ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উপসাগরে যুদ্ধ শুরুর ২৫

বছর রাসায়নিক অস্ত্র থেকে যে কারণে বিরত সাদ্দাম

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

বছর রাসায়নিক অস্ত্র থেকে যে কারণে বিরত সাদ্দাম

মু. আব্দুল্লাহ আলআমিন উপসাগরে যুদ্ধ শুরুর ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে গত সপ্তাহে। এটি ছিল প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ যা ছিল সাদ্দামের কুয়েত দখলের জের। শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি। এরপর সাদ্দামের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এমন অজুহাত দেখিয়ে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি যুদ্ধ শুরু করে। ওই যুদ্ধে সাদ্দাম ক্ষমতাচ্যুত ও ‘বিচারে’ তার প্রাণদ- কার্যকর করা হয়। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধটি চলেছিল ৪২ দিন ধরে। একদিকে ইরাক একা অপরদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ২৮টি দেশের জোট। দ্বিতীয় যুদ্ধটি চলে ২১ দিন কিন্তু তার জের এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইরাক। এসব যুদ্ধের অনেক আগে থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে প্রপাগা-া চলছিল। তিনি একজন নিষ্ঠুর শাসক, নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন রাসায়নিক অস্ত্র, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাসায়নিক অস্ত্র ছিল সাদ্দামের বিরুদ্ধে সমালোচনার একটি বড় ইস্যু। ইরনের সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধে তিনি এই অস্ত্র ইচ্ছে মতো ব্যবহার করেন। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালের মার্চে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চালানো আনফাল অপারেশনে। মজার কথা হলো উপসাগরীয় যুদ্ধের সঙ্কটাপন্ন সময়ে সাদ্দাম হোসেন এটি ব্যবহার করেছেন এ রকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদ যেটি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। প্রশ্ন হলো সাদ্দাম কেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোটের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেননি। যুদ্ধ শুরুর ২৫ বছর পর এসেও এর কোন জবাব মেলেনি। অনেকে বলেছেন, আমেরিকা যেন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সাদ্দাম রাসায়নিক অস্ত্র মজুত করেছিলেন। সাদ্দাম সরকারের অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকেও এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে রাসায়নিক অস্ত্রটি ছিল সাদ্দামের তুরুপের তাস। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল যদি ইরাকের বিরুদ্ধে রাসায়নিক, জৈব অথবা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করেই বসে তার জবাব হিসেবে এই অস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দামের এই কৌশল কাজও দিয়েছিল। ইরাকের দৃষ্টিতে তারাই ওই যুদ্ধে জিতেছিল। কারণ কুয়েত থেকে সরে আসার পর মার্কিন বহুজাতিক বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরুর সাহস পায়নি। সিরিয়াকে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থাটিও অনেকটা সে রকম মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আসাদ সরকারের রাসায়নিক নিরস্ত্রীকরণের কাজটি পরিকল্পনা মতো না এগোলে এই অস্ত্র নিয়ে ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকেই উপসাগরে রণ দামামা বেজে ওঠার সব লক্ষণ পরিষ্কার হয়ে যায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (সিনিয়র বুশ) শেষবারের মতো দর কষাকষি করতে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারকে জেনিভায় পাঠিয়েছিলেন ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারেক আজিজের সঙ্গে দেখা করার জন্য। বেকার আজিজের কাছে সাদ্দামের উদ্দেশে লেখা বুশের একটি চিঠি পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ইরাকের রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্রের অধিকারী হওয়া এবং কুয়েতের তেলক্ষেত্রগুলোর ক্ষতিসাধন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না... সংযত না হলে আপনি ও আপনার দেশকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে।’ মৌখিকভাবেও বেকার আজিজকে হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের উদ্দেশ্য কেবল কুয়েত মুক্ত করা নয়, প্রয়োজনে ইরাকেও শাসকের পরিবর্তন ঘটানো। আজিজ ওই চিঠি সাদ্দামের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কুয়েতে অভিযান চালানোর এক মাস আগে সাদ্দাম এক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্রের যে মজুত আছে তা ইসরাইলের পরমাণু হুমকি মোকাবেলায় যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা ইসরাইল যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করেই বসে তবে তার উপযুক্ত জবাব হবে এসব অস্ত্র।’ স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, সাদ্দাম তার রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্র ভা-ারের কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। সাদ্দামের প্রশাসন এ নিয়ে এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল যে, অস্ত্রগুলো আসলে যতটা না শক্তিশালী তারচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক বলে ধারণা তৈরি হয়েছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধের কিছু শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। প্রথমত, কর্তৃত্ববাদী শাসকরা সাধারণত নিজেদের কাছাকাছি অধঃস্তনদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হন। এই অধঃস্তনদের প্রধান লক্ষ্য থাকে বসকে সন্তুষ্ট রাখা। তাই তাদের দেয়া তথ্য যথেষ্ট বাস্তবসম্মত হয় না, এর ওপর নির্ভর করে কোন দেশে অভিযান চালানো বা যুদ্ধে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিলে কেবল মাশুল গুনতে হয়। সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ক্ষমতার প্রকৃত চিত্রটি তার কাছে তুলে ধরেনি। বরং নিজেদের নিজেদের শক্তিসামর্থ্য বাড়িয়ে দেখিয়েছে। দ্বিতীয়ত সাদ্দামের মতো সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদও রাসায়নিক অস্ত্রকে শেষ রক্ষাকবচ বিবেচনা করতে পারেন। যদিও আসাদ জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র নির্মূলকরণ গ্রুপটিকে সহযোগিতা করছেন কিন্তু মার্র্কিন গোয়েন্দাদের আশঙ্কা আসাদ এই অস্ত্রের একটি অংশ গোপনে মজুত করে রেখে দিতে পারেন। সর্বশেষ যে কাজটি করার ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে পোষণ করা হচ্ছে না সেই হুমকিটি বার বার দিতে থাকলে তা অকার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। সাদ্দাম যেমন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন কিন্তু সেটি করার ইচ্ছা তার ছিল না তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার বলছে আসাদকে সরে যেতে হবে কিন্তু এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে রাজি নয় মাার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। ফলে সিরিয়ার যুদ্ধ ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে গড়াচ্ছে।
×