ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবসরে শিবনারায়ণ চন্দরপল

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

অবসরে শিবনারায়ণ চন্দরপল

একের পর এক সিরিজে দল ভরাডুবির মুখে পড়লেও নির্বাচকরা ফিরে তাকাননি। ইতোমধ্যে বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, তাই বাকিটা বুঝে নিলেন শিবনারায়ণ চন্দরপল। সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন ক্ল্যাসিক্যাল উইলোবাজ। সিদ্ধান্তটা আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম সফল এই ক্রিকেটার। বিষয়টা হয়ত অনুমিত ছিল। কারণ ২০১৫ সালের মার্চের পর আর দলের হয়ে খেলার সুযোগ মেলেনি ৪১ বছর বয়সী বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। অফ ফর্ম, কানাঘুষা, চাপ অনেক কিছু ছিল। কিন্তু এতদিন মুখ খোলেননি। হয়ত আরও একবার গর্বের সাদা জার্সি গায়ে চড়ানোর আশায় ছিলেন। হয়ত মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট থাকবে। কারণ কখনই তিনি এভাবে মাঠের বাইরে থেকে বিদায় নিতে চাননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের (ডব্লিউআইসিবি) বরাবর পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় অবসরের বিষয়টি জানিয়ে দেন চন্দরপল। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের হয়ে আর ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে চাই না’- মেইলে এমনটাই লেখেন তিনি। বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন ডব্লিউআইসিবি প্রেসিডেন্ট ডেভ ক্যামেরন। ফিরতি মেইলে বোর্ডের পক্ষ থেকে তাকে বিদায়ী সম্ভাষণ জানানো হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘দেশের হয়ে চন্দরপলের অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যাপী সে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আমরা তার অবসরপরবর্তী সুন্দর জীবন কামনা করছি।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইতিহাসের অন্যতমসেরা ব্যাটসম্যান চন্দরপল। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত অর্জনের খাতায় ১১ হাজারের বেশি রান। আর মাত্র ৮৭ রান করতে পারলেই ব্রায়ান লারাকে পেরিয়ে টেস্টে ক্যারিবীয়দের হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক হয়ে যেতেন। কিন্তু সেই সুযোগের অপেক্ষায় আর থাকলেন না ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটিংয়ের প্রতিমূর্ত চন্দরপল। গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা নিজের সর্বশেষ সিরিজে তিন টেস্টের ৬ ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ৯২ রান! মার্চে ওই বাজে ফর্মের পর যে বাদ পড়েন, পরে আর তাকে বিবেচনায় নেননি নির্বাচকরা। নির্বাচক কমিটির প্রধান ক্লাইভ লয়েড তো সরাসরিই বলে দিয়েছিলেন, চন্দরপলকে নিয়ে আর ভাবছেন না তারা। নতুনদের নিয়েই ভবিষ্যতের দল গড়তে চান। চন্দরপল অবশ্য তারপরেও বলেছিলেন, দলে ফেরার সব চেষ্টাই করে যাবেন। এত দিনে হয়ত বুঝতে পেরেছেন, ফেরার সেই পথটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ডব্লিউআইসিবিকে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় অবসরের কথাটি জানিয়ে দিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৯৪ সালের মার্চে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া এ গায়ানিজ ব্যাটসম্যান তিন ধরনের ক্রিকেটেই ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম নির্ভরতার প্রতীক। ১৬৪ টেস্ট খেলে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩০ সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ ২০৩। ৫১.৩৭ গড়ে রান করেছেন ১১ হাজার ৮৬৭। একই বছর রঙিন পোশাকে ওয়ানডে অভিষেক। ২৬৮ ম্যাচে ৪১.