ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারমুক্ত হচ্ছেন মির্জা ফখরুল

জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬

জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। জাঁকজমকভাবে কাউন্সিল করতে যা যা করণীয় তা করতে দলের ক’জন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কাউন্সিল সফল করতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় কাউন্সিল করার টার্গেট নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এবারের জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দীর্ঘ ৫ বছর পর ভারমুক্ত করা হচ্ছে। শনিবার রাতে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মার্চ মাসের মধ্যে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই দলের নির্বাহী কমিটিতে পদ প্রত্যাশী নেতাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ নেতাসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পদ প্রত্যাশী নেতাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে এবারও ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের মতো মনোনীত (সিলেক্টেড) প্রতিনিধিদের নিয়েই কাউন্সিল করবে বিএনপি। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও দলের সর্বস্তরে অধিকাংশ কমিটি পুনর্গঠন করতে না পারায় মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে কাউন্সিল করতে হচ্ছে। এর আগে ২০০৯ সালে কাউন্সিলের আগে ৬ মাস চেষ্টা করেও সর্বস্তরে কমিটি করতে পারেনি বিএনপি। পরে কেন্দ্র থেকে কাউন্সিলর ঠিক করে দিয়ে তাদের নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করা হয়। এবারও গত বছর আগস্ট মাস থেকে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরে কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন দলের হাইকমান্ড। কিন্তু দলীয় কোন্দলসহ বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা সম্বব হয়নি। অবশ্য আগস্ট মাসে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা নেতাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে নির্ধারিত সময়ে কমিটি পুনর্গঠন করতে না পারলে কেন্দ্র থেকে কমিটি চাপিয়ে দেয়ার আগাম ঘোষণা দেয়া হয়। জানা যায়, মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে একটি প্রস্তুতি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি এখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলে জাতীয় কাউন্সিলের তারিখ ও ভেন্যু ঠিক করবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় করার টার্গেট নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে কোন কারণে সেখানে করা না গেলে মহানগর নাট্যমঞ্চ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জাতীয় কাউন্সিল করার কথা ভাবা হচ্ছে। সূত্র মতে, লন্ডনে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রায় ২ মাস অবস্থানের পর গত বছর নবেম্বরে দেশে ফিরেই খালেদা জিয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে ভেতরে ভেতরে দলের জাতীয় কাউন্সিলের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এর মধ্যে ডিসেম্বরে পৌর নির্বাচনের কারণে প্রস্তুতিতে ভাটা পড়ে। আর ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করা নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত থাকার পর আবার জাতীয় কাউন্সিলের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়। শনিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে জাতীয় কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও দীর্ঘ ছয় বছর পার হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় কাউন্সিল হতে যাচ্ছে বিএনপির। রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা দলটি জাতীয় কাউন্সিলের মধ্যে দিয়ে গতিশীল হবে বলে মনে করছেন বিএনপি হাইকমান্ড। কাউন্সিলের মাধ্যমে একটি নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের মাধ্যমে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে আমরা বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও দলের জাতীয় কাউন্সিল করতে পারিনি। তবে এবার মার্চ মাসের মধ্যে আমরা জাতীয় কাউন্সিল করতে চাই। এ জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। শীঘ্রই জাতীয় কাউন্সিলের তারিখ ও ভেন্যু জানিয়ে দেয়া হবে। আমরা মনে করি জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল গতিশীল হবে। আর দীর্ঘদিন ধরে দল চলছে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দিয়ে। তাই এবারের জাতীয় কাউন্সিলে অন্যান্য পদের মতো একজন মহাসচিব নির্বাচিত করা হবে। যেহেতু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের জন্য অনেত ত্যাগ স্বীকার করে রাজনীতি করছেন তাই তিনি এবার ভারমুক্ত মহাসচিব হবেন বলে অনেকেই মনে করছেন। এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নেতাকর্মীদের নামে মামলাসহ বিভিন্ন কারণে আমরা এতদিন জাতীয় কাউন্সিল করতে পারিনি। তবে এবার জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি চলছে। মার্চ মাসের মধ্যেই জাতীয় কাউন্সিল হবে। আর কাউন্সিলের পর দলকে ঢেলে সাজিয়ে আবার অধিকততর গতিশীল করা হবে। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের দিন খালেদা জিয়াকে পুনরায় চেয়ারপার্সন এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করে দলের ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ওই বছর ৬ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় বিএনপির অনেক ত্যাগী নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। এ কারণে সুযোগবঞ্চিত বিএনপি নেতাদের ক্ষোভ বাড়ার কারণেই মার্চের মধ্যে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নেন খালেদা জিয়া। এবার কাউন্সিলের পর নতুন কমিটিতে বিএনপির বর্তমান ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটি থেকে ১০০ জনের বেশি নেতা বাদ পড়তে পারেন। কমিটিতে যাদের রাখা হবে তাদের মধ্য থেকে অনেকেরই পদ-পদবী রদবদল হবে। আর নতুন কমিটিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিশ্বস্ত শতাধিক নেতাকে সুবিধাজনক অবস্থানে স্থান দেয়া হবে। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জনকে নেয়া হবে সাবেক ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা তরুণ নেতাকে। জানা যায়, এবারের জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হবে। বিশেষ করে তরুণ নেতাদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। দলের স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের মধ্যে ২টি পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। আর স্থায়ী কমিটির আরও ক’জন সদস্য অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তাই স্থায়ী কমিটির বেশ ক’টি পদে নতুন মুখ আসবে। সে ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে নতুন জায়গা পেতে পারেন ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ শতাধিক পদে নতুন নেতাদের দেখা যাবে বলে জানা গেছে। এছাড়া নির্বাহী কমিটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আসতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শামসুজ্জামান দুদু, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মিজানুর রহমান মিনু, রুহুল কবির রিজভী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বরকতউল্লাহ বুলু, ফজলুল হক মিলন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, গোলাম আকবর খন্দকার, শিরিন সুলতানা, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, নাজিমউদ্দিন আলম, এহসানুল হক মিলন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, হাবিব উন নবী খান সোহেল, আবুল খায়ের ভূইয়া, এমরান সালেহ প্রিন্স, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহমিনা রুশদী লুনা, রেহানা আক্তার রানু, নীলুফার চৌধুরী মনি, শাম্মী আক্তার, আসিফা আশরাফি পাপিয়া, শ্যামা ওবায়েদ প্রমুখ। উল্লেখ্য, গত বছর ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় কাউন্সিল করতে ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার আগে গুলশান কার্যালয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বৈঠককালে তিনি বার বার দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সবাই মিলে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজে সহযোগিতা করবেন। তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ হলে ডিসেম্বরের মধ্যেই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করা হবে। সিনিয়র নেতারাও তখন খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি দেশে ফেরার আগেই ৭৫ সাংগঠনিক জেলা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু তা করতে না পারায় ২১ নবেম্বর খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর বিএনপির সিনিয়র নেতারা তোপের মুখে পরেন। পরে তিনি নিজেই ভেতরে ভেতরে জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করেন।
×