ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তাৎক্ষণিক ২৫০ জনের নিরাপত্তা কর্মীদল মোতায়েনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ

আজাদ সুলায়মান ॥ এবার বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য কড়া নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বারবার তাগিদ দেয়ার পরও কেন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না- এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রীও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরিস্থিতি জরুরী সামাল দিতে শেষপর্যন্ত পুলিশকেই তাগিদ দিলেন বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য। জানা যায়, ব্রিটেন বারবার তাগিদ দেয়ার পরও সিভিল এভিয়েশন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কার্যত তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গত তিন মাস ধরে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার বিমানবন্দরের যাত্রী লাগেজ ও কার্গো পয়েন্টে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এমনকি অস্ট্রেলিয়া এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে কার্গো পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর কিছু দিন পর ব্রিটেন আবারও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার তাগিদ দেয়। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন প্রতিনিধিরা বারবার বিমানবন্দরের যাত্রী চেক-ইন, লাগেজ স্ক্যানিং ও কার্গো স্ক্যানিং সিস্টেম সরজমিনে পরিদর্শন করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রও ব্রিটেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করে- বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের কোন বিকল্প নেই। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্রিটেন ঢাকা থেকে লন্ডন বিমানের সরাসরি ফ্লাইট বন্ধেরও হুমকি দেয়। এতে কিছুটা টনক নড়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের। এতে বিমান তাৎক্ষণিক কিছু জনবল নিয়োগ করে কার্গো এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। এরপর ব্রিটেন আবারও কার্গো পরিদর্শন করে বিমানের নেয়া পদক্ষেপের সন্তোষ প্রকাশ করলেও সিভিল এভিয়েশনকে আরও তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেয়। এ অবস্থায় গত ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে জরুরী তলব করা হয় সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল সানাউল হকসহ বিমানের কর্মকর্তাদের। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের উপস্থিতিতে বিমানবন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। বৈঠকে অস্ট্রেলিয়ার কার্গো নেয়া বন্ধ করে দেয়া ও ব্রিটেনের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আশু করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে জরুরীভিত্তিতে জনবল চাইলে তাৎক্ষণিক ২৫০ জনের নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে বিমানবাহিনী, পুলিশ ও আনসারের সমন্বয়ে একটি বিশেষ বাহিনী (কম্পোজিট ফোর্স) অবিলম্বে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম দফায় ১শ’ জনকে নিয়োগের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তারা আগামী সপ্তাহে বিমানবন্দরে মূল নিরাপত্তার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে দায়িত্বে যোগ দেবেন। এ বিষয়ে একটি সূত্র জানায়, নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দিকনির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও সিভিল এভিয়েশন তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সিভিল এভিয়েশনের ব্যর্থতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরেও আনা হয়। এ অবস্থায় বুধবার পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে ব্রিটেনের উদ্বেগের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি কম্পোজিট ইউনিটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান ও চাহিদা অনুযায়ী অতিদ্রুত বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। বৈঠকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা অতি দ্রুত দৃশ্যমানও করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণ করেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেই আমাদের চলাচলটা অব্যাহত থাকবে। আমরা যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই, সেখানে একটা কম্পোজিট ইউনিট করতেই হবে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শুধু বাড়ানো নয়, এটাকে দৃশ্যমান করতে হবে। সেটা যদি না করি আমাদের বিমান কিন্তু লন্ডনে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকায় কিন্তু আমরা এখনও পাঠাতে পারছি না একটাই কারণে, এখনও আমরা আন্তর্জাতিকভাবে এ গ্রেডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে পারিনি। এ সময় বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদ সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিমানকে আমরা শক্তিশালী করেছি। ছয়খানা এসেছে, আরও চারখানা উড়োজাহাজ আসবে। সারাবিশ্বে আমাদের বিমান যাক সেটা আমরা চাই। এদিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের একজন পরিচালক চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের জোর তাগিদ ও কড়া নির্দেশ থাকার পরও তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। মাত্র ২৫০ জন জনবল মোতায়েনের অনুমোদন থাকলেও এখনও এক শ’ জনেরই প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি। আরও আড়াই শ’ জনবলের বিশেষ বাহিনী নামালেই পরিস্থিতি দৃশ্যত হয়ত চোখে পড়বে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারণ সমস্যার মূলে তো শুধু এই আড়াই শ’ নিরাপত্তাকর্মীর অভাব নয়। বুঝতে হবে এভিয়েশন সিকিউরিটি কী আর সিভিল এভিয়েশন করছে কী। সিভিল এভিয়েশন এখনও সমস্যার মূলে আঘাত করতে পারছে না। তিনি এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে বলেন, বারবার সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্রিটেন কড়া তাগিদ দেয়ায় হঠাৎ শাহজালাল বিমানবন্দরে টিকেট কেটে সাধারণ দর্শকদের ভেতরে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়। আগে লোকজন কনকর্স হলে ঢুকে যেভাবে সুশৃঙ্খলভাবে অপেক্ষা করত এখন সেই লোকেরাই বাহিরে মেলার মতো উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় থাকছে। এ ধরনের লোকজনের জটলার মধ্য থেকেই নাশকতার আশঙ্কা থাকে বেশি। এ সম্পর্কে বিমানবন্দরের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, একদিকে লোকজনকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বাঁশি ফুকিয়ে দেখানো হচ্ছে বিমানবন্দরের খুব কড়াকড়ি চলছে; আরেকদিকে যাত্রী হ্যান্ডলাগেজে গুলিভর্তি করে নির্বিঘেœ চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর থেকে সেই যাত্রীকে আটক করে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়। এটাকেই বলে নিরাপত্তার নামে বজ্রআঁটুনি ফস্কা গেরো। জানতে চাইলে একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, দুনিয়াজুড়ে এভিয়েশন সিকিউরিটি বলতে বুঝায় প্রধানত যাত্রী, লাগেজ ও কার্গো পয়েন্টে কী ধরনের নিরাপত্তা পদ্ধতি। এই তিনটে ক্ষেত্রে শাহজালালের নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক মানের কিনা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মূলত সেটাই দেখতে চায়। বিশ্বমানের এভিয়েশন সিকিউরিটি মানেই হচ্ছে যাত্রী যেখান থেকে চেক-ইন করে তার সঙ্গে কোন নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন দ্রব্যাদি যেমন- কাঁচি, ছুরি, লাইটার, বিস্ফোরক দ্রব্য, গোলাবারুদ নিচ্ছে কিনা, লাগেজে নিষিদ্ধ আইটেম ঢুকছে কিনা, কার্গো দিয়ে শতভাগ নিñিদ্র পদ্বতিতে মাল পরীক্ষা করা হচ্ছে কিনা- সেটা নিশ্চিত করা। কিন্তু শাহজালালের লাগেজ স্ক্যানিং ও কার্গোতে এখনও বড় ধরনের ত্রুটি রয়ে গেছে। যে কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মাসুদ আহমদ তালুকদার ব্যাগভর্তি গুলি নিয়ে নির্বিঘেœ পার পেয়ে যাচ্ছে। ওই ঘটনার তদন্তে দেখা যায়, যিনি স্ক্যান অপারেটর তার গাফিলতি ও উদাসীনতার সুগোগেই গুলি চলে গেলেও তিনি তা ধরতে পারেননি। এ সম্পর্কে আইকাও রুলস হচ্ছে- স্ক্যানিংয়ে একজন অপারেটরকে কিছুতেই দুই ঘণ্টার বেশি কাজ করানো ঠিক নয়। এতে তার মনোযোগ নষ্ট হয়। অথচ শাহজালালে একজন একজন স্ক্যানিং অপারেটর কমপক্ষে আট থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করে থাকে। এমনটি ঘটছে হয় জনবলের অভাবে না হয় ওভারটাইমের লোভে। এছাড়া স্ক্যানিং মেশিনের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে একজন কাস্টমস কর্তা বলেন, কার্গোতে সমস্যার পাহাড় থাকলেও সিভিল এভিয়েশন রহস্যজনক কারণে নীরব ভূূমিকা পালন করছে। আমদানি কার্গো শাখার হাজার হাজার লাগেজ খোলা আকাশের নিচে রানওয়ে ও বে-তে পড়ে থাকলেও সেগুলো সরানোর কোন উদ্যোগ নেই। ব্রিটেন বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও এখনও আমদানি কার্গোর জন্য ওয়ার হাউজ নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারছে না। অথচ কার্গো শাখা সেমি অটোমেশানের কাজ এখনও শেষ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মাল রাখার জন্য সবচেয়ে জরুরী পেলেট তৈরির কাজটা ফেলে রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয় চাপ দিলেও সিভিল এভিয়েশন তা বাস্তবায়ন করছে না। অথচ এ কাজটা মাত্র পনেরো দিনে সম্ভব বলে ভুক্তভোগীরা জানান। তারপর কার্গো শাখায় বিমানের জনবলের প্রচণ্ড অভাব থাকলেও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বিমান পর্ষদের বড় বড় প-িতরা সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখায় কার্গোতে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় লোডার নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। এতে কার্গোর রফতানি শাখায় কাজকর্ম গতিশীল করা যাচ্ছে না। এ সম্পর্কে একজন বিমান কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, একে তো প্রয়োজনীয় লোডার নিয়োগ না দেয়াটা অদূরদর্শিতার পরিচায়ক, তেমনি লোডারের পরিবর্তে আনসার নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত বড় ধরনের মুর্খামি। বিমান পর্ষদ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেয় কার্গোতে লোডারের কাজ করানো হবে আনসার দিয়ে। কিন্তু কার্গো শাখায় লোডারের কাজ আনসার করাতে গেলে উল্টো বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিমানের কর্তারা। মূলত এসব কারণে অস্ট্রেলিয়া ঢাকা থেকে আকাশ পথে কার্গো নেয়া বন্ধ করে দেয়। আর ব্রিটেন এখন হুমকি দিচ্ছে বিমানের লন্ডন ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ার। এমন এক পরিস্থিতিতে পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় পরিস্থিতি কতটা উন্নতি ঘটে- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×