ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতের নির্দেশ দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ

খালেদার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ॥ আইনগতভাবেই মোকাবেলা করবে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

খালেদার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ॥ আইনগতভাবেই মোকাবেলা করবে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আইনগতভাবেই মোকাবেলা করবে বিএনপি। তবে সরকারকে চাপে রাখতে আপাতত বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে হাল্কা কিছু কর্মসূচী পালন করে ৩ মার্চের মধ্যে আদালত যে রায় দেয় তা দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দলটি। সে ক্ষেত্রে রায় প্রতিকূলে গেলে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী পালনের কথা ভাবছে বিএনপি হাইকমান্ড। সূত্র মতে, সোমবার দলের চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়ার পর বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের কাছ থেকে খালেদা জিয়ার কাছে দুই রকমের প্রস্তাব আসে। দলের কোন কোন নেতা দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচী পালনের প্রস্তাব দেন। আবার কোন কোন নেতা বিশেষ করে দলের আইনজীবী নেতারা এ মামলাকে আইনগতভাবে মোকাবেলা করার প্রস্তাব দেন। আর সোমবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠককালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে রাজনীতি করার আহ্বান জানান। সব বিবেচনা করে ওইদিন রাতে খালেদা জিয়া ক’জন সিনিয়র নেতাকে আপাতত আন্দোলন কর্মসূচীতে না যাওয়ার পক্ষে তাঁর অবস্থানের কথা জানান। তবে সরকারকে কিছুটা চাপে রাখার কৌশল হিসেবে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ ক’টি অঙ্গ সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের ঘোষণার কথা জানালেও খালেদা জিয়া এসব সংগঠনকে কর্মসূচী পালনে বাধা দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রতিবাদে অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কর্মসূচী দিলেও তিনি বাধা দেবেন না বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বাদী এ্যাডভোকেট মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী বাদী বলেন, খালেদা জিয়ার উক্ত বক্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ঘোষণা পত্রের পরিপন্থীই নয়, দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে বর্তমান সরকারের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করেছে- যা দেশের সাবভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও দলের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলাটি করা হয়েছে তা বেআইনী। তবে খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। এ ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। খালেদা জিয়ার এ মামলা আইনগতভাবে মোকাবেলা করার ব্যাপারে তাঁর আইনজীবীরা যখন যা প্রয়োজন তাই করবে। এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ও দলের গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আইনগতভাবেই মোকাবেলা করা হবে। আমরা মনে করি এ মামলায় খালেদা জিয়াকে ফাঁসানো সম্ভব হবে না। কারণ যে কথা বলার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছে তার জন্য এ ধরনের মামলা হয় না। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্য করায় সোমবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। মামলাটি করেন সুপ্রীমকোট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী। আদালত আগামী ৩ মার্চের মধ্যে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে দেয়া এ রায়ের পর দেশব্যাপী এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকে আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হচ্ছে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি কোন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়নি। একই অভিযোগে গত ২৭ ডিসেম্বর দ-বিধির ১২৩ (ক) ধারায় বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট মশিউর মালেক একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় সরকারের অনুমতি গ্রহণ করে শাহবাগ থানাকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। এছাড়া একই অভিযোগে নড়াইলের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মানহানির মামলা হয়। গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, ‘তিনি তো (বঙ্গবন্ধু) বাংলাদেশের স্বাধীনতা নয়, বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন’। একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার তথ্য নিয়েও তিনি সংশয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আজকে বলা হয়, এত লোক শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও তো অনেক বিতর্ক আছে।’ খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যের পরদিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত সত্য নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য আসায় জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে খালেদা জিয়ার এমন বিরূপ বক্তব্যের কারণে ২৩ ডিসেম্বর খালেদা জিয়াকে একটি লিগ্যাল নোটিস পাঠান সুপ্রীমকোট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী। নোটিসে খালেদা জিয়াকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তিনি এ নোটিসের কোন জবাব দেননি। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। এ্যাডভোকেট মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদীর আবেদন অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি মামলার অনুমতি প্রদান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর সোমবার এ্যাডভোকেট মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের নেতৃত্বে শতাধিক আইনজীবীকে নিয়ে নিম্ন আদালতে মামলা করেন। আদালত খালেদা জিয়াকে আগামী ৩ মার্চের মধ্যে আদালতে হাজিরের সমন জারি করেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় দ-বিধির ১২৪ (ক) ধারার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের পাশাপাশি ১২৩ (ক) ধারায় বাংলাদেশ সৃষ্টির নিন্দা ও তার সার্বভৌমত্ব বিলোপে সমর্থন করার এবং ৫০৫ ধারায় জনগণের অনিষ্ট সাধন সহায়ক বিবৃতি দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। আদালত ৩টি ধারায়ই অভিযোগ আমলে নিয়ে সমন জারির ওই আদেশ দেন। মামলার ৩টি ধারার মধ্যে ১২৪ (ক) ধারায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- ও সর্বনিম্ন ৩ বছর কারাদ- ও যে কোন পরিমাণ অর্থদ- অথবা শুধু যে কোন পরিমাণ অর্থদ- দেয়ার বিধান রয়েছে। আর দ-বিধির ১২৩ (ক) ধারায় সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম কারাদ-সহ অর্থদ- এবং দ-বিধির ৫০৫ ধারায় সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদ- ও অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে বিধান রয়েছে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার একদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বর্তমান সরকার ভয় পায়। তাই খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই সরকার ‘মিথ্যা’ মামলার আশ্রয় নিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা সরকারের ভয়াবহ চক্রান্ত। খালেদা জিয়ার ২১ ডিসেম্বর প্রদত্ত বক্তব্যের কোথাও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতে পারে এমন কোনও বক্তব্যের লেশমাত্র নেই। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এ মামলা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য হীন উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। সরকার রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে খালেদা জিয়ার নামে এ মামলা দেয়া হয়েছে। তাই আমরা এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জনাচ্ছি। এর প্রতিবাদে কোন কর্মসূচী আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি কখনও কর্মসূচী আসে তখন জানতে পারবেন। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সংবাদ সম্মেলন করে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন এটাই আমাদের দলীয় প্রতিক্রিয়া। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না।
×