ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত নিবেদিত এক আওয়ামী লীগ কর্মীর করুণ আর্তনাদ ;###;রাজপথে একসঙ্গে সেøাগান দেয়া সহকর্মীরা এখন আমাকে এড়িয়ে চলেন;###;দুঃখে-অপমানে কারও কাছে যাই না, শুধু প্রধানমন্ত্রীকে একটু দেখতে ইচ্ছে করে

কেউ আর এখন আমার খোঁজ নেয় না

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

কেউ আর এখন আমার খোঁজ নেয় না

ফিরোজ মান্না/আনোয়ার রোজেন ॥ ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে/ জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’। এই পাল্টানো সময়ে সত্যি সত্যিই অনেক খবর অজানাই থেকে যায়। চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে যায় প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। রোজ বদলায় মানবিকতার রূপ অমানবিক এই সংসারে। বঞ্চিতের মানসিকতা নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছু প্রাপ্তির আশা তাই বৃথা। ২০০১ সালের পর বিএনপি জামায়াত সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে অকথ্য নির্যাতনের শিকার সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ কর্মী কমিশনার তাহমিনা সুলতানা তহুরার জীবনের অনেক খবর এখন চাপা পড়ে গেছে। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত নিবেদিত এই কর্মী এখন হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তহুরা জনকণ্ঠের প্রধান কার্যালয়ে এসে তার জীবনের সংগ্রাম ও বঞ্চনার কথা বলেছেন। বলেছেন, যাদের যা দেখেছি তারা এখন অন্য রকম। অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। টাকার জোরে মানুষ চেনা মানুষকেও অচেনা করে দেখে। তাদেরই দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে এখন আমি হয়রান, পেরেশান। আমার নাম শুনলেই নেতাদের পাইক পেয়াদারা অবলীলায় বলে দেন, ‘সাহেব বাসায় নেই’। কখন আসবেন সেই সময়টুকুর কথা বলার সময়ও তারা দেয় না। অগত্যা বাড়ির বাইরে বসে থাকা। আর মিথ্যে বলার সাক্ষী হয়ে থাকার অপেক্ষা। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় সেই নেতাই বাড়ি থেকে সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দামী গাড়িতে সাঁই করে চলে যাচ্ছেন। অনেক দিন গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। পাইক পেয়াদারা ধমকিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। আর ওই চেনা নেতা আমাকে না চেনার ভান করে কালো চশমা পরে গাড়ির সিটে আরাম করে বসে আছেন। বড় বড় দালান কোঠায় থাকেন তারা। এক সময় রাজপথে আমার কণ্ঠে সেøাগান না হলে মিছিল হতো না। তারাই বলতেন, ‘তহুরা, সেøাগান ধরো’। সেই তারাই এখন আমাকে চেনেন না। সময় কত দ্রুত বদলায়। এখন আমি ব্রেন টিউমার নিয়ে হাসপাতালের বেডে। তিন বছর ধরে হাসপাতালই আমার ঠিকানা। আমার খোঁজ কেউ রাখে না। কেউ নিতে চায় না। তহুরার জীবনের করুণ গল্প অনেক বড়। এলাকার মানুষ, স্থানীয় প্রশাসনও তাকে নানাভাবে হয়রানি করেছে। সেই জ্বালা যন্ত্রণা তাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। ‘২০০৩ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখন জামায়াতপন্থী চেয়ারম্যান ও কতিপয় কমিশনার মিলে আমাকে কোন কাজ করার সুযোগ দেয়নি। উল্টো নানাভাবে হয়রানি করেছে। আমি আওয়ামী লীগ করি বলে সেই সময় জামায়াতের এক কমিশনার ২০/৩০ সন্ত্রাসী নিয়ে আমাকে বেধড়ক মারধর করে, মাথা ফাটিয়ে দেয়। তারপর থেকেই একটার পর একটা অসুখ আমার মধ্যে বাসা বাঁধতে থাকে। এখন আমি ব্রেন টিউমার নিয়ে তিন বছর ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালই আমার ঠিকানা হয়েছে। ভিটেমাটি যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়েও চিকিৎসার খরচ মেটাতে পারছি না। দুই চোখের জ্যোতিও ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। কান দিয়ে মাঝে মধ্যে রক্ত পড়ে। আমি কিভাবে বাঁচব জানি না। আমার সহায় সম্বল আর কিছু নেই। এখন একমাত্র ভরসা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি জানি মৃত্যু আমার দুয়ারে হানা দিয়েছে। হয়ত বেশি দিন বাঁচব না। মৃত্যুর আগে যদি আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখা পেতাম তাহলে যেন মরেও সুখ পেতাম। আমি তার কাছে কোন সাহায্য চাই না- শুধু একবার তার দেখা চাই। এটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা।’ তহুরা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, ২০০৮ সালে আমি আমেরিকার যাওয়ার জন্য ডিভি লটারি পেয়েছিলাম। চার লাখ টাকা খরচ করে আমেরিকা যাওয়ার ফাইনাল লেটারও হাতে পেয়েছিলাম। কিন্তু হাসিনা আপা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) গ্রেফতার হওয়ায় আমেরিকার স্বপ্ন ভুলে যাই। হাসিনা আপাকে এক নজর দেখার জন্য জেলখানার সামনে সারাদিন বসে থাকতাম। তখন দল ও বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য শ্রদ্ধা ভালবাসায় সব কিছুকে উপেক্ষা করে দেশেই থেকে গেলাম। কিন্তু নিয়তি এমন নিষ্ঠুর তা আগে জানিনি। এখন বুঝি গরিবের ভালবাসার কোন দাম নেই। দুই ভাই ও এক বোন প্রতিবন্ধী হওয়ায় ইচ্ছা ছিল জীবনে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করব। আমি মাদার তেরেসার মতো মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করব। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে ইচ্ছা পূরণের সুযোগ ভাগ্যে জোটনি। সব আশাই শেষ। ভাই বোনদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজে অবিবাহিতই রয়ে গেছি। আজ যদি স্বামী থাকত তবুও তো একজন মানুষ পাশে থাকতেন। আমার তো তাও নেই। আমি একা-ভীষণ একা-যে আমি আমার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা। সব ইচ্ছে মরে মরে শেষ হয়ে গেছে- এখন শুধু জীবন বাঁচানোর ইচ্ছেটা তিল পরিমাণ বেঁচে আছে। এটাও হয়ত থাকবে না। শেষ অন্ধকার নেমে আসবে জীবন আকাশে। তাই জীবনে একটু আলো থাকতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখটা একবার দেখব। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার ডেঙ্গার গ্রামের মেয়ে তহুরা। দুই ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৮৭ সালে বাবা মারা যান। তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর। কিন্তু পড়া লেখার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। সেই অদম্য আগ্রহের জোরে অনেক কষ্টে বিএ পাস করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। অপরজন মানসিক প্রতিবন্ধী। এক বোনও মানসিক প্রতিবন্ধী। বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। মা বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। অসুস্থ মা, ছোট দুই ভাই এবং প্রতিবন্ধী বোনের জন্য সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। তাদের কথা ভেবে নিজের বিয়ে-সংসারের চিন্তা বাদ দেন তিনি। ২০০৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এলাকাবাসী সংরক্ষিত মহিলা আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত করেন। তখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বিএনপির সমর্থক, অন্য সদস্যরাও বিএনপি-জামায়াতের। একমাত্র তহুরাই আওয়ামী লীগের কর্মী। আর এ কারণেই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে কোন কাজ করতে দেয়া হতো না। মাঝে মাঝে যৎসামান্য ভিজিএফ, ভিজিডি এবং বয়স্ক ভাতার কাজ করলেও এজন্য তাকে পরে নানা বিপদে ফেলানোর চেষ্টা করা হতো। তহুরা বলেন, আমি এসব সহায়তা আওয়ামী গরিব-দুঃখীদের দিতাম এজন্য আমাকে খেসারত দিতে হয়েছে। কয়েকবার আমাকে হেনস্থাও করা হয়েছে। ২০০৮ সালে উপজেলা নির্বাচনে আমি ৪৬ হাজার ভোট পেয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হই। