ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাবাডিতে দুই ভাইয়ের যুগলবন্দী

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

কাবাডিতে দুই ভাইয়ের যুগলবন্দী

পশ্চিম আকাশে সূর্য সবে হেলে পড়তে শুরু করেছে। মাঘের শীতে অবশ্য সেই সূর্যে কোন উত্তাপ নেই। বরং মিষ্টি-মোলায়েম আভা ছড়িয়ে রেখেছে চারদিকে। তার উপর এক ঝাঁক তরুণীদের মেলা বসেছে বলেই হয়ত সুলতানা কামল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের বাতাসে অন্যরকম সুর খেলা করছে। মাঠের মাঝখানটায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সেই তরুণীদের একটা দল। যারা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা কাবাডি দলের সদস্য। এসএ গেমস উপলক্ষে প্রতিদিন এখানেই নিজেদের তৈরি করছেন তারা। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন জিয়াউর রহমান। হয়ত কিছু একটা ভাবছেন দলটাকে নিয়ে। তিনি যে এই দলটির সহকারী কোচ। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তার সঙ্গে যুক্ত হলেন আরেক ভদ্র লোক। নাম আব্দুল জলিল, দলটির প্রধান কোচ। এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনুশীলন শুরু নিয়ে, ‘জিয়া, কিভাবে শুরু করবি আজ?’ এই দুই কোচের অধীনে যুদ্ধ ময়দানের (এসএ গেমস) জন্য শাণিত হতে থাকা মহিলা কাবাডি দলের প্রতিদিনের প্রস্তুতির শুরুটা হয় এভাবেই। এই আব্দুল জলিল এবং জিয়াউর রহমান আপন দুই ভাই, বাংলাদেশ কাবাডির দুই কিংবদন্তি। যাদের গল্প অনেকটাই রূপকথার মতো। আব্দুল জলিল কিংবা জিয়াউর রহমান দুজনের এই গল্প আলাদা আলাদা ভাবেই শুরু হতে পারে। কারণ খেলোয়াড় হিসেবে দুজন ছিলেন দুই সময়ের রাজা। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে যে গল্পটা অন্য মোড় নেয়। সময়টা ১৯৯৫, মাদ্রাজ সাফ গেমস। বড় ভাই আব্দুল জলিল তখন জাতীয় দলের কোচ এবং অধিনায়ক। যিনি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে চলেছেন নিজের শেষ টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টেই জাতীয় দলে প্রথম আবির্ভাব হলো ছোট ভাই জিয়াউর রহমানের। খেলোয়াড় হিসেবে এক ভাইয়ের গল্প শেষ আর অন্য জনের শুরু! বড় ভাইকে আদর্শ মেনে কাবাডিতে আসা জিয়া এরপর ছাড়িয়ে গেলেন অগ্রজের সব কৃতিত্বকে। দেশ সেরাত বটেই জায়গা করে নিলেন বিশ্ব সেরাদের কাতারে। ২০০৭ বিশ্বকাপ কাবাডিতে সেরা রেইডারের পুরস্কার জেতা জিয়া ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা খেলে যখন অবসর নিলেন, ততদিনে বড় ভাই পেয়ে গেছেন দেশের সেরা কোচের মর্যাদা। একই সময়ে জিয়া অবদান রেখেছেন খেলোয়াড় হিসেবে, আর আব্দুল জলিল কোচ হিসেবে। বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমসে সাফল্য সহ দুই ভাইয়ের হাত ধরে কত পদক জমা পড়েছে কাবাডির ঘরে। তবে অনেকটা ইনজুরির কাছে হার মেনেই ২০১৪ সালে এশিয়ান গেমসের পরই অবসরে চলে যেতে হয় জিয়াকে। তাহলে কি এক ভাইয়ের গল্পে দাড়ি পড়ল এবার? না, বরং আরেকটা অধ্যায়ের শুরু হলো এখানে। আজীবন আদর্শ মেনেছেন বড় ভাইকে। তাই জিয়াউর রহমানও নিজেকে জড়িয়ে নিলেন কোচিংয়ের সঙ্গে। চমক এখানেও। প্রথমবারই কোচ হিসেবে নিজের সংস্থা বিজেবিকে জাতীয় কাবাডিতে চ্যাম্পিয়ন করলেন। আর তার পুরস্কার হিসেবেই যেন এবারের এসএ গেমসের মহিলা কাবাডি দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব দেয়া হলো তাকে। তাতেই দুই ভাইয়ের যুগলবন্দীর গল্প হয়ে গেল আরও মহিমান্বিতর। একভাই প্রধান কোচ আর অন্যজন সরকারী কোচ। ক’দিন পরেই এসএ গেমসে বাংলাদেশের মহিলা দল যখন কোর্টে নামবে, তখন কোর্টের বাইরে এই দুই ভাইয়ের মনে যে অন্য রোমাঞ্চ খেলা করবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় কাবাডি মিশে ছিল দুজনের রক্তে। দিনাজপুরে তাদের বাবা-চাচারা ছিলেন নাম করা