাব প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে জীবনধারাকে জটিল ও বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে মহানগরের। তারা বলছেন, অপর্যাপ্ত ও অপ্রশস্ত প্রবেশপথ এবং অপর্যাপ্ত সংযোগকারী রাস্তার অভাব ঢাকা শহরের সড়ক নেটওয়ার্কের জন্য বড় সমস্যা। ১১০ কি.মি. নদী ও নৌপথ থেকে পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগকারী খালগুলোও বন্ধ করায় শহরের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগের সম্ভাবনা গড়ে উঠছে না। শহরের অভ্যন্তর ভাগের সঙ্গে একমাত্র রামপুরা খাল, ভাটারা খাল ও গোবিন্দপুর খাল দ্বারা বালু নদীর সংযোগ রয়েছে। বকশী বাজার, মৌলভীবাজার, ইসলামপুর, নবাবপুর, চকবাজার এলাকা নদীসংলগ্ন হওয়ায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা বলছেন একইভাবে পাগলা, মিরপুর, ডেমরা অনুরূপ নৌপথকে সৃষ্টি করে বিকল্প বাজার সৃষ্টি করলে বিকল্প নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এই নদী ও নৌপথ থেকে শহরের ৫-৭ কিলোমিটার অভ্যন্তরে খালগুলো দ্বারা সংযোগ স্থাপন স্থাপিত হলে ঢাকার উত্তরাঞ্চলের নদীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চল থেকে নৌপরিহন ব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
×