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই তৎকালীন ইউএনও ঘোষণা করেন, ফল ঘোষণায় ভুল হয়েছে। আসলে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মেহেরুন্নেছা (বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী)। তখন থেকেই আমি অসুস্থ। মাথার সমস্যা। সেই বেধড়ক পেটানোর পর থেকেই মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা হতো। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়েছি। কিন্তু প্রকৃত রোগ শনাক্ত করা যায়নি। গত বছরের অক্টোবরে শেষ সম্বল বসতভিটার জায়গাটুকু বিক্রি করে ভারতের চেন্নাই যাই। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বলেছেন, আমার ‘একরো ম্যাগালি’ রোগ হয়েছে (এক ধরনের ব্রেন টিউমার যাতে ব্রেনের মাংস বেড়ে যায়)। রোগ সারাতে দুইটি অপারেশন করতে হবে। এতে খরচ হবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। চেন্নাইয়ে থাকতেও হবে প্রায় তিন মাস। চিকিৎসক বলেছিলেন প্রতি সপ্তাহে রেডিও থেরাপি দিতে এবং প্রতি মাসে একটি ইনজেকশন নিতে (যার দাম সাড়ে ১২ হাজার টাকা) হবে। এতে মাথার যন্ত্রণা কিছুটা কমবে। কিন্তু এত টাকা আমি পাই কই? শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইটি টিউশনি করে ও মানসিক প্রতিবন্ধী ভাইটি গার্মেন্টসে কাজ করে মাঝে মাঝে কিছু টাকা আমাকে দিত। এখন সেটাও পাই না। কারণ, অসুস্থ মা ও নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তারাই চলতে পারে না। গত মাসে মেহের আফরোজ চুমকি আপা (মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী) একটি ইনজেকশন কিনে দিয়েছিলেন। তার আগের মাসে ঈশ্বরদীর এ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু ভাই একটি ইনজেকশন কিনে দেন। এ মাসে ইনজেকশন কেনার কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি। সাহায্যের জন্য যেখানেই যাই- কথা বলার সময় নাই বলে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়। দুঃখে-অপমানে এখন আর কারও কাছে যাই না। এদিকে উপজেলা নির্বাচনে আয়-ব্যয়ের রিটার্ন জমা না দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ প্রায়ই বাড়িতে এসে আমাকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজে। এখন আমার শেষ ঠিকানা শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। এখানেই যেন আমার মৃত্যু হয়। কারণ, আমার তো বাড়িঘর নাই, যাব কোথায়? আবার গ্রেফতারি পরোয়ানাও ঝুলছে মাথার ওপর। আমি জানি, চিকিৎসার জন্য কোনদিন এত টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই অপারেশনও হবে না। শুধু জীবনের শেষ ইচ্ছা, যার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছি; সেই হাসু আপাকে যেন মৃত্যুর আগে এক নজর দেখে যেতে পারি। তাহলে মরেও শান্তি পাব। আমার শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইটি তিনবার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ছয় লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারায় প্রতিবারই মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যায়। আমি অসুস্থ হওয়ায় আমার মা-ভাই-বোন জনম দুঃখী। যার যা ছিল সবই আমার চিকিৎসার জন্য ব্যয় করেছে। টিউমারের চাপে আমার চোখজোড়া ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন চোখে দেখি না বললেই চলে। ডাক্তার বলেছিল, তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে। অপারেশন করলে আমি ভাল হয়ে যাব। আগের মতো চলাফেরা করতে পারব। এজন্য দেশের সহৃদয়বান মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি- আমার প্রতি একটু সদয় হন- আমি বাঁচতে চাই। আমার হিসাব নং- তাহমিনা সুলতানা, সঞ্চয়ী হিসাব নং ১০০২১০৪২৬ সোনালী ব্যাংক, একদন্ত শাখা, পাবনা। বিকাশে টাকা পাঠানোর নম্বর : ০১৭৫৫-০২৮৪৭৫, ০১৯২৪-৩৫৩৩৪৮। আমি আমার নিজ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছেও একই আরজি রেখে গেলাম।
×