কাবাডি খেলোয়াড়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট জিয়ার অবশ্য তেমন কিছু মনে নেই। তবে আব্দুল জলিল জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছেন বাবা-চাচাদের দাপট। বাকিটা শোনা যাক তার মুখ থেকেই, ‘পারিবারিকভাবেই আমরা কাবাডির সঙ্গে জড়িত। যে কারণে রক্তের টান ছিল এবং সেই টানের কারণেই কাবাডিতে এতটা নিবেদিত হতে পারছি। ছোট সময় দেখতাম বাবা-চাচারা খুবই জাঁকজমকভাবে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে কাবাডির আয়োজন করতেন। হায়ারে খেলতে যেতেন দূর-দূরান্তে। সেখান থেকেই কাবাডির প্রতি আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল জীবন থেকেই হায়ারে খেলতাম। রক্তের টানে কাবাডিতে আসতে আসতেই খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। জিয়াও সেই চেষ্টাটাই করে গেছে।’ ১৯৮৮ সালে প্রথম জাতীয় দলে খেলেন আব্দুল জলিল। এরপর টানা খেলেছেন ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ এশিয়াডে রৌপ্য জয়ী কাবাডি দলের অন্যতম সদস্য তিনি। ১৯৯৫ সালে যে সাফ গেমসের মাধ্যমে তার খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি, সেই টুর্নামেন্টে অবশ্য তার কেবল কোচ হিসেবেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরে ছিলেন অধিনায়ক ও কোচ দুই ভূমিকাতেই এবং রৌপ্যও আসে সেবার। খেলোয়াড়ি জীবনের মতো কোচ হিসেবেও এশিয়াডে রৌপ্য জিতিয়েছেন দলকে। পদক আছে কাবাডি বিশ্বকাপে, সাফ গেমসে আছে একাধিক রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ। অবসরের পরপরই এনএসসিতে যোগ দেন কোচ হিসেবে। সার্ভিসেস টিমগুলোতে কাবাডির চর্চা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব পূর্ণ অবদান রাখেন তখন। ২০০৪ সালে এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন তাকে কোচ হিসেবে মনোনীত করে। তবে অদৃশ্য কোন কারণে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেলেও এই মনোনীত হওয়াকেই বড় স্বীকৃতি বলে মানেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত করে এই কৃতিমানকে। অপর দিকে ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের দেখাদেখি জিয়াও নিজেকে তৈরি করে ফেলেছিলেন। এমন কি তার জাতীয় দলে ওঠে আসার ক্ষেত্রে বড় ভাইকেও তেমন কষ্ট করতে হয়নি। দিনাজপুরের জেলা যুব কাবাডি দলের হয়ে পারফর্ম করেই চোখে পড়ে গিয়েছিলেন জাতীয় পর্যায়ের কোচ-কর্মকর্তাদের। সেখান থেকেই ১৯৯৫ সালে সুযোগ পান জাতীয় দলে। এরপর কেবল বাংলাদেশ কাবাডি দেখেছে খেলোয়াড় জিয়ার রাজত্ব। এশিয়ান গেমস, এশিয়ান কাবাডি, কাবাডি বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে একের পর এক পদক এসেছে জিয়ার হাত ধরে। কোর্টের বাইরে জাতীয় দলের কোচ হিসেবেই খেলোয়াড় জিয়ার এই রাজত্ব দেখেছেন আব্দুল জলিল। তিনি বললেন জিয়ার সেই বীরত্বের কথা, ‘প্রতিপক্ষরা তাকে অনেক ভয় পেত। আমি যখন জাতীয় দলে কোচ, সে তখন অধিনায়ক। খেলার সময় ও বলত, আমি রেডিংয়ে যে করেই হোক পয়েন্ট এনে দেব। ডিফেন্সটা আপনি দেখেন অন্যদের মাধ্যমে। এই যে সাহসিকতা এটা আজ পর্যন্ত কোন খেলোয়াড়ের কাছ থেকেই পাওয়া যায়নি। জিয়া তার সেই কথাকে কাজে প্রমাণ করতে পারত। পরত বলেই তার অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপে এবং এশিয়াডে আমরা পদক আনতে পেরেছি।’ জিয়া সম্পর্কে বড় ভাই জলিল কিংবা কোচ জলিলের সার্বিক মূল্যায়ন এ রকম, ‘যুগে যুগে অনেক তারকাই আসবে। কিন্তু জিয়া তার স্বমহিয়াম এবং পারফর্মেন্সে সবার থেকে এগিয়েই থাকবে। কারণ সেরা সব সময় একজনই হয়। জিয়া সেই একজন। আমি তো বলি কাবডিতে জিয়া শচীন টেন্ডুলকর। কারণ, কাবাডির মতো খেলায় একজন খেলোয়াড়কে সাত-আট বছরের বেশি খেলতে দেখা যায় না। সেখানে জিয়া ১৯৯৫-২০১৪ দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর টানা জাতীয় দলে খেলে গেছে। এখানেই সে সবার থেকে অনন্য এবং এটাই জিয়ার কৃতিত্ব। ১৯৯২ সালে জাতীয় যুব কাবাডি দিয়ে যখন তার ক্যারিয়ার শুরু সেই হিসেবে সময়টা আরও দীর্ঘ।’ জিয়াউর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে লাভ করেন ২০০৫ সালে। তবে কি এই দুজনের খেলোয়াড়ি জীবন শুধু সাফল্য দিয়েই আঁকা? ট্রাজেডি নেই? ২০১০ সালের এশিয়ান গেমস তাদের সেই ট্র্যাজেডির বড় নাম। ভুতুড়ে হলেও সত্যি এই ট্র্যাজেডিতেও যুগলবন্দী! কারণ সেবার দুই ভাইয়ের কেউই ছিলেন না কাবাডি দলের সঙ্গে। ফিটনেসের অজুহাতে দলে রাখা হয়নি জিয়াকে, আর অজানা কারণে কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় আব্দুল জলিলকে। জহুরির দৃষ্টিতে দেখলে তখন থেকেই আন্তর্জাতিক কাবাডিতে বাংলাদেশের পতনের শুরু। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। দুজনের গল্পে ফিরলে, সেই সময়ের পর খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার ফিরেন দু’জন। ২০১১ সালে প্রথম সাউথ এশিয়ান বিচ গেমস দিয়ে আবারও জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে ফিরেন জলিল। পদকও আসে সেই আসরে। আর জিয়াও এরপর অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। খেলেছেন ভারতের প্রো-কাবাডিতেও। তবে ২০১০ সালের ইনজুরির পর নিজের স্বাভাবিক ছন্দে আর ফিরতে পারেননি কখনও। ২০১৪ এশিয়ান গেমস খেলেই তাই খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি টানেন। কোচ হিসেবে দুই ভাই এক সঙ্গে কাজ করছেন এখন। তাই তাদের অনুভূতির কথা জানতে চাওয়া জিয়ার কাছে। ‘কোচ হিসেবে দুই ভাই এক সঙ্গে এই প্রথম কাজ করছি। আগেও এক সঙ্গে কাজ করেছি তবে তা আমার খেলোয়াড়ি জীবনে। আর এখন কোচ হিসেবে। খুব ভাল লাগতেছে। কোচিং জগতে বড় ভাইয়ের বিশাল ক্যারিয়ার। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সেরা কোচও তিনি। তার সঙ্গে কাজ করতে পারার অনুভূতি তাই অন্য রকম। খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। কোচিং লাইনেও অনেক বিষয় আছে যা তার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছি।’ ইতোমধ্যে কোচ জিয়াকে তো দেখেছেন ভাল করেই। তা কোচ হিসেবে জিয়া সম্পর্কে আব্দুল জলিলের মূল্যায়ন কি? জলিল বলেন, ‘কোচ হিসেবে তাকে যত দূর দেখছি তার টেকনিক্যাল দিক অনেক ভাল। আমার অনেক কিছুই সে সহজাতভাবেই পেয়েছে এবং তার নিজেরও আলাদা কিছু টেকনিক আছে। কোচিং আদর্শিক একটি জগত। খেলোয়াড় হিসেবে নিজে খেলে সাফল্য দিতে হয় আর কোচিংয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা হলো কাওকে শিখিয়ে সাফল্য দেয়া। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে হয়ত তার কিছু সময় লাগবে। তবে আমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সামর্থ জিয়ার আছে।’ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জিয়া বলেন, ‘আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যে বোঝাপড়া সেটা দিয়ে দেশকে গৌবর বয়ে এনে দেয়ার স্বপ্ন দেখি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইব আমার ক্যারিয়ারের এই প্রথম মিশনে যেন দেশ ভাল কিছু অর্জন করতে পারে।’ আর জলিলের চাওয়া, ‘কাবাডি নিয়ে এই জীবনের শৈশব, কৈশর, যৌবন সব শেষ করেছি। বাকি যে জীবন পরে আছে এই দিনগুলোতেও একইভাবে কাজ করে যেতে চাই। জানি না এই অর্জনগুলো ভবিষ্যতে মানুষ কিভাবে দেখবে। তবে আমি চাইব ভবিষ্যতে মানুষ যেন কাবাডি নিয়ে ভাবে।’ দুই ভাইয়ের যুগলবন্দীর এই গল্পে তাদের আরেক ভাই মোহাম্মদ জালাল মিয়া আড়ালেই পড়ে গেলেন। তবে সাইক্লিংয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এই ক্রীড়াবিদ কাবাডিতেও বড় নাম। সব মিলিয়ে জলিল-জালাল-জিয়াদের গল্প অনন্যই।
×