ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

অভিমত ॥ অবৈতনিক শিক্ষা এবং বর্তমান পরিস্থিতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

অভিমত ॥ অবৈতনিক শিক্ষা এবং বর্তমান পরিস্থিতি

পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার আলোহীন কোন ব্যক্তিকে বর্তমান মানব সভ্যতায় মূল্যহীন বলেই গণ্য করা হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী রাষ্ট্রকে জনগণের এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেখানে শিক্ষা হবে অবৈতনিক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের উন্নয়নে যে সব পদক্ষেপ জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষাখাতে ঐতিহাসিক সংস্কার ও যুগান্তকারী পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য আকাশচুম্বী। শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু এরপরও নানা কারণে শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বাবদ খরচ যোগান দিতে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজনের মধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে। শিক্ষা উপকরণ কিনতে অনেক পরিবার হিমশিম খাচ্ছে। বছরের শুরুতে স্কুলে অস্বাভাবিক বেতন বাড়ানো বর্তমানে শিক্ষাখাতে নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। নতুন পে স্কেল কার্যকর হয়েছে- এ অজুহাতে বেতন ফি নিয়ে স্কুল-কলেজে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। স্কুলে ভর্তিতে গলাকাটা ফি আদায় করছে রাজধানীর নামীদামী স্কুলগুলো। পে স্কেলে বেতন বেড়েছে প্রায় শতভাগ। তাই শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এজন্য বাড়ছে স্কুলের বেতন। এমন সব নোটিস ঝুলিয়ে রাজধানীর ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজে বাড়তি বেতন ও ফি আদায় করা হচ্ছে। কোন কোন বিদ্যালয়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত বেতন বাড়ানো হয়েছে। লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বেতন অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজে শ্রেণীভেদে কমপক্ষে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেতন বেড়েছে। উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেতন বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ভর্তি ফি দ্বিগুণ করেছে। গত বছর ৫ হাজার টাকায় সন্তানকে ভর্তি করাতে পারলেও এ বছর অভিভাবককে গুনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা। ৭০ ভাগের বেশি শিক্ষক চুক্তিভিত্তিক। অর্থাৎ তারা সরকারী কোন অনুদান পান না। স্কুলের নিজস্ব ফান্ড থেকে তাদের বেতনভাতা দিতে হয়। এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমান বেতন ভাতা দিতে হয়। কখনও বেশি দিতে হয়। এজন্য স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ভাতা বাবদ খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এসব টাকার প্রধান উৎস শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন, উন্নয়ন ফি ইত্যাদি। এসব কারণে বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী তারা সরকার থেকে শতভাগ মূল বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আংশিক পায়। বাকিটা শিক্ষার্থীদের বেতন ও প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে সংস্থান করতে হয়। সরকার থেকে শতভাগ মূল বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও শতভাগ পেলে বেতন বাড়ানোর দরকার হবে না বলে জানায় তারা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা মানছে না। এমনকি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পরীক্ষা ফি শিক্ষাবোর্ড নির্ধারণ করে দিলেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কোথাও কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাস্তি পেয়েছে এমন নজির নেই। আর এই সুযোগটিই বার বার গ্রহণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। রাজধানীর নামীদামী স্কুল থেকে মফস্বলের স্কুল পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। সরকারের নীতিমালা, মন্ত্রণালয়ের আদেশ-নির্দেশ কোন কিছুই তাদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। বাংলাদেশে শিক্ষা যে এখন একটা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে, এসবই হলো তার প্রমাণ। বিভিন্ন নামে নতুন ফি আরোপ করাসহ এককালীন অনুদান বা চাঁদা ও মাসিক বেতন বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বই, খাতাসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু কাগজের দামই বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বেড়েছে বিদেশী বইয়ের দাম। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ছাত্রছাত্রীদের পরিবহন ব্যয়সহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে। কাজেই শিক্ষা এখানে সুলভ হওয়ার কোন উপায় নেই। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার থেকে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষা ব্যয়। তবে শুধু শিক্ষা ব্যয়ই নয়, জীবিকার অন্য ক্ষেত্রেও ঘটছে একই বিষয়। দেশের এক শ্রেণীর মানুষ শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। তাদের জীবনমান প্রমাণ করে তারা শিক্ষাকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। তারা ভুলে গেছেন, শিক্ষা বাণিজ্য নয়- অধিকার। বাংলাদেশের মতো একটা দেশে শিক্ষার উপকরণের দাম বৃদ্ধি খুবই খারাপ একটা বিষয়, কেননা এখনও অর্ধেকেরও বেশি লোক অক্ষরজ্ঞানবর্জিত। শিক্ষার খরচ বৃদ্ধি পেলে সেটা শিক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও সুখকর হবে না। শিক্ষার হার বাড়ানোর সরকার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। তবে এটি নতুন কোন বিষয় নয়, স্কুলগুলো এমনিতেই প্রত্যেক বছরের বিভিন্ন সময় নানা খাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকে। এর আগে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ের অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে নানা কারণে সে সময় এ বিষয়ে তেমন কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এ কারণে শিক্ষাকে রীতিমতো পণ্য বানানোর চেষ্টা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এবার অভিভাবকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা টনক নড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের। স্কুলগুলোর বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে করণীয় জানতে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। মাউশির মহাপরিচালক বলেছেন, ‘একেকটি স্কুল একেক রকম ফন্দি করে টাকা আদায় করছে। কেউ ভর্তির সময় টাকা বেশি আদায় করছে, কেউ বেতন দ্বিগুণ করেছে। এভাবে চলতে পারে না।’ শিক্ষা কোন পণ্য নয়। এটা সবার অধিকার। একটি স্কুলে ধনী ও দরিদ্র উভয় সম্প্রদায়ের সন্তানরাই পড়াশোনা করে। অযৌক্তিক কোন অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো কোনভাবেই কাম্য নয়। লেখক : শিক্ষাবিদ
×