ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

বইয়ের অগ্রযাত্রা ও বইমেলা

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

বইয়ের অগ্রযাত্রা ও বইমেলা

পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো আরও একটি বইমেলা। মেলা বলতে নির্ভেজাল উৎসবের চিত্রকল্পে বিষাক্ত দাগ লাগিয়েছিল অভিজিতের হত্যাকারীরা। তাদের হাত আরও প্রসারিত হয়েছে এরপর প্রকাশক হত্যা ও আহত করার মধ্যদিয়ে। তাতে থেমে নেই প্রকাশনা শিল্প। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলা বইমেলা ২০১৬ তার প্রমাণ। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তেরো বছর পর ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড অভারতীয়দের ব্যাকরণনির্ভর বাংলা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন । বাংলা ভাষার প্রতি অপরিসীম মমতা থেকে নয়, এ দেশে বাণিজ্য করতে এসে স্থানীয় ভাষায় অভ্যস্ত হতে না পারলে অসুবিধা অনেক। এটুকু বোঝার কা-জ্ঞান থেকে ওই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যে ছাপা মেশিনের কারণে বাঙালীদের কাছে হ্যালহেড স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই ছাপা মেশিনের বিবর্তনের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকাশনা জগতও আজ অনেক বিকশিত। অনেক বেশি প্রফেশনাল। আর দশটা পণ্য নিয়ে বাঙালী ব্যবসায়ী যেখানে পুরোপুরি পেশাদার হতে পারে না সেখানে বইয়ের মতো পণ্য নিয়ে এগোনো কি সম্ভব? এ প্রশ্ন পেছনে ফেলে দেশের প্রকাশনা জগত আজ অনেক দূর এগিয়েছে। ‘প্রকাশনা শিল্প’ কথাটা অনায়াসে উচ্চারণ করা যাচ্ছে আমাদের দেশেও। এর পেছনে অমর একুশে বইমেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পের গতি দ্রুত বাড়িয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ ও ঝামেলা অনেক কমেছে। খুব অল্প সময়ে বাজারজাত করা যায় বলে প্রচুর বই বাজারে আসছে। ভেতরে বিষয় যাই থাক প্রকাশনার মান বেড়েছে, প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণরা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে পুরো মাত্রায়। স্বাধীনতার আগে ও পরে নানা সঙ্কট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক লাফে একে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপ্টায় চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে ওঠা ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে বারবার সেই প্রশ্নটিই উঠেছেÑ বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশ কাটিয়ে প্রকাশনা শিল্পের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করেছে যে, বই হারাবে না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বই সাংঘর্ষিক নয়। বরং এর ব্যবহার বইয়ের উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। বই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের পেশাদার হওয়ার সুযোগ হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছে। লেখার এবং কেনার প্রবণতাও এতে বেড়েছে। যে কেউ যে কোন বিষয় নিয়ে লিখছে। রান্না, রূপচর্চা, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল- সব কিছু নিয়ে বই হচ্ছে আজকাল। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়ারও দুটো কবিতা কিংবা গল্পের বই, গৃহবধূর দু’খানা লাইফস্টাইল বা রান্নাবিষয়ক বই, চাকরিজীবীর গদ্য-পদ্য মিলিয়ে হাফ ডজন বই থাকা আজকাল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু লিখলেই তা নিখুঁত বই হয়ে আসছে সহজেই। এই বিপুলসংখ্যক বই চিন্তা বা মননশীলতার জগতে কি অবদান রাখছে- তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলেও প্রকাশনা শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে। যার অর্থ বই এক লাভজনক পণ্যে পরিণত হচ্ছে। বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যান মতে, দু’হাজার চৌদ্দয় একুশের বইমেলায় নতুন বই এসেছিল তিন হাজার ছয় শ’ ঊনসত্তরটি, আর বিক্রি হয়েছিল ছাব্বিশ কোটি টাকার। ক্রেতা-পাঠকের উপস্থিতিও নাকি ছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মাসজুড়ে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের আগমন হয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। একাডেমির জরিপে বেরিয়ে এসেছে- আটাশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমিরই বিক্রি হয়েছে বিরাশি লাখ তেপ্পান্ন হাজার টাকার বই। সে বছর বই এসেছিল তিন হাজার তেরোটি। গতবছর মেলায় এসেছিল চার হাজারের বেশি বই। দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি দুই-ই বাড়ছে। গত বছর বা তার আগের বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন, “একুশের বইমেলার ইতিহাসে এবারই প্রথম মেলা হবে ‘প্রকাশকদের মেলা।’ প্রকাশকদের বাইরে এবার কোন স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র নীতিমালা মেনেই এবার মেলা পরিচালিত হচ্ছে। উটকো প্রকাশক, সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বই বিক্রির যে হিড়িক অন্যান্যবার থাকে এবার তা থাকছে না। এগুলো ঠিকঠাকভাবে মানা গেলে প্রকাশনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।” পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বইমেলা হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ও প্রকাশকদের মেলা। প্রায় পঁাঁচ শ’ বছরের পুরনো এ আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম তিন দিন বরাদ্দ প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের জন্য। এ তিন দিন অন্য কারও মেলায় প্রবেশ নিষেধ। চার বছর আগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দু’হাজার নয় সালে এ মেলায় চার লাখের মতো বই এসেছিল। অংশ নেয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল তিন শ’ চৌদ্দ। এসব পরিসংখ্যান বইয়ের অগ্রগামী অভিযাত্রার চিত্রই তুলে ধরে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকাশনা শিল্প যত দৃঢ় হচ্ছে, ভাল লেখকের ঘাটতি ততই প্রকট হচ্ছে। পাঠকের মান বাড়ানোর দায় খানিকটা লেখকের ওপরও বর্তায়। প্রকাশকদের দায়ও কিছু কম নয়। দায়িত্বশীল প্রকাশকদের সহযোগিতায় অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন- এমন দৃষ্টান্ত পশ্চিম বাংলায় অনেক আছে। ব্যবসার ক্ষতি না করেও এটা করা যায়। ঘটনাক্রমে একজন লেখক বাজার পেয়ে গেলেন- ব্যস, তাকে নিয়ে কর্পোরেট বাণিজ্য হুমড়ি খায়। প্রতিশ্রুতিশীল বা ক্ষমতাবান অন্য লেখকরা পাত্তাই পান না। পেশাদারিত্বের নামে এ ধরনের মানসিকতা ভাষা-সাহিত্যের বিকাশে তেমন কোন অবদান রাখতে তো পারেই না বরং ক্ষতি করে। কলকাতার দায়িত্বশীল প্রকাশনী ‘প্রতিক্ষণ’-এর কর্ণধার প্রিয়ব্রত দেব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- ‘প্রকাশকদের কাজ শুধু বই প্রকাশ আর বেচা নয়। পাঠক তৈরি করাও তাঁদের দায়িত্ব। নতুন লেখক তৈরিতে মন দেয়া প্রয়োজন। প্রকাশনা একটি সম্ভ্রান্ত ব্যবসা। প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। বই মানব সভ্যতার অগ্রগতির ঐতিহাসিক দলিল। তাই পাঠককে উন্নততর রুচির সন্ধান দেয়া প্রয়োজন।’ বাণিজ্যিকে উপেক্ষা না করেও এ কমিটমেন্ট পালন করা যায়। কমিটমেন্ট পেশাদারিত্বের অংশ। পৃথিবীর সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। একই ভাষা গোষ্ঠীর ফরাসী বা জার্মান ভাষীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও নিজেদের ভাষায় জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। পৃথিবীতে এখন ফরাসী ভাষায় কথা বলছে ছয় কোটি আশি লাখ মানুষ। জার্মান ভাষায় নয় কোটি আর বাংলায় কথা বলছে আঠারো কোটি দশ লাখের বেশি মানুষ। পরিসংখ্যানেই কেবল বাংলা, ফারসী ও জার্মানের দ্বিগুণ বা তার বেশি এগিয়ে আছে। কাজেকর্মে পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর। আমাদের ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিতা এর অন্যতম কারণ। আমাদের পুঁজির শক্তি নেই। ভাষার কণ্ঠও তাই ক্ষীণ। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারত ও চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের ছিল। কিন্তু চীনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ঢুকতে না পারায় আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তাদের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোও। আর আমরা আজও রাজনীতি অর্থনীতির সবকিছুতে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-সাহিত্যেও পড়েছে। এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে? রাষ্ট্রের বয়স পঁয়তাল্লিশ। সেই যে আঠারো শতকে কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফাঁদে আটকে ভূস্বামীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন- এদের মনে পরিবর্তনের কোন রকম ইচ্ছা জাগতেই পারে না। আমাদের শাসক শ্রেণীর জমিদাররা এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরোতে পারেননি আজও। এই এ হীনম্মন্যতা থেকে বেরোতে শিক্ষা-দীক্ষা আত্মমর্যাদার বোধ বাড়াতে হবে। আর এর সঙ্গে ভাষা-সাহিত্য বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যকে যাঁরা ছাপার অক্ষরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন তাঁরা ব্যবসায়ে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের গুরুত্বও বুঝবেন এমন সঙ্গত আশা করাই যায়।
×