ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীনের সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

চীনের সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার

চীনের সশস্ত্র বাহিনীর এক বড় ধরনের সংস্কার শুরু হয়েছে। আর সেই সংস্কারটা হচ্ছে দেশটির অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুঙের নীতির আদলে। ৮৫ বছর আগে মাও সেতুঙ ঘোষণা করেছিলেন যে গণমুক্তি ফৌজ বা পিএলএ দেশ বা সরকারের সশস্ত্রবাহিনী নয়। এই বাহিনী হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্র্টির। ২০১৪ সালের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংও একই কথার প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, চীনের সশস্ত্রবাহিনী এখনও কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনী, এই বাহিনীকে তার বিপ্লবী ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে এবং পার্টির প্রতি সর্বাত্মক আনুগত্য বজায় রাখতে হবে। প্রেসিডেন্ট জিনের কথাগুলো ছিল বিএলএর অভ্যন্তরে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারের ভূমিকামাত্র। সেই সংস্কার গত ডিসেম্বর থেকে সূচিত হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি সামরিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হচ্ছে। সংস্কারের লক্ষ্য দ্বিবিধ। প্রথমত ২৩ লাখ সদস্যের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর জি’র কর্র্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা এবং দ্বিতীয়ত এই বাহিনীকে অধিকতর কার্যকর একটি লড়াকু বাহিনীতে পরিণত করা। এই লক্ষ্য দুটো অর্জনের পথে কিছু অন্তরায় আছে। যেমন সর্বোচ্চ স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কমান্ড কাঠামোর অস্তিত্ব। এই দুই অন্তরায়ের কারণে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে মার খেয়ে আসছিল। সংস্কার শুরু হতে এত সময় লাগার কারণও এই অন্তরায় যা জিন দূর করতে চাইছেন। পিএলএ বেশ আগে থেকেই স্বীকার করে এসেছে যে, আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে। এই বাহিনীর হাতে হয়ত প্রচুর নতুন অস্ত্রসম্ভার আছে। যেমন এর দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী তৈরি শুরু হয়েছে। কিন্তু পুরনো বা সেকেলে কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে যে কোন বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানোর আগে প্রেসিডেন্ট জি পিএলএর ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে চান যাতে করে সংস্কারকে প্রতিহত করা সম্ভব না হয়। সেই কারণে সংস্কারটা শুরু হয়েছে পার্টির নিয়ন্ত্রণের প্রধান বাহন কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনকে দিয়ে। এই কমিশনের প্রধান স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জি। পিএলএর ৪টি সদর দফতর আছেÑ সৈন্য রিক্রুট, অস্ত্র সংগ্রহ, লজিস্টিক সরবরাহ ও রাজনৈতিক তত্ত্বাবধান। এগুলোকে ভেঙ্গে ছোট করে কমিশনের সঙ্গে আন্তিকরণ করা হয়েছে। এক সময় এই চার সদর দফতর ছিল পিএলএর সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনগুলোর অন্যতম। এগুলো প্রায় স্বাধীন ও পৃথক পৃথক বিভাগ হিসাবে কাজ করত। এখন এগুলো কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের বিভিন্ন বিভাগের আওতাধীন। এর ফলে পার্টি পিএলএর সবকিছুর উপর আরও ভালভাবে নজরদারি চালাতে পারবে। কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের যে ১৫টি নতুন বিভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে রাজনৈতিক, লজিস্টিক ও লোক ব্যবস্থাপনা বিভাগ ছাড়াও রয়েছে দুর্নীতিদমন বিভাগ। প্রেসিডেন্ট জি ইতোমধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির ওপর খড়গহস্ত হয়েছেন। কয়েক ডজন জেনারেলকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় সংস্কার কাজ হলো সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন সার্ভিসকে আগের তুলনায় অধিকতর সমান অবস্থানে রাখা। এতদিন স্থলবাহিনীর অবস্থান ছিল সবার ওপরে। যতদিন পিএলএর প্রধান দায়িত্ব ছিল স্থল সীমান্তের ওপার থেকে হামলা প্রতিহত করা ততদিন বিষয়টা সঠিকই ছিল। যেমন আশির দশক পর্যন্ত সোভিযেত ইউনিয়ন ছিল চীনের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি। কিন্তু এখন আর নেই। এখন চীনের সামরিক উচ্চাভিলাষ গড়ে উঠেছে। সেই উচ্চাভিলাষ চীন সাগরে এবং তার বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। চীন এখন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার নৌ ও বিমান শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। সম্প্রতি পিএলএর মুখপাত্র লিবারেশন আর্মি ডেইলীর এক সম্পাদকীয়তে সেনাবাহিনী কেন্দ্রিক মনমানসিকতার জন্য সশস্ত্রবাহিনীর সমালোচনা করা হয়েছে। তা থেকেই বোঝা যায় যে, সেনাবাহিনীর আগের অবস্থান এখন আর থাকছে না। নৌ ও বিমানবাহিনী ছাড়াও সেনাবাহিনীর জন্য আলাদা একটা কমান্ড এখন গঠন করা হয়েছে। তেমনি গঠন করা হয়েছে মহাকাশ ও সাইবার যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে পৃথক একটি কমান্ড এবং ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের দায়িত্ব দিয়ে আরও একটি কমান্ড। এসব ছাড়াও গঠন করা হয়েছে এক নতুন যৌথ কমান্ড যার হাতে বিভিন্ন বাহিনীর সার্বিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে। এ হলো কতকটা আমেরিকার জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের মতো। আঞ্চলিক কমান্ড কাঠামোতেও বড় ধরনের পরিবর্তন চলছে। চীন সাতটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এগুলো ছিল শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের মধ্যে সৈন্য ও কাজ সরঞ্জামের আদান প্রদান তেমন একটা হতো না। এখন এই সামরিক অঞ্চলের সংখ্যা কমিয়ে পাঁচে আনা হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে মোতায়েন করার আগে সৈন্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটা বিভিন্ন বাহিনীকে দিয়ে করা হবে। এভাবে চীন তার সশস্ত্রবাহিনীর এক ব্যাপক সংস্কারের পথে পা বাড়িয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে এই সংস্কারের বিরোধীদের অস্তিত্ব আছে এবং সেই বিরোধিতাও যথেষ্ট তীব্র। কাজেই সংস্কার ঠিকমতো কার্যকর করা না গেলে শুধু সশস্ত্র বাহিনীরই নয়, গোটা সমাজের স্থিতিশীলতাও ক্ষুণœ হতে পারে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×