৬০ গড়ে মোট সংগ্রহ ৮ হাজার ৭৭৮ রান, ১১ সেঞ্চুরি। ২০০৬-১০ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি২০ খেলেছেন ২২টি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লেগস্পিন বল করতেন। ব্যাটিংয়ে সফল হওয়ায় পরে বোলিংয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে তার উইকেট সংখ্যা ২৩। অপূর্ব ব্যাটিংশৈলীর জন্য টেস্ট ক্রিকেটই তাকে বেশিদিন মনে রাখবে। ক্যারিয়ারের ৩০ সেঞ্চুরির ২টিকে ডাবল সেঞ্চুরিতে রূপ দিয়েছেন। দু’বারই অপরাজিত ছিলেন ২০৩ রানে। জর্জটাউনে ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এবং ২০১২ সালে ঢাকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেন জীবনের সেরা দুটি ইনিংস। দেড় শ’ পেরিয়েছেন তিনবার। তবে চন্দরপলের সেরা ইনিংস বললে উঠে আসবে ১৯৯৬ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭১, ১৯৯৭Ñএ ব্রিজটাউটে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৭, একই ভেন্যুতে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০০, সেন্ট জোন্সে ওই বছরই অসিদের বিপক্ষে ১০৪ এবং কিংস্টনে ২০০৮-এ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১৮; এই ইনিংসগুলো খেলেছিলেন কঠিন সব মুহূর্তে, বাঁচিয়ে ছিলেন দলকে। আধুনিক ক্রিকেটে সবচেয়ে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শচীন টেন্ডুলকরের। ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে দীর্ঘ ২৪ বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ভারতের ‘ক্রিকেট ঈশ্বর।’ তার পরই বলতে হবে চন্দরপলের কথা। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স ২২ বছর। অবসরের পর চন্দরপলকে তাই শুভকামনা জানাতে ভোলেননি টেন্ডুলকর। টুইটারে এই ব্যাটিং কিংবদন্তি লিখেছেন, ‘দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের জন্য শিবকে অভিনন্দন। উইকেটে টিকে থেকে রান সংগ্রহের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তোমার। শুভকামনা রইল।’ শচীনের দীর্ঘদিনের সতীর্থ ভারতের স্পিন কিংবদন্তি অনিল কুম্বলেও টুইটারের মাধ্যমে শুভকামনা জানিয়েছেন চন্দরপলকে, ‘দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের জন্য চন্দরপলকে জানাই শুভেচ্ছা। ভবিষ্যতের জন্য তোমার প্রতি শুভকামনা। সত্যিই এক অসাধারণ খেলোয়াড়।’ এ্যাডাম গিলক্রিস্টও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চন্দরপলের অবসরের সিদ্ধান্ত শুনে। অনেকের মতে সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের কাণ্ঠে অবশ্য আক্ষেপই বেশি ঝরেছে, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অনাদৃত নায়ক।’ জিম্বাবুইয়ের সাবেক ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেইলরের প্রতিক্রিয়াও অনেকটা একই রকম, ‘এমন একজন কিংবদন্তিকে স্যালুট জানাচ্ছি যিনি কখনই তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি।’ ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান ভিভিএস লক্ষণ অবশ্য কিছুটা মজা করেছেন, ‘এক ব্যতিক্রমী ক্যারিয়ারের জন্য চন্দরপলকে অভিনন্দন। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে বিশাল সেঞ্চুরি করার ভীষণ খিদে ছিল তার মধ্যে।’ সবচেয়ে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া জেসন হোল্ডারের। বর্তমান উইন্ডিজ অধিনায়ক বলেন, ‘আপনার সঙ্গে মাঠে নামাই ছিল দারুণ সম্মানজনক বিষয়। মিডঅফে দাঁড়িয়ে দলের যে কোন বোলারের কোচের ভূমিকা পালন করতেন আপনি। একজন ব্যাটসম্যানের কীভাবে ক্রিজে থিতু হওয়া উচিত সে কথাও আমাদের বলতেন। যা আমাদের মনে একেবারে গেঁথে যেত। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে নয়, বিশ্ব ক্রিকেটে দুর্দান্ত অবদান রাখায় আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের এই অঞ্চলে আপনি ছিলেন একজন দূতের মতো। আপনাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।